সাংবাদিকই হেনস্থার শিকার হলে বিচার চেয়ে প্রশ্ন তুলবে কে?

Molestation of Journalist: অপরাধ করে কত সহজেই ‘রাজনৈতিক চক্রান্ত’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চান প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা!

এ দেশেতে অন্ধ আইন,
সমাজের মুখ বন্ধ।
হলে মেয়ে তুই নির্যাতিতা-
থাকবি না চুপ,
তুলবি হাতে অস্ত্র!

‘অসুর বিনাশিনী’ কবিতাটি লিখেছিলাম ২০২০ সালের অক্টোবরে। একটার পর একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে সেই সময়। কবিতাটি লেখার কয়েক মাসের মধ্যেই ২০২১-এর জানুয়ারি মাসে বম্বে হাইকোর্টের যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত একটি রায়ে তোলপাড় হয়েছিল সমাজমাধ্যম। পকসো আইনে যৌন নির্যাতন হিসেবে গণ্য হতে গেলে 'যৌন উদ্দেশ্যে ত্বকের সঙ্গে ত্বকের সংস্পর্শ' হওয়া প্রয়োজন বলে এক রায়ে জানিয়েছিল বম্বে হাইকোর্ট। এক নাবালিকাকে যৌন নির্যাতনের মামলায় বিচারপতি পুষ্পা গনেড়িওয়ালা জানিয়েছিলেন, কেবল নাবালিকার বুক স্পর্শ করার অভিযোগ উঠলেই তাঁকে পকসো আইনে যৌন নির্যাতন হিসেবে ধরা যাবে না। জামা সরিয়ে 'স্কিন টু স্কিন কন্ট্যাক্ট'-এর অভিযোগ উঠলে তবেই যৌন নির্যাতনের মামলা করা যাবে।

আমার এই কবিতা প্রতিবাদের আবেগমিশ্রিত শব্দের সমাহার মাত্র। তাই কবিতায় অস্ত্র তুলে নেওয়ার কথা বলা গেলেও ভারতবর্ষের আইন কি তা সমর্থন করবে? তাহলে কারও সঙ্গে অন্যায় হলে সে কী করবে? ঘরে মুখ লুকিয়ে বসে থাকবে? সমাজ কী বলবে— এই ভেবে লজ্জায়, ভয়ে চুপ থাকবে নির্যাতনের শিকার হওয়া ছেলে-মেয়েরা? সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা এমনই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। আরজি করের ঘটনার পর হতাশ হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। অনেকেরই ধারণা তৈরি হয়েছে, প্রতিবাদ করে কিছু হয় না। সভ্য সমাজে সুবিচার চাওয়াই যেন অন্যায়! কিন্তু নির্যাতিত বা নির্যাতিতারা যাতে সাহস করে বিচার চাইতে পারেন, তার জন্য আইন-আদালতের ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই সমাজের কি কোনও দায় নেই?

আরও পড়ুন- বিচার করবে কে? পশ্চিমবঙ্গের ২৫জন বিধায়কই যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত: রিপোর্ট

সম্প্রতি একজন মহিলা সাংবাদিক হিসেবে আমার এক খারাপ অভিজ্ঞতা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলাম। এক রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তাঁর অভব্য ও অশালীন আচরণের শিকার হয়েছিলাম আমি। বিষয়টি নিয়ে সরব হওয়ায় পাল্টা আমার দিকেই ধেয়ে আসে আক্রমণ। অথচ সাংবাদিকরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এমন অনেক ঘটনা সামনে নিয়ে আসেন যা কল্পনাতীত। রাজনৈতিক চাপ তৈরি হতে পারে, প্রাণসংশয় হতে পারে জেনেও, সব উপেক্ষা করেই তাঁরা প্রশ্ন করে চলেন। অথচ একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি যখন আমারই সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করি, তখন উল্টে আমাকেই হেনস্থার শিকার হতে হয়!

তার উপর যদি অভিযোগ প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে হয়, তার সুবিধে নিতে ছাড়েন না অভিযুক্ত। "মানুষের সেবা করার জন্য রাজনীতি করি" দাবি করা ব্যাক্তিরা সুযোগ পেলেই রাজনৈতিক সুবিধে নিয়ে নেন। অপরাধ করে কত সহজেই ‘রাজনৈতিক চক্রান্ত’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চান। প্রভাবশালী তো অনেক বড় ব্যাপার, কোনও ভবঘুরের বিরুদ্ধেও শ্লীলতাহানি বা যৌন নির্যাতনের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে গেলে অনেক সাহস জোগাতে হয়, বিশেষ করে মহিলাদের। আমার সঙ্গে ঘটা এই ঘটনায় সমাজের একটা অংশ দাঁত-নখ বের করে আমাকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করে প্রমাণ করে দিয়েছে ‘দ্বিচারিতা’ শব্দের অর্থ। আরজি করের প্রতিবাদে যাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁদেরই অনেকেই আমাকে 'ভিক্টিম ব্লেমিং' করেছেন। সত্য না জেনেই, আদালতে বিচার হওয়ার আগেই নিজের মতো করে বিচার করেছেন।

আরও পড়ুন- তরুণী সাংবাদিককে হেনস্থা! অভিযুক্ত সিপিএম নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য যা বলছেন…

যদিও আইনি লড়াই এখনও জারি; তবে, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল তদন্ত করে সেই নেতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছে। আসলে এই লড়াই সেই সব সাংবাদিকদেরই, যাঁরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েও মুখ খুলে উঠতে পারেন না। সাংবাদিকরাও যে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন তা যেন ভাবাই যায় না! সত্যটা মানতে হবে। ‘ইয়ার্কি’ করছি বলে আপত্তিজনকভাবে স্পর্শ করা যায় না, সেটা বুঝতে হবে। আসলে অপরাধীদের কোনও দল হয় না। সব জায়গায় সবরকম মানুষের উপস্থিতি থাকে। কিন্তু তাঁরা চিহ্নিত হলে পক্ষপাত না করে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করাই জরুরি।

অনেকের মতেই, “ঘটনাটা ঘটেছে মানছি, ঘটতেই পারে কিন্তু প্রতিবাদ করার কী দরকার ছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষাৎকার আর না নিতে গেলেই হতো”। কিন্তু কেউ বুঝছেন না বা বুঝতে চাইছেন না যে, প্রতিবাদ না করলে এমন অশালীন আচরণ আরও অনেকের সঙ্গেই চালিয়ে যেতেন ওই ব্যক্তি। তাছাড়া “কী আর করবি! মেনে নে, মানিয়ে নে” গোত্রের শোনাচ্ছে না বিষয়টা? এইভাবে ঘটনাগুলোকে 'স্বাভাবিক' করে দেখার কারণে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ না খোলার কারণেই সমাজে অন্যায় বাড়ছে বলে মনে হয় না কি? সরকার আর পুলিশ প্রশাসনকে দোষ দিয়েই কি আমাদের সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেও প্রশ্ন করতে হবে তো, অন্যায় রুখতে আমার ভূমিকা কী? আমি অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছি না তো? স্বার্থ সংঘাত হলেই নির্যাতিত বা নির্যাতিতাকে নানাভাবে আক্রমণ করে আরও যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছি না তো? অনেক সময় নিজেকে প্রশ্ন করাও জরুরি। ইতিমধ্যেই একটি অন্যায়ের বিচারের জন্য লড়ছি আমি, তার উপরে যেভাবে নিত্য মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে আমাকে এর বিচার করবে কে? 

More Articles