রাধাকৃষ্ণর দোলের সঙ্গে ওঠে-নামে সূর্য ও চাঁদ, কলকাতার এই বনেদিবাড়ির ঝুলন আজও অনন্য

৬৩, ধীরেন ধর সরণির এই বাড়িটি ঝুলনের যাত্রাপথে ৮০ বছর পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েকবছর আগেই। প্রথম শুরু ১৯৩৫ সালে, বাড়ির বারান্দায় কিছু পুতুল সাজিয়ে।

ঝুলনের শেষ দিন, শ্রাবণী পূর্ণিমা। শ্রীকৃষ্ণর দ্বাদশযাত্রাপথের যে উৎসবগুলি আমাদের বঙ্গসংস্কৃতির অঙ্গ, তার মধ্যে ঝুলন সবচেয়ে বর্ণময় উৎসব। খুব সংক্ষেপে 'ঝুলন' কী, তা বলতে গেলে লিখতে হয় শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকার বয়ঃসন্ধির সঙ্গে সঙ্গে কুঞ্জবনে গোপীরা মিলিত হয়ে তাঁরা যে প্রেমলীলার সাধনা করেছিলেন, তাই পরবর্তীকালে ঝুলন নামে পরিচিত হয় জনসমক্ষে।

শ্রাবণ মাসের অমাবস্যার পরের একাদশীতে আরম্ভ হয়ে পরপর টানা পাঁচদিন ধরে চলে, রাধাকৃষ্ণের এই বৈচিত্র্য যাপনের পর্ব। দুর্গাপুজোর আগে এবং দোলযাত্রার পর বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে ঝুলন ছিল একটা সময় সবচেয়ে বড় উৎসব। এখন এই উৎসব কয়েকটি বিশেষ স্থান ছাড়া শুধুই নিয়মরক্ষার খাতিরে পালন করা হয়। তবু, যে-সমস্ত পরিবার বৈষ্ণব মতাদর্শে বিশ্বাসী, তাদের কাছে ঝুলন আজও একটি তিথি।

এই পাঁচ দিনের প্রতিটি দিনে শ্রীকৃষ্ণকে নব বেশে, নব ভঙ্গিমায় সাজিয়ে প্রদর্শন করা হয় ভক্তকুলের সামনে। তবে, ঝুলনে ভক্তের সারিতে একদম প্রথমেই যিনি অধিষ্ঠিত হন, তিনি শ্রীরাধিকা। বর্ষাশেষের এই উৎসবে শ্রীকৃষ্ণ বিরাজিত হন প্রকৃতিরূপে জগতের মাঝে, যেখানে রাধা ভক্তরূপে চেয়ে থাকেন প্রকৃতির দিকেই। সেই কারণেই প্রকৃতির মূল শক্তির উৎস সূর্যের উদয় ও অস্তাচলের গতিবিধিকে মাথায় রেখে রাধাকৃষ্ণের দোলনাটিও দুলতে থাকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে।

আরও পড়ুন: ভেসে এল দুটো পাথর, স্বপ্নাদেশে তাই হলো রাধা-কৃষ্ণর মূর্তি! গঙ্গার ঘাটগুলোতে লুকিয়ে যে ইতিহাস

এমনই প্রাকৃতিক দোলাচলকে কৃত্রিম উপায়ে প্রদর্শন করে কীভাবে ঝুলনের মূল আকর্ষণ তৈরি করতে হয়, আজ তার গল্পই বলা হবে। বনেদি কলকাতার রঙ্গ-সংস্কৃতি বরাবরই বর্ণময়। আর ঝুলন এলে বাঙালি মনের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে পরতে পরতে। কলকাতার বেশ কয়েকটি প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ বাড়িতে, আজও ঝুলন উৎসব বেশ রমরমিয়ে পালিত হয়, যাঁর মধ্যে মধ্য কলকাতার বউবাজারকে বলা যেতে পারে ঝুলন উৎসবের পীঠস্থান। এই অঞ্চলের এক-একটি বাড়ির ঝুলন অনন্য ধাঁচে পরিবেশিত হয় সকলের কাছে।

Chnad Surjo Bari

বৈষ্ণব মতাদর্শে বিশ্বাসী বাড়িগুলিতে আজও ঝুলন একটি জরুরি তিথি

এর মধ্যে আবার 'চাঁদ-সূর্য বাড়ির ঝুলন যাত্রা' একেবারেই ভিন্নমাত্রার। ৬৩, ধীরেন ধর সরণির এই বাড়িটি ঝুলনের যাত্রাপথে ৮০ বছর পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েকবছর আগেই। প্রথম শুরু ১৯৩৫ সালে, বাড়ির বারান্দায় কিছু পুতুল সাজিয়ে। এর ঠিক বছরতিনেকের মধ্যেই ছেলে চন্দন পণ্ডিতের পুতুল সাজানো দেখতে দেখতেই নতুন ভাবনা মাথায় আসে শ্রীমন্ত ভিলার ঝুলন উৎসবের সূচক শ্রীমন্ত পণ্ডিতের। সেই ভাবনার ভরে পা দিয়ে তিনি নিয়ে আসেন এক বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র, যার সাহায্যে পর্দায় আলো ফেলে দেখাতে শুরু করেন সূর্যোদয় ও চন্দ্রোদয়। যে মঞ্চে শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধিকা প্রেমের দোলায় মত্ত, সেই মঞ্চেই এমন এক বিচিত্র পটভূমির দৃশ্যায়ন রচনা করে মহাজাগতিক বিস্ময়কে একেবারে বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করান তিনি। শ্রীমন্ত পণ্ডিতের সৃষ্ট এই কৃত্রিম মহাকাশে পূর্বদিকে যখন রাধা-কৃষ্ণ দোলেন, তখন দেখা যায় সূর্যোদয় আর যখন দোলেন পশ্চিমে, তখন সূর্য ধীরে ধীরে অস্তমিত হয়ে ভরে যায় চাঁদের আলোয়। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি রাতের আকাশে জেগে ওঠা গ্রহ ও নক্ষত্ররাও চাঁদের সঙ্গে সহাবস্থান করে একই পটভূমিজুড়ে। 

Chnad Surya Bari

চাঁদ-সূর্য বাড়ি সেজে ওঠে ঝুলন এলেই

এ চিত্র শুধু বিরল নয়, এমন এক দৃষ্টান্ত বিজ্ঞান ও ধর্মের সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটায় বৈষ্ণবীয় ধর্মরীতি উদযাপনের মাধ্যমে। সঙ্গে ছেয়ে থাকে সমগ্র বাড়িজুড়ে বিভিন্ন পুতুল, যার মাধ্যমে রামায়ণ ও মহাভারতের চিরাচরিত গল্প বলা হয় আলো-আঁধারির খেলায়।

আজ যেমন ঝুলনের শেষ দিন, তেমনই আজ রাখি উৎসব। রাধাকৃষ্ণর প্রেমবন্ধনের পাশাপাশি আজ ভাইবোনেরও এক সুতোয় স্নেহবন্ধনের দিন। পৌরাণিক কাহিনি থেকে জানা যায়, আজকের দিনে মা যশোদা পুত্রের কল্যাণে শ্রীকৃষ্ণের হাতে রাখি পরিয়ে দিতেন। কালভেদে এই রক্ষার সুতোবন্ধন নারীর‌ মাধ্যমে পুরুষের হাতে রক্ষার কবচ হয়ে এসেছে যুগে যুগে। 

আবার এই দিনই কবিগুরুর আদর্শে গড়ে ওঠা, বঙ্গজাতির রক্ষা-বন্ধনের দিন। পৌরাণিক রাখিবন্ধন প্রথারই একটি বৃহত্তর রূপ রবি ঠাকুর পুনঃপ্রতিস্থাপন করেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে, যার আক্ষরিক নাম 'রক্ষা-বন্ধন'। এই রক্ষা-বন্ধনের উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি, এই উদ্দেশ্য নিয়েই যাতে বাংলার মানুষ, সমস্ত বিপদ, বাধা, বিভেদ থেকে রক্ষা করতে পারে নিজেদের এক সূত্রে গেঁথে। সেই উদ্দেশ্যেই ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গ-নাগরিকরা একে অন্যের হাতে পরিয়ে দেন সম্প্রীতির হলুদ সুতো। এই একই বৃন্তের ভ্রাতৃত্ব রক্ষার তাগিদে রবি ঠাকুর নিজেও নাখোদা মসজিদের ভেতর প্রবেশ করেন, সহস্তে মৌলবিদের রাখি পরাতে। রবি ঠাকুরের আদর্শে গড়া এই রক্ষা-বন্ধন উৎসবের সঙ্গে কোনও ধর্মীয় রীতিনীতির যোগ ছিল না, ছিল না পারিবারিক ভাইবোনের মিলনসূত্রও, বরং ধর্মীয় রীতিনীতির অন্ধত্বর ঊর্ধ্বে মনুষ‍্যত্বর সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এই উৎসবের মূল লক্ষ্য। আমরা আজ সেই লক্ষ্যে স্থির থেকে জীবনের জয়যাত্রায় হয়তো একই সঙ্গে "বাংলার মাটি বাংলার জল" গাইতে পারিনি সবক্ষেত্রে। তবে ভারতের জাতি-ধর্ম-সংসার-সংস্কৃতি কোনও এক মোহবন্ধনে, সেই অদেখা রক্ষাকবচের অদৃশ্য সুতোয় প্রতিবারই নিজেদের জড়িয়ে ফেলে নতুন করে।

More Articles