'পরমাণু বিস্ফোরণকে ক্রমে ভবিতব্য ভাবতে শুরু করেছে আম-মানুষ'

Christopher Nolan: আপনি পরমাণু অস্ত্র নিয়ে যত ভাববেন, তত সেগুলিকে আপনার অত্যন্ত সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র বলে মনে হবে। খোলামেলা কথাবার্তায় পরিচালক নোলান। সাক্ষাৎকার পড়ুন তর্জমায়।

ওই একটি ঘটনা বদলে দিয়েছিল সভ্যতার ইতিহাস। বিশ্বের ইতিহাসের কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে মোটা অক্ষরে লেখা রইল পরমাণু বোমার আবিষ্কার ও তার সফল প্রয়োগ। সেই দায় যত না রাষ্ট্রের, তার চেয়েও বেশি গিয়ে বর্তাল বিজ্ঞানীদের কাঁধে। সমস্ত সর্বনাশা গুণ নিয়ে পৃথিবীর সামনে প্রকট হল এমন এক অস্ত্র, যা গোটা দুনিয়ার সমস্ত সমীকরণ এপাশ ওপাশ করে দিতে পারে। বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীদের দিনভরের পরিশ্রম, মস্তিষ্কের ক্ষয় এমন এক আবিষ্কারের জন্ম দিল, যা আদপেও কল্যাণকর নয়। বরং বিশ্বকে দাঁড় করিয়ে দিল পরমাণু বোমার এক নিকষ আতঙ্কের সামনে। সম্প্রতি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ক্রিস্টোফার নোলানের নতুন সিনেমা 'ওপেনহাইমার'। এই সিনেমা ছুঁয়ে গেছে পরমাণু বোমার তথাকথিত 'জনক' জে. রবার্ট ওপেনহাইমারের জীবন আর পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়কে। এতগুলো বছর পর কেন তুললেন এমন একটি বিষয় নোলান? পরমাণু বোমার ভয় কি আজও আমাদের তাড়া করে বেড়ায়? নাকি পরমাণু বোমার বিপদকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে মুছে ফেলা হয়েছে? নোলান ভয় পান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো ঘটনা তাঁকে উদ্বিগ্ন করে। ‘ওপেনহাইমার’ বানানোর পিছনে আছে নোলানের বিস্তারিত রাজনৈতিক মতামত। ওপেনহাইমারের জীবনের গল্প হয়ে ওঠে মানুষের নিজের ভিতরের বিস্ফোরণের কাহিনি। সেই বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর ইতিহাসে। তিনি যেন ভবিষ্যৎ দেখতে পান। তিনি পরমাণু বোমার ‘ট্রিনিটি টেস্ট’-কে দেখানোর ক্ষেত্রে কোনো কম্পিউটার গ্রাফিক্সের ব্যবহার করেন না। সেই আপত্তি কি শুধু সিনেম্যাটিক নাকি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য? কীভাবে বিজ্ঞানের সঙ্গে তিনি সিনেমাকে মিলিয়ে নেন? সম্প্রতি ‘বুলেটিন’ পত্রিকার জুলাই সংখ্যায় বিখ্যাত সাংবাদিক জন মেকলিনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় বসেছিলেন ক্রিস্টোফার নোলান। সেখানে শুধু ‘ওপেনহাইমার’-ই নয়, পৃথিবীর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অকপট বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি। ঠিক কী কী বললেন নোলান? পড়ুন সেই সাক্ষাৎকারের অনুবাদ।

আরও পড়ুন: সত্যিই কি ওপেনহাইমার শতাব্দীর সেরা সিনেমা? নাকি…

জন মেকলিন : পারমাণবিক অস্ত্রের মতো বিষয় নিয়ে মানুষ সাধারণত কথা বলতে চায় না। ফলে প্রথমেই জানতে চাইব ওপেনহাইমারকে নিয়ে সিনেমা বানানোর ইচ্ছে কেন হল? এটা তো ‘ব্যাটম্যান’ বা অন্য সিনেমাগুলোর মতো নয়।

ক্রিস্টোফার নোলান : তা নয়। তবে এই বিষয়টা বহু বছর ধরেই, মোটামুটি আশির দশক থেকেই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তখন আমি ইংল্যান্ডের এক সদ্য কিশোর। সিএনডি বা পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে দ্য গ্রিনহ্যাম কমনের আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ওই ১২-১৪ বছর বয়স নাগাদ আমাদের সবচেয়ে বড়ো ভয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল পরমাণু যুদ্ধ। সম্ভবত সেই সূত্রেই 'ওপেনহাইমার' নামটার সঙ্গে পরিচয়। রাশিয়ানদের নিয়ে স্ট্রিং-এর একটা গানে ওপেনহাইমার আর তাঁর 'মারাত্মক খেলনা'গুলির কথা ছিল। আমরা তাঁর ব্যাপারে তেমন না-জানলেও ততদিনে তিনি পপ-কালচারের একটা অংশ হয়ে উঠেছেন।
পরে জানা গিয়েছিল, লস আলামোসের বিজ্ঞানীরা নাকি একরকম নিশ্চিত ছিলেন এই ট্রিনিটি টেস্টের ফলে সমগ্র বায়ুমণ্ডলে আগুন ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আর তার ফলে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে গোটা পৃথিবী। অঙ্ক বা থিয়োরির দিক থেকে এই সম্ভাবনাগুলিকে তাঁরা সম্পূর্ণ ছেঁটে ফেলতে পারেননি। তবু তাঁরা কাজটি করলেন। আমার মনে হয় এর থেকে বড়ো নাটকীয় পরিস্থিতি পৃথিবীর ইতিহাসে আর আসেনি। বিশ্বের ইতিহাসে কাউকে বোধহয় কখনও এত বড় দায়িত্বের মুখোমুখি হতে হয়নি।
আমার আগের সিনেমা 'টেনেট'-এর একটি সংলাপে ওপেনহাইমারের পরিস্থিতির মতো হুবহু একটি বিষয়ের ইঙ্গিত আছে। ‘টেনেট’ যদিও কল্পবিজ্ঞানের সিনেমা, তবুও অতীতের ঘটনাকে কি ফিরিয়ে আনা যায়- এই প্রশ্নটা এসেছে সেখানে। টুথপেস্ট একবার বের করে নিলে তাকে কি আবার টিউবে ফেরানো যায়? জ্ঞান যদি একবার ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। অতীতে ফিরে গিয়েও তাকে আর ঠিক করা সম্ভব নয়। 

এই প্রশ্নটার কোনও উত্তর ‘টেনেট’-এ নেই। কল্পবিজ্ঞানের মতো করে হলেও সিনেমা শেষ হওয়ার পরে প্রশ্নটা আপনাকে ভাবাবে। রবার্ট প্যাটিনসন (‘টেনেট’-এর অভিনেতা) আমাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ওপেনহাইমারের দেওয়া বক্তৃতার একটা সংকলন উপহার দিয়েছিলেন। সেগুলো পড়ে এবং তারপর পঞ্চাশের দশকের সেরা সেরা মানুষদের কর্মকাণ্ড পড়ে মাথার মধ্যে একটা চিন্তা ক্রমশ দানা বাঁধছিল। মনে হল, এটা আমাদের জীবন, আমাদের অস্তিত্বের উপর নেমে আসা প্রথম সঙ্কট। শুধু ব্যক্তি নয়, সারা পৃথিবীর অস্তিত্বের উপর নেমে আসা প্রথম সঙ্কট। প্রথমবার এই ঘটনাগুলো পড়লে রীতিমত ভয় করে। দশকের পর দশক ধরে এই সঙ্কটকে আমরা নীতিকথা, ভারি ভারি দার্শনিক কথাবার্তা, সরকারি স্তোকবাক্য দিয়ে ঢেকে রেখে এসেছি। ফলে আমাদের আগের প্রজন্ম, যাঁরা আমাদের বাইবেলের ভালো-খারাপের যুদ্ধের কথা শুধুমাত্র গল্পের মতো করে বলে এসেছেন , তাঁরা আসলে আমাদের ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছে। বা হয়তো আমরা যে একটা ভয়ানক বোমার ছায়ায় বাস করছি, এই ব্যাপারটা একটা সাদামাটা ঘটনা হয়ে যাক, এমনটাই চেয়ে এসেছে তাঁরা। একমাত্র ‘বুলেটিন’ পত্রিকার ‘ডুমস-ডে ঘড়ি’ আমাদের সেই ভয়ানক ভবিষ্যৎ ভুলতে দিত না।
আমি কোনো 'মেসেজ' দেওয়ার জন্য সিনেমা বানাই না। আমি সিনেমা বানাই একটা গল্পকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। যদিও এই গল্প বলতে গিয়ে আমাকে পরমাণু বোমার কিছু বেসিক বিষয়, সরকারি পলিসি, কিছু মানুষের জীবনদর্শন বা ওই সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার কথা বলতে হয়েছে। আমি সেই ভয়ানক শক্তি, তার উৎস আর আগুন নিয়ে যে মানুষগুলো খেলা করছে, তাঁদের উদ্দেশ্যটা খুঁজতে চেয়েছি?

মেকলিন : তাহলে তো এটা দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা! আমি যতদূর জানি ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’ বইয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে সিনেমাটি। ৭০০ পাতার এই আর এর মধ্যে বহু ঘটনা তুলে ধরা আছে। সেই বই থেকে চিত্রনাট্য ও তারপরে সিনেমা তৈরি করার পুরো প্রক্রিয়াটা সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন।

নোলান : ‘ওপেনহাইমারের জীবন আর জীবনদর্শনকে দারুণভাবে ধরেছে আমেরিকান প্রমিথিউস’। বাস্তব জীবন, তার ইতিহাসকে সিনেমার নাটকীয় বিনোদনের মধ্যে ধরতে গিয়ে আমি বারবার বিস্মিত হয়েছি। পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে বাধা পেয়েছি। আমি তো বিজ্ঞানী নই। আমি যদি ওই সময়ের বিজ্ঞানী হতাম, তাহলে হয়তো চিত্রনাট্যটা লিখতে সুবিধা হত। ফলে আমাকে অনেক বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে হয়েছে।
আগেও 'ইনটারস্টেলার' বা 'টেনেট' বানানোর সময় আমি কিপ থর্নের (নোবেলজয়ী পদার্থবিদ) সঙ্গে কাজ করেছি। কাই বার্ড ও মার্টি শেরউইনরা (বিশেষ করে মার্টি শেরউইনের ২৫ বছরের দীর্ঘ গবেষণার ফসল এই গ্রন্থ) অমানুষিক পরিশ্রম করে প্রচুর প্রামাণ্য তথ্য দিয়ে ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’ বইটি লিখেছেন। ইতিহাসের প্রতিটি পাতাকে তাঁরা উল্টেপাল্টে দেখেছেন। ভালো দিক এটাই যে বইয়ের শেষে প্রচুর রেফারেন্স আছে। পড়তে পড়তে আপনার মনে হতেই পারে, “আচ্ছা, এই এডওয়ার্ড টেলর লোকটা কে ছিলেন?” তখন আপনি অনায়াসে তালিকা থেকে তাঁর ব্যাপারে জেনে নিতে পারবেন। আমি চেয়েছিলাম গল্পটা ওপেনহাইমারের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে বলতে। কাই আর মার্টিনের বইতে ঠিক তাই ছিল। আমি বুঝতে চেয়েছিলাম আসলে ঠিক কেমন ছিলেন ওপেনহাইমার, তাঁর চিন্তার পদ্ধতি কেমন ছিল? আর সেই ভাবনাকেই আমি সিনেমায় রূপ দিতে চেয়েছি।

মেকলিন : তাঁকে বোঝা কিন্তু বেশ মুশকিল। মানে ওরকম দুর্বোধ্য, দ্বিচারী একজন মানুষ। এমন একটা চরিত্রকে পর্দায় তুলে ধরতে কতটা আনন্দ পেয়েছিলেন?

নোলান : আপনি যদি আমার তৈরি ছবির তালিকা দেখেন, তাহলে বুঝবেন এমন দুর্বোধ্য, অবিশ্বাসযোগ্য মানুষ, যাদের চরিত্রে বহু স্তর আছে, তাঁদের কথাই আমি বারবার বলে এসেছি। ব্যাটম্যানের ব্রুস ওয়েনের কথাই যদি বলি, তাহলে এই চরিত্রটা নিয়ে আমি আগ্রহী হয়েছিলাম, কারণ এর মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব আছে, একটি বিরোধাভাস আছে। আমি এই ধরনের চরিত্রেই স্বচ্ছন্দবোধ করি। ওপেনহাইমারের ক্ষেত্রে সুবিধা ছিল যে গল্পটা বাস্তব, প্রচুর তথ্য আছে, ইতিহাসটাও জানা। ফলে দর্শককে গল্পের মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়াটা সহজ। কিন্তু আমি যেভাবে ভেবেছি এবং অবশ্যই কিলিয়ান যেভাবে চরিত্রটা ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁর মাথায় যা ঘুরেছে, সেটাকেই আমরা তুলে ধরতে চেয়েছি। তার জন্য ওপেনহাইমারের কাজকর্ম, সারা জীবনে কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন তিনি, সেইসব জায়গার অভিজ্ঞতা- এমন অজস্র বিষয়ে আরও পড়াশোনা করতে হয়েছে আমাদের। তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে।

মেকলিন : ওপেনহাইমারের জীবনী প্রায় খোলা পাতার মতো। নানা জন তাঁকে নিয়ে নানা মতামত দিয়েছেন। কেউ মনে করেন তিনি কমিউনিস্ট, কেউ আবার মনে করেন সে কথা ভুল। জানতে চাইব, ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

নোলান : Rorschach test বলতে যা বোঝায়, ওপেনহাইমার ঠিক যেন তাই। এই সিনেমায় আমেরিকার দুর্দান্ত ভূমিকা এবং একই সঙ্গে তার নৃশংস রূপটা দেখতে পাবেন। এটা প্রবলভাবে আমেরিকার গল্প। ফলে এই প্রশ্নগুলোর কোনও একতরফা উত্তর হয় না। যদি কেউ একতরফা উত্তর ধরে বসে থাকেন, তাহলে বলব এই ছবিটিকে সেই আলোচনা থেকে দূরে রাখাই শ্রেয়। 


মেকলিন : সিনেমার বেশ কিছু জায়গায় পদার্থবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এমনিতেও পদার্থবিদেরা তথ্যের খুঁটিনাটি ব্যাপারে যথেষ্ট খুঁতখুঁতে হন। চিত্রনাট্য লেখার সময় কি আপনি পদার্থবিদের পরামর্শ নিয়ে কাজটা এগিয়েছিলেন?

নোলান : হ্যাঁ। সিনেমার সেটে বিজ্ঞানকেন্দ্রীক সমস্ত সাহায্য় করেছেন UCLA (ইউনিভর্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলস)-র এক তরুণ গবেষক ডেভিড সালজ্‌বার্গ। কিপ থর্ন-কেও আমরা এই ছবিতে নিয়ে এসেছিলাম। আগেও ওঁর সঙ্গে আগে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। প্রিন্সটনের মতো বেশ কিছু বিখ্যাত কলেজে পড়াশোনা করেছেন কিপ। সবচেয়ে বড় কথা, ওপেনহাইমারকে নিজের চোখে দেখেছেন কিপ। প্রিন্সটনের ‘ইন্সটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ’-এ পড়াকালীন ওপেনহাইমারের একটি সেমিনারে অংশ নেন তিনি।  ওপেনহাইমারের সঙ্গে দেখাও করেন কিপ। কিপের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন চরিত্রাভিনেতা কিলিয়ান। তাছাড়া সেটে এসেও সেই সব অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছেন কিপ। কীভাবে ওপেনহাইমার সেমিনারের সকলের মনোযোগ ধরে রাখতেন, কীভাবে বিতর্কের আয়োজন করতেন, কীভাবে উনি প্রায় সকলের মতামত শুনে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তার পরিষ্কার উত্তর দিতেন, সেই সমস্ত গল্পই শোনা যেত কিপের মুখে। 

কিপের মুখেই শুনেছিলাম, একবার দুই নোবেলজয়ী পদার্থবিদ লুইজ আলভারেজ ও আর্নেস্ট লরেন্স ওপেনহাইমারের সাথে জার্মানিতে বসে পরমাণু বিভাজনের খবর পড়ছিলেন। কিন্তু ওপেনহাইমারের মনে হয়েছিল যে এটা অসম্ভব একটা কাজ। বোর্ডে সেটা ব্যাখাও করলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রশ্ন ছিল, বোর্ডে কী লিখেছিলেন তিনি? কিপ তাঁর উত্তর বোর্ডে লিখে জানালেন যে সম্ভবত তিনি এই উত্তরটাই করেছিলেন এবং এই এই জায়গায় তিনি ভুল করেছিলেন।

মেকলিন : এটা তো দারুণ ব্যাপার! এই প্রথম নয়, আগেও আমরা দেখেছি যে আপনি সাধারণ দর্শকের সামনে কোয়ান্টাম মেকানিকসের মতো কঠিন সব বিষয়  নিয়ে দারুণ একটা গল্প বলতে পারেন। এটা কীভাবে করেন?

নোলান : এটাকে আপনি অভ্যাসের ফল বলতে পারেন। আমি এর আগের কয়েকটি সিনেমায় পদার্থবিদ্যার বেশ কিছু কঠিন দিককে নাটকীয়ভাবে ধরতে চেয়েছি। আসলে ১৯২০ সালের পরবর্তী সময়ে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের জগতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, তার ইতিহাসের সঙ্গে মানবসভ্যতার নাটকীয় পট পরিবর্তনকে মিলিয়ে দেখুন। আসলে সময়টাই বদলের। পিকাসো বা অন্যান্য অনেক শিল্পীই , এসময় নতুন কিছু করতে চাইছেন। চাইছেন শিল্পের নন্দনতত্ত্বে বিপ্লব আনতে। আপনার দেখার আঙ্গিককে সম্পূর্ণ বদলে দিতে। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই বলতে হয় মার্ক্সের কথা, কমিউনিজমের কথা। মার্ক্সের পথ ধরে ১৯২০-র দশকে এলেন কমিউনিস্টরা, এল রাশিয়ার বিপ্লব। অর্থাৎ জীবন ও প্রকৃতির সমস্ত নিয়মনীতিকে নতুন করে লিখতে চাওয়ার একটা তাগিদ চলতে লাগল গোটা দুনিয়া জুড়ে। আর এই সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যে সবচেয়ে র‍্যাডিকাল ছিল বোধহয় পদার্থবিদ্যা। মনে রাখতে হবে যে চিরাচরিত পদার্থবিদ্যা আর কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার মধ্যে যে তফাৎ, তা কিন্তু নাটকীয় সব উপাদানে ভরা।

এই পার্থক্যটা হয়তো আমি দর্শককে বোঝাতে পারব না, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব আমাদের ঠিক কোথায় নিয়ে যাবে, সেটাও বোঝানো কঠিন। নিজেও যে সমস্তটা বুঝি তা নয়! কিন্তু আইনস্টাইনের নাম সকলেই জানে, এটাও জানে আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব বিশ্বকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল। আমি ওপেনহাইমারকে ইতিহাসের সেই সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ সময়টাতে বসিয়ে দেখতে চেয়েছি, যেখানে আক্ষরিক অর্থেই মহাবিশ্বের নিয়মগুলোকে সম্পূর্ণ নতুন চোখে দেখে তাকে বদলে দেওয়ার যজ্ঞ চলছিল সারা দুনিয়া জুড়ে। শুধু পদার্থবিদ্যা বা রসায়নের বিক্রিয়া নয়, একই সঙ্গে এ সময়টা বিক্রিয়া চলছিল রাজনীতির আঙিনাতেও। অস্ত্রযুদ্ধের ময়দানে পরমাণু বোমা ও হাইড্রোজেন বোমা ঘিরে যে দ্বন্দ্ব, রাজনীতি, এই দ্বন্দ্ব শুধু বিজ্ঞানের নিজস্ব বিক্রিয়াগত দ্বন্দ্ব নয়, মানুষের চিরকালীন চরিত্রের বহুমুখী দ্বন্দ্ব। যেহেতু পারমাণবিক বোমা বা হাইড্রোজেন বোমার বিষয়েই জানে মানুষ, তাই আমি সেই সাধারণ ধারণাকেই জনপ্রিয়তার মোড়কে জড়িয়ে চিত্রনাট্য লিখেছি। আমরা যখন কিপের সাথে ইনটারস্টেলার-এ কাজ করছিলাম, তখনই মনে হয়েছিল বিজ্ঞান নিজে নাটক পছন্দ করে। তার নিজের মধ্যেও অসংখ্য নাটকীয় উপাদান রয়েছে। বিজ্ঞানের তত্ত্বের এই নাটকীয়তার মধ্যে একটা ভয়ানক ধ্বংসের বার্তা, সারা পৃথিবীকে নিমেষে ধ্বংস করে দেওয়ার অজস্র সম্ভাবনা রয়েছে। বিজ্ঞানের পথকে অনুসরণ করলে আপনি অনায়াসে সেই বিধ্বংসী নাটককে খুব কাছ থেকে দেখতে পারেন। একজন পরিচালক হিসেবে আমি সেই পথেই হাঁটতে চেয়েছি।

মেকলিন : পারমাণবিক অস্ত্রের যে সর্বক্ষয়ী শক্তি, তা থেকে আমরা ধীরে ধীরে দূরে চলে এসেছি। যে বোমা সারা পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে পারে, অধিকাংশ মানুষ তার ব্যাপারে আসলে কতটুকু জানেন? পরমাণু বোমা কী, কীভাবে কাজ করে, তার আকার  কিছুই তাঁরা জানেন না। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনি ট্রিনিটি টেস্ট বা অন্যান্য পারমাণবিক বিস্ফোরণকে সিনেমায় তুলে ধরেছেন। তার গুরুত্ব কতখানি? এই দৃশ্যটিকে এভাবে দেখাবেন, এই ভাবনা কীভাবে মাথায় এল?

নোলান : এমা থোমাসের (সহ-প্রযোজক) পর প্রথম যে মানুষটিকে আমি সিনেমার চিত্রনাট্যটি দেখাই, তিনি হলেন অ্যান্ড্রু জ্যাকসন। আমার আগের বেশ কয়েকটি সিনেমার ভিস্যুয়াল এফেক্টস বিভাগের সুপারভাইজার ছিলেন অ্যান্ড্রু। আমি তাঁকে শুরুতেই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যে এই সিনেমায় আমরা চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিস্ফোরণকে ধরতে চাইছি। পরমাণুর দুনিয়া এবং তার কার্যকলাপকে অন্য একটা মাত্রায় পৌঁছে দিতে চাইছি। অবশ্যই সেটাকে পর্দায় তুলে ধরা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। যার ফলে আমাদের সেই কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মনমাতানো দুনিয়ারই দ্বারস্থ হতে হবে। কিন্তু আমি কোনও কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহার করব না। আমরা ট্রিনিটি টেস্ট দেখাব, তার ভয়াবহ শক্তিকে দেখাব। কিন্তু আবারও বলছি, আমি কোনও কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহার করব না। এর আগে আমার অন্য একটা সিনেমায় আমরা কম্পিউটার গ্রাফিক্স দিয়ে পরমাণু বিস্ফোরণ দেখিয়েছি। গোটা টিম সেটা দারুণ ভাবে রূপায়ণও করেছিল। সিনেমাতেও তা দেখতে অসাধারণ লেগেছিল। যদিও আমার মনে হয়েছিল যে এই কম্পিউটার গ্রাফিক্সের ব্যবহারটা দেখতে ঠিক স্বতঃস্ফূর্ত নয়, মানে দর্শকের অবচেতনে চলতে থাকে যে এটা তো অ্যানিমেশন, এটা সত্যি নয়। বাস্তব দুনিয়ায় এই জিনিস হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। ফলে তার যে বিপদ, সেটা তারা টেরই পাবেন না। ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’ সিনেমায় যখন বিস্ফোরণটা দেখানো হয়েছিল, তখন সেটা ঘটেছে শহর থেকে বহু দূরে, সমুদ্রের মধ্যে। ওখানে আমরা বোঝাতে চেয়েছিলাম যে এটার বিপদ কেটে গেছে।
ট্রিনিটি টেস্টের পরমাণু বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখানোর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল আপনার মনে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা। সুন্দর, কিন্তু ভয়ংকর। এই দৃশ্যটা সত্যিকারে ক্যামেরাবন্দি করে, তার একটা ওজন তৈরি করা গেছে। যা দর্শককে ভয় পাওয়াবে। হ্যাঁ, যদি গোটা সিনেমার জগৎটাই কাল্পনিক হত, তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু যেখানে সিনেমার গল্প অত্যন্ত বাস্তব এবং যার ফলে আমাদের জীবনে পরিবর্তন এসেছে, সেখানে সিনেমার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যকে নিষ্ঠুর বাস্তবের গুরুভার বহন করতেই হবে।

মেকলিন : বর্তমান সময়ে বিশ্বের অবস্থা দেখে একটা প্রশ্ন অবধারিতভাবে উঠে আসে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের আগেই আপনি এই সিনেমা বানানো শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকেই ভ্লাদিমির পুতিন-সহ তাঁর সরকারের বেশ কিছু পদস্থ ব্যক্তি প্রায়শই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের ভয় দেখিয়ে চলছেন। আজকের পরিস্থিতিতে সেই ভয়ের পুনর্জন্ম কি আপনার সিনেমাকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলছে না?

নোলান : সত্যি কথা বলতে, কারওর পক্ষেই আগে থেকে জানা সম্ভব ছিল না যে সিনেমা মুক্তির সময় বিশ্বের অবস্থা এমন হবে। আমাদের কাজ তার অনেক আগে শুরু হয়েছিল। আমার পরিষ্কার মনে আছে, যখন আমি ‘ওপেনহাইমার’-এর চিত্রনাট্য লেখা শুরু করি, তখন একদিন আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ও তখন সবে কৈশরে পা দিয়েছে। আমি যখন ওকে আমার লেখার বিষয়টা বললাম, ও নির্দ্বিধায় বলল যে, “এখন আর কেউ পরমাণু অস্ত্রকে ভয় পায় না। লোকজন কি আদৌ এতে আগ্রহী হবে?” সেই সময়ে আমি বলেছিলাম, “ভয়টা আমাদের থাকা উচিত। হয়তো এই সিনেমা থেকে কাজটা আবার শুরু হবে।” কিন্তু যখন যুদ্ধের মতো ঘৃণ্য ঘটনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, তখন গোটা পৃথিবীকে সেই ভয়টা ফের তাড়া করল। আমাদের সিনেমার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেটাই। পারমাণবিক অস্ত্রের অপরিমিত ভয়াবহ ক্ষমতা মানুষকে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া।

মেকলিন : এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার শেষ প্রশ্ন, সিনেমা বানাতে গিয়ে কোনওভাবে কি আপনার ভাবনাচিন্তার কোনও পরিবর্তন এসেছে? বিশেষ করে পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে। বিশ্বের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আপনি কি একই রকম উদ্বিগ্ন?

নোলান : এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করে, চর্চা করে, বহু মানুষের সাথে কথা বলে এবং এই সিনেমা বানানোর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আমার সত্যিই মনে হয়েছে যে আপনি পরমাণু অস্ত্র নিয়ে যত ভাববেন, তত সেগুলিকে আপনার অত্যন্ত সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র বলে মনে হবে। কারণ আপনি যখনই পরমাণু অস্ত্রকে হাইড্রোজেন অস্ত্রের সাথে তুলনা করছেন, আপনি তখনই একটা সংখ্যাগত মাপকাঠি তৈরি করার ফাঁদে পা দিচ্ছেন। আপনি অঙ্কের মতো হিসেব করতে শুরু করছেন যে এই বিশেষ অস্ত্রে কত লোক মারা গেছে। তার নিক্তিতে আপনি নির্ধারণ করছে অস্ত্রের ভয়াবহতা।

আরও পড়ুন: নেহাত সাধনা নাকি ঈশ্বরত্বের হাতছানি, কেন সর্বঘাতী পরমাণু বোমা বানিয়েছিলেন ওপেনহাইমার?

মেকলিন : মানে আপনি লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুকে আর পাঁচটা ঐতিহাসিক ঘটনার মতো করে দেখতে শুরু করেছেন?

নোলান : ঠিক তাই। আপনি অন্য যুদ্ধগুলোর সাথে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের একটা নৈতিক, অসম্ভব তুলনা তৈরি করছেন। সব মিলিয়ে আপনি একটা ভয়ানক বিপদকে হাজারো রকমভাবে একটা সাদামাটা ঘটনা বানিয়ে ফেলছেন। তারপর একদিন সত্যিই পালে বাঘ পড়বে। ওপেনহাইমার বুঝেছিলেন, আপনিও বুঝতে পারবেন। তখন দেখবেন যে সব সমস্যার সমাধান আপনাকে আবার একটা যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু পুতিন নয়, সব রাজনৈতিক পক্ষই আবার পরমাণু বোমা নিয়ে তর্জনগর্জন শুরু করেছে। আমি এটাকেই সব থেকে বেশি ভয় পাই। আমার মনে হয়, আমরা এখন ইতিহাসের এমন একটা অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, যেখানে সাধারণ মানুষ পরমাণু বিস্ফোরণের মতো ঘটনাকে ভবিতব্যের মতো মেনে নিতে শুরু করবে। আর অবশ্যই এটাও আমাদের ভাবতে হবে এই শেষ পরমাণু যুদ্ধটা ঠিক কীভাবে শুরু হবে? সেটা ওই 'ড. স্ট্রেঞ্জলাভ' সিনেমার মতো ভুল সিগন্যাল পাঠানোর মাধ্যমেও শুরু হতে পারে। আমার মনে হয়, তাঁরা শুরুতেই পরমাণু বোমার মতো বিষয়কে আর পাঁচটা সাধারণ জিনিসের জায়গায় নামিয়ে আনবে। যা আরও ভয়ংকর, আরও বিধ্বংসী কোনো পরমাণু যুদ্ধের দিকে আমাদের নিয়ে যাবে এবং পৃথিবীকে শেষ করে তবে তা থামবে। ফলে হ্যাঁ, আমার নিজস্ব কিছু ভাবনাচিন্তা আছে, নিজস্ব একটা ভয় আছে; আর আমার সব থেকে বড়ো ভয় এটাই যে এই অস্ত্রগুলো আমাদের সুন্দর পৃথিবীকে একদিন ধ্বংস করে দেবে।

More Articles