অপলক সেই বৃদ্ধ এবং হাত ফস্কে যাওয়া একটি রকেট...
Diwali in Barbil: হাতের রকেট, কে জানে আমারই ধুকপুকানিতে কি না, ওপরের দিকে না গিয়ে, নিপুণ একটি হরাইজন্টাল প্লেনে ট্র্যাভেল করে রেললাইন পেরিয়ে ঢুকে গেছে…ওখানে। সেই বৃদ্ধের হাটিংয়ে।
আমাদের বাড়ির বেশ খানিকটা উল্টোদিকে, মানে উল্টোদিকে বেশ খানিকটা রেললাইন পেরিয়ে সারি সারি হাটিং ছিল। হাটিং ওখানকার আদিবাসীদের কুঁড়ে ঘর। বিকেলবেলায় বা শনি-রবি বেলার দিকে যখন ওর পাশ দিয়ে হেঁটে ঢালু উঠতাম, তুষারদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে যাব বলে, তখন অদ্ভুত একটা গন্ধে কেমন ঝিম ধরে যেত। হাটিংয়ের দু’পা বাইরে, আমাদের বাড়ি ছাড়িয়ে সেই দূরের ঠাকুরানি পাহাড়ের দিকে উবু হয়ে অপলক তাকিয়ে বসে থাকতে দেখতাম হাটিংয়ের এক বৃদ্ধকে। তীব্র কোনও আঘাতের ছায়া-নিশান তখনও আমার গহিনে ঘনায়নি বলেই কি না কে জানে, আমি বুঝে উঠে পারিনি, সে বৃদ্ধ ঠিক কীসের অপেক্ষারত ছিলেন। আমি অবশ্য এখনও জানি না, ঠাকুরানি পাহাড় বেয়েই গড়িয়ে নামে কি না অমোঘ এক সমাধির জল।
ওয়েল দ্যাট ইজ ওকে, কিন্তু ওই ঝিম ধরানো গন্ধটা? ওটা কি উসকোখুসকো সেই আদিম মানুষের গা থেকে? নাকি হাঁড়িয়া-র। হাঁড়িয়া খেয়ে এসেই তো, বাবার কোম্পানিতে মাল বওয়ার কাজ করা দনা দাদা (সবাই বলত লেবার) এক বার খুব কেঁদেছিল, ঠিক যখন সন্ধে নামছিল, তখন। বাবা বহু বার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও এক বারও সে বলেনি, কেন। কেন অমন ভিতর মুচড়ে কেঁদেছিল। দনা দাদা কেঁদেছিল সেদিন, যত ক্ষণ না হাঁপ ধরেছিল শিরায়। তার পর চোখ মুছে বাবাকে অনেক আশীর্বাদ করে ফিরে গিয়েছিল, সরি গিয়েছিলেন, নিজের হাটিংয়ে। সে অনেক দূর, সন্ধেয় হাঁটতে শুরু করলে, পৌঁছনো যাবে শৈশব পেরিয়ে রাত যখন যৌবনে, তখন। যদিও এ গল্প যখনকার, তখন দনা দাদা, লোকে বলত, অন্তত ৭২! প্রবল ভুঁড়ি নিয়ে, হাঁড়িয়ায় ভরপুর দনা দাদা সে রাতে কখন ফিরেছিল ঘরে, নাকি এখনও হাঁটছে, অবভিয়াসলি আমার ৭/৮ বছর বয়সে বোঝার ক্ষমতা হয়নি। আমার শুধু মনে আছে, এক দিন ঘোর রোদ্দুরে, আমি যখন বলে দেওয়া সময়ের চক্রব্যূহ এড়িয়ে ব্যক্তিগত কুরুক্ষেত্র লড়ছি ব্যাট-বল সমেত, আর তার পর সেখানে পরাস্ত হয়ে মাথায় বাজ নিয়ে দৌড়ে ফিরছি খেপচুরিয়াস মায়ের সম্মুখে, তখন মাঝ-সমুদ্রে, ওই রেললাইন পরবর্তী ঢালের মুখে মাথায় ময়লা চাদর পাগড়ি করে বেঁধে আমায় নিতে এসেছিল লালচে রংয়ের দনা দাদা। এখন মনে হবে আমি খামখাই কাব্য করার প্রাণপণ চেষ্টা করছি বা অহেতুক মেলোড্রামা কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি, সে দিন আমি এক শতাব্দী প্রাচীন ছোঁয়া অনুভব করে অল্প শিউরে উঠেছিলাম। ঢালের পাশেই সেই হাটিংয়ের বুড়ো। ঠাকুরানি থেকে পূর্বস্মৃতির অনন্ত ফিসফিস-ই কি সে বুড়ো আঁধারের প্রলেপ পড়া চোখে হাতড়ে বেড়ায়? ইশ্ দনা দাদাকে এখন যে জিজ্ঞেস করব, উপায়-ও নেই।
আরও পড়ুন: ঈশ্বরের বরপুত্র মারাদোনা ও সেই সাদাকালো জাদুবাক্সটা…
অবশ্য হাটিংয়ের সেই বৃদ্ধের কাছে কালীপুজোর সে রাতে যা ঘটেছিল, তার জন্যে যে গিয়ে মাফ চাইব, সে উপায়-ও কি আছে! বাবা অনেক বাজি কিনত। আমার বড় মামার ছেলেরা, মানে বুবু, টুটু আর লাল্টু দাদা-রাও দেদার কিনে দিয়ে যেত আমার জন্যে। অফিসে কাজ করা পিওন ছিল বিরো দাদা, নবীন দাদা, ওরাও যেটুকু পারত আনত আমার জন্যে। দনা দাদা-ও একটু দূরে দাঁড়িয়ে অনবদ্য সেই হাসি নিয়ে আমার জন্যে বাজি আনত। বাবাকে নয়তো মাকে ধরিয়ে দিত শালপাতায় মোড়া ফুলঝুরি, রকেট, তুবড়ি। আর আমায় কিছুই বলত না, শুধু অজস্র মায়া বিলাতো ওই হাসি। যেন আকুল হয়ে ওভারটাইম চেয়ে নিচ্ছে, বিনি পয়সায়, ঘাড় কাত করে আমায় সমুদ্র মন্থনের শান্তিঘের আভাস দেবে বলেই। দনা দাদা-রা কি আজন্মকাল এমনই প্রাজ্ঞ হয়? বোঝে, মিষ্টি শিশিরবিন্দুর আজীবন ঝুলে থাকাই নিয়তি, তাই সামর্থ্য অনুযায়ী আশপাশের হাওয়া আটকায়? জানে, কনকনে শীতের কোনও এক রাতে, হঠাৎ ঠাকুরানির নীচে শেয়াল ডেকে ওঠেই আর কোনও আদরের চৌহদ্দিতে ফুল স্পিডে পাখা। আর তার পরই দেওয়াল থেকে অনাদরের চোটে পলেস্তরা খসে পড়ে। পড়েই। যত ক্ষণ না সে দেওয়ালের আর ডিভ্যাস্টেশনকে নতুন কিছু দেওয়ার থাকে।
নাকি একেই অভিজ্ঞতা বলে? দনা দাদা কি আগত কাঁপুনির আগাম পদধ্বনি শুনতে পেয়েই সে দিন বাবার কাছে এসে অঝোরে কেঁদেছিল আর যাওয়ার বেলায়, যাবতীয় এরিয়া ম্যানেজার-মজদুর ভেদাভেদ ভুলে বাবাকে জন্মের আশীর্বাদ করে গিয়েছিল?
ভাগ্যিস এত জটিল ও অবধারিত উত্তরহীন ভাবনার নাগপাশে তখনও জড়াইনি, না হলে আমাদের প্রকাণ্ড বারান্দায় রোদের ঢিপিতে শুকোতে দেওয়া গ্যালন গ্যালন বাজির দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে বসাই হত না। রকেট, কালীপটকা, চকলেট বোম, তুবড়ি, ফুলঝুরি, রংমশাল, চড়কি, তার পর এক বার বেরোল নতুন একটা, আলু বোম। হলুদ রংয়ের মিডিয়াম সাইজের গোল্লা একটা। একটু দূরে সজোরে ছুঁড়ে মারলেই দমাশ। বাবা এ সবে খুব একটা আগ্রহী না হলেও, বাজি পোড়ানো / ফাটানোর সময়ে, অ্যাজ ইউজুয়াল চ্যাম্পিয়ন। আমার খুব একটা ওই বোমা-টোমায় পারমিশন ছিল না। অন্যরা ফাটাবে, তুমি দূর থেকে দেখো, হ্যাপি হও। এন্ড অফ বক্তব্য। তবে মা যে হাতে ধরেই চকলেট বোমায় আগুন ধরিয়ে অ্যায়েন মওকায় ছুঁড়ে ফেলে ফাটাতে পারে, তা দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। কেন? কারণ ছোট থেকেই শেখানো হয়, মায়েরা জাত সাবধানী? কী আনফেয়ার না? যেন নতুন ভূমিকায় মা কখনও রকেট বেগে মেয়েবেলায় ফিরে যেতে পারে না। গেলেই তার পদবিতে অসাবধানী…
কিন্তু মায়ের সে কাণ্ডের চেয়েও তাজ্জব বনে ছিলাম, যখন আমাদের গাড়ির চালক আহমেদ দাদা, অহেতুক ব্র্যাভাডো দেখাতে গিয়ে বোতল সরিয়ে স্ট্রেট হাতে ধরে রকেটে আগুন ধরিয়েছিল। তা করছে করুক, ও মা হঠাৎ কী খেয়াল হল কিছু বোঝার আগেই খপাৎ করে আমার হাত ধরে বলে, ম্যায় হুঁ না! কী সর্বনাশ, ম্যায় হুঁ না কী? রকেটের ডাঁটির কিছুটা ঠেকে আমার হাতে। আমি পেছন ফিরে কাউকে একটা খুঁজছি, হয় বাবা নয় মা, যার নির্দেশে উদ্ধার হব আমি কিন্তু সেই অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ আছে না, অভাগা যে দিকে চায়… ঠিক তখনই ট্রাঙ্ক কল এসেছে কলকাতা থেকে জ্যেঠুর আর আমাদের লাল ডায়ালওলা টেলিফোনে বাবা হেসে হেসে কথা বলছে, মা-ও অপেক্ষারত, দিদিভাইয়ের সঙ্গে কথা বলবে, আমার জ্যেঠিমা, আমি বলি বম্মা।
আরও পড়ুন:একানড়ে নয়, সেদিন অন্ধকারে দুলেছিল যে গোল ছায়া…
ট্রাঙ্ক কল শেষ হতে হতে আহমেদ দাদা সেমসাইড করে ফেলেছে। হাতের রকেট, কে জানে আমারই ধুকপুকানিতে কি না, ওপরের দিকে না গিয়ে, নিপুণ একটি হরাইজন্টাল প্লেনে ট্র্যাভেল করে রেললাইন পেরিয়ে ঢুকে গেছে…ওখানে। সেই বৃদ্ধের হাটিংয়ে। দূর থেকে একাধিক দুম শব্দের চোটে আজও বোঝা হয়নি, ঠিক কোনটি আমার / আমাদের পদস্খলনের। কিন্তু গোটা ঘটনা শোনার পর, এখনও মনে আছে, থম মেরে যাওয়া বাবা আর আহমেদ দাদা যখন হাটিংয়ে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিল, সেই বৃদ্ধকে পায়নি। পাশাপাশি আরও কয়েকটা হাটিং ছিল, সেখান থেকে কয়েক জন এসে তেমন কিছুই বলেনি। ফলে ক্ষমা চাওয়াটাও কেমন অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল। ওরাই, সরি তাঁরাই বলেছিলেন, বৃদ্ধ সে দিন আলো পড়ার আগেই ঠাকুরানি পাহাড়ের দিকে কোথাও একটা চলে গিয়েছিলেন। ও দিকে কোথায় নাকি তাঁর এক পরিচিত ছিলেন, কালো লরঝড়ে মতো দেখতে লোমশ একটা ভালুক ছিল তাঁর। খেলা দেখাতে বেরোতেন। আমিও দেখেছি। সেই তাঁর কাছে। বাবা বলে এসেছিল, বৃদ্ধ ফিরলে যেন এক বার বাবাকে খবর দেওয়া হয় বা অন্তত তিনি যদি এক বার আমাদের বাড়ি আসেন, বসিয়ে একটু দুঃখপ্রকাশ করবে বাবা-মা। এত দিন হয়ে গেছে, আর মনে পড়ে না সে সাক্ষাৎ ঘটেছিল কি না। শুধু মনে আছে, যে বার প্রবল ঝড় হল আর আমার তো ঝড়ে, তার জানলা-বাইরে সোঁ সোঁ করাঘাতে অশেষ ভয়, তাই খাটের এক কোণে চুপ করে কেঁপেছিলাম আর কাঁপা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যখন হঠাৎ বারান্দায় আশ্চর্য এক আলোর বিস্ফোরণ বোধ করেছিলাম। কোন মতবিরোধে কে জানে ঝড় সে দিন অধিক ক্রুদ্ধ হয়েছিল বা হয়তো অমনই তার জন্মসিদ্ধ অধিকার! পথ পেরোনোর ক্ষণে তাই সে অবলীলায় ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের বারান্দার ওপরের মোটা অ্যাসবেস্টাস। উড়ানপথে অযথা থুতুর মতো যখন ফেলেই দেবে এক্সট্রা ব্যাগেজ, তখন কেনই বা আর অযথা রোয়াব দেখানো, বুঝি না বাবা!
ঝড় অন্যত্র নবতম মৌরসিপাট্টা কায়েম করতে যাওয়ার কিছু পর, যখন নরম আলোর ছটায় একটা একটা করে জানলার পাল্লা খুলছে ফের, তিনি এসেছিলেন, সেই বৃদ্ধ, আরও কয়েক জনের সহিত, আমাদের খণ্ড খণ্ড অ্যাসবেস্টাস ফিরিয়ে দিতে।