নিভে আসে সব আলো, হৃদি ভেসে যায়...
“যেয়ো না, রজনী, আজি লয়ে তারাদলে! / গেলে তুমি, দয়াময়ী, এ পরাণ যাবে!-/ উদিলে নির্দয় রবি উদয় অচলে, / নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে !...” সম্বচ্ছরের শোক তাপ জ্বালা জুড়িয়ে তিনটে মাত্র দিনের জন্য যে উমাকে গিরিজায়া বুকের মাঝে পেয়েছিলেন, শত অনুরোধ, অশ্রুমোচন, বিলাপ, দীর্ঘশ্বাসের পথ পেরিয়ে হলেও সেই উমাকে নবমী নিশি পার করেই প্রস্তুত করতে হবে পতিগৃহে যাত্রার জন্য। ডানার নীল রং আকাশের গায়ে মাখিয়ে আগে আগে উড়ে যাবে নীলকণ্ঠ পাখি। কৈলাসে ভূতপ্রেত বেষ্টিত নন্দীভৃঙ্গীর মাঝে বসে থাকা শ্মশানচারী মহাদেবকে সেই আগমনের খবর পৌঁছে দিতে। তবু মায়ের মন কি মানে! সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে সেই নবমী নিশির উপর। নারীর স্বামীগৃহে যাত্রার পাশাপাশি মায়ের চিরন্তন এই বেদনার কথা ‘গিরীশের রাণী’র বয়ানে তাঁর ‘বিজয়া দশমী’ কবিতায় ধরে রেখেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মনে পড়ে যায় একের পর এক শাক্ত পদাবলীর বিজয়া পর্যায়ের গানগুলি। সেখানেও সেই একই আর্তি যেন শব্দের মাঝে বসে পাথর হয়ে আছে! কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্যের লেখা একটি পদে পাই- “ওরে নবমীনিশি! না হৈও রে অবসান।/ শুনেছি দারুণ তুমি, না রাখ সতের মান।।/ খলের প্রধান যত, কে আছে তোমার মত, আপনি হইয়ে হত, বধ রে পরেরই প্রাণ।।” শুধু তো মেনকা নয়, বিসর্জনের ঢাকে কাঠি পড়লেই এই কাতর অনুরোধ এসে বসে আপামর বাঙালির কণ্ঠেও।
পিতৃপক্ষের অবসানে মহালয়ার ভোরে পূর্বপুরুষদের তর্পণ দিয়ে যে দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছিল, তারই ষষ্ঠীতে, বোধনের মাধ্যমে দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী রূপে প্রতিষ্ঠা। শরতের এই অকাল বোধনে, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর পূজা পেরিয়ে দশমীর দিন পূজার পরিসমাপ্তি। ঢাকের লয় আবাহন থেকে বিসর্জনের সুরে গড়ালেই দেবী আবার ফিরে যান তাঁর নিরাকার রূপে। তাই মাঝের কটা দিনই তাঁকে কন্যারূপে পাওয়া। আর দশমীতে সেই পেয়ে হারানোর বেদনায় ভারী হয়ে থাকা বুকে একে অপরকে জড়িয়ে নিয়ে কোলাকুলি, ভাগ করে নেওয়া কষ্টের মাঝে সিঁদুর খেলার আনন্দ, বড়োদের পা ছুঁয়ে প্রণাম আর মুখে তুলে দেওয়া মিষ্টির আস্বাদে মনে করে নেওয়া ‘আসছে বছর আবার হবে’। প্রতিমা জলে পড়লে একে অপরকে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানানো। কিন্তু কী এই বিজয়ার শুভেচ্ছার ইতিহাস? কেনই বা তা শুভ? শুধুমাত্র বাংলায় নয়, সারা ভারতবর্ষ জুড়ে পালিত ‘দশেরা’র প্রকৃত অর্থই বা কী? আবার আমাদের ফিরতে হয় পুরাণের দিকে।
দশমীকে ‘বিজয়া’ বলার পিছনের কারণ একটামাত্র নয়। পুরাণকথন অনুযায়ী, মহিষাসুর বধের যুদ্ধের সময় ন’দিন ন’রাত্রি দেবী, মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে শেষপর্যন্ত দশম দিনে তাঁর বিরুদ্ধে জয়ী হন। হৃত স্বর্গরাজ্য ফিরে পেয়ে স্বর্গ ও মর্ত্যে পালিত হয় বিজয়োৎসব। সেই ঘটনাকে মনে রেখেই দশমীর আগে ‘বিজয়া’ শব্দের প্রতিষ্ঠা। শ্রীশ্রীচন্ডীর কাহিনীতেও এই ঘটনারই সমর্থন পাই। আশ্বিনের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবীর আবির্ভাব ও শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর বধের কথা পাই সেখানে। দশমীর দিন উত্তর ও মধ্য ভারতে বিশেষভাবে উদাযাপিত হয় ‘দশেরা’। সংস্কৃত ‘দশহর’ শব্দটি থেকে ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি। বাল্মিকী রচিত রামায়ণের কাহিনীসূত্র অনুযায়ী, ত্রেতা যুগে অকাল বোধনে দেবীর আশীর্বাদ পেয়ে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমীতেই রাবণকে বধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন রামচন্দ্র। দশানন রাবণের সমাপ্তিসূচক দিনটিতে তাই উত্তর ও মধ্য ভারতের নানা স্থানে রাবণের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে রাবণ-দহনের মাধ্যমে ‘দশেরা’ পালন করা হয়। রাবণের পরাজয়ের আনন্দে পালিত বিজয়োৎসব আর নবরাত্রির শেষে অশুভ শক্তির বিনাশে, শুভ শক্তির বিজয়কে মাথায় রেখে তাই দশমীতে ‘শুভ বিজয়া’ বলা চলে। আবার মাইসোরে দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের কাহিনীকে মাথায় রেখেই দশেরা পালন করা হয়। আশ্বিনের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতেই হিমালয়দুহিতা, আমাদের ঘরের মেয়ে উমার কৈলাস যাত্রার সূত্রপাত ঘটে। পুজোর চার দিনের দিন দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন হলে দেবীকে প্রতিমার আধার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। বলা হয়, এবার তিনি তাঁর ইচ্ছামতো স্থানে গমন করতে পারেন, তবে অনুরোধ একটাই, শত্রুবিনাশের কাজ শেষ করে যেন দেবী আবার ফিরে আসেন তাঁর পিতৃগৃহে- “ওঁ গচ্ছ দেবি পরং স্থানং যত্র দেব নিরঞ্জনঃ। অস্মাকং তু সুখং দত্তা পুনরেস্যসি সর্বদা।। … ওঁ গচ্ছ ত্বং ভগবত্যম্ব স্বস্থানং পরমেশ্বরী। শত্রোদর্পবিনাশায় পুনরাগমনায় চঃ।।”
বিজয়ার বিসর্জনে দেবীকে তাই ত্যাগ নয়, আসলে তা বিশেষরূপে অর্জন। নয়নভুলানো রূপের চর্মচক্ষের বাইরে এবার তাঁকে ধরা যাবে শুধুমাত্র অনুভূতিতে। তাই যেন হৃদয়ের সেই অধিষ্ঠাত্রীকে মনে রেখে সমস্ত রাগ-ক্ষোভ-ঈর্ষা-অসূয়ার মতো ঋণাত্মক শক্তিদের দূরে সরিয়ে বিজয়ার কোলাকুলিতে প্রকৃত অর্থে মিলন মানুষের সঙ্গে মানুষের। রবীন্দ্রনাথের ‘ধর্ম’ বইটির ‘উৎসবের দিন’ প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে যায়- “আজ আমাদের কীসের উৎসব? শক্তির উৎসব। … জ্ঞানে প্রেমে কর্মে মানুষ যে অপরিমেয় শক্তিকে প্রকাশ করিয়াছে, আজ আমরা সেই শক্তির গৌরব স্মরণ করিয়া উৎসব করিব। আজ আমরা আপনাকে, ব্যক্তিবিশেষ নয়, কিন্তু মানুষ বলিয়া জানিয়া ধন্য হইব।” তাই বিজয়া সম্মিলনী।
ভাসানের আগে বরণের সময় দেবীর কানে কানে বলে দেওয়া হয়, ‘পরের বছর আবার এসো, মা!’। ঘরের মেয়েকে বিদায় দেবার এই বিষাদগাথার সুরটিকে দীনেন্দ্রকুমার রায় তাঁর ‘পল্লীচিত্র’-এর ‘দুর্গোৎসব’ রচনায় ধরে রেখেছেন- “আজ দশমীর এই বিষাদাপ্লুত প্রভাতে সানাইয়ের আর বিরাম নাই; সে শুধু কাঁদিয়া কাঁদিয়া বিরহগাথা গাহিয়া যাইতেছে। … তিন দিনের উৎসব যে নিমিষের মধ্যে শেষ হইয়া গেল, তাই পিতামাতার চক্ষে জল ও বক্ষে দুর্বহভার।” সেই চিরন্তন ‘যেতে নাহি দিব’-র কান্না । তবুও তো যেতে দিতে হয়। মেয়ের ‘যাত্রা করা’, বরণ ও ভাসান শেষ হলে একে অপরের মুখে তুলে দেওয়া মিষ্টি, যাতে মিশে যায় পরবর্তী দীর্ঘ অপেক্ষার রেশ। যে পথে দুর্গা বেরোবেন, সেই পদচিহ্ন ধরেই আলপনার পথ বেয়ে ফিরে আসবেন লক্ষ্মী। আশ্বিন পেরিয়ে কার্তিকে পড়বে শুক্ল চাঁদের জ্যোৎস্না। নুয়ে পড়া ধানের বুকে জমে উঠবে দুধ, হিম নামবে, ‘অক্ষয় মালবেরি’র ছেলেটি লণ্ঠন নিয়ে বড়পুকরের ঘাটে গিয়ে দেখবে, জলে ডোবা ঘাটের পইঠায় নিথর হয়ে কেমন স্নিগ্ধ সেঁটে থাকে শামুকেরা । কার্তিকের ভরে ওঠা ধানের গোলার পাশ দিয়ে গৃহস্থীর আঁকা আলপনায় পা ফেলে আমাদের রূপ, জয়, যশ প্রাপ্তির প্রার্থনাকে সত্যি করে ঘরে এসে উঠবেন ঐশ্বর্যের দেবী। আবারও মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের লেখা ‘সুপুরিবনের সারি’ বইয়ের ফুলমামিমার কথা, এমনই এক বিজয়া শেষের ভোরে যিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন আর বোকা নীলু বিশ্বাস করেছিল, “যেন লক্ষ্মীপুজোর দিন ওই পায়ের চিহ্ন ধরে ধরে ঘরে ফিরে আসছে ফুলমামি, তার নিজের ঘরে।”
বিজয়া পেরিয়ে শুধু দেবী দুর্গার নয়, প্রবাস থেকে আসা প্রতিটা মানুষেরও তাড়া পড়ে নিজের ঘরে ফেরার। আগেকার দিনে যেমন নদীর ঘাটে ঘাটে জমে উঠত বাক্স প্যাঁটরা, বর্তমানে দাম বাড়ে ফ্লাইটের, ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্স’ মেনে ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে সেরে নেওয়া যায় ভার্চুয়াল কোলাকুলি। মহামারীর দেশে বয়স যত বাড়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের মানুষ ফুরোয় দ্রুত। তারই মধ্যে যতটা কাছে যাওয়া যায় আর কী! তারপর একাদশী বা দ্বাদশীর দিন সেই ‘যাত্রা করা’, বচ্ছরকার জমানো ছুটি খরচা করে ফেরা নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে, নিজের নিজের ঘরে, যাকে যেখানে মানায়। ফিরতে তো হয়ই, শুধু আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে বসে থাকা নাছোড় এক নীলু অবিরাম শুধু বলে চলে – “শেষ? হ্যাঁ, শেষ। প্রণাম তোমায়, শেষ। প্রণাম তোমায়, ওই দ্বাদশীর বিকেল। প্রণাম, ওই খালের মুখে নদীর জলের ঢেউ। প্রণাম তোমায় তুলসীতলা, মঠ। প্রণাম ফুলমামি। প্রণাম, তবে প্রণাম তোমায় সুপুরিবনের সারি।”
তথ্যসূত্রঃ
১। ‘রচনাসংগ্রহ’, দীনেন্দ্রকুমার রায়
২। ‘সুপুরিবনের সারি’, শঙ্খ ঘোষ
৩। https://www.tagoreweb.in/Essays/dharma-85/utsaber-din-828
৪। https://www.deshrupantor.com/editorial-news/2019/10/08/172597