রবিঠাকুরের পৌষমেলায় গ্রামীণ মানুষ, আদিবাসীরাই এখন সংখ্যালঘু
Poush Mela Shantiniketan: মেলায় ঢুকে পড়েছে কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা। বাউল ফকিরদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে মেলা কর্তৃপক্ষ।
সমাজের বিচক্ষণ মানুষেরা বহুকাল আগে থেকেই ঠিক করে ফেলেছিলেন যে গ্রামীণ উৎসব, পার্বণ আর মেলাগুলো কোন কোন সময়ে হবে। তার একটা সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন দেখা গেছে, প্রাচীন গ্রামদেশের মেলাগুলো প্রায় সবই পৌষ মাস নাগাদ শুরু হয়। এর কারণ হলো, পৌষ মাসে ফসল ওঠে। তখন গ্রামীণ চাষিবাসী মানুষের হাতে কিছু টাকাপয়সা আসে। হাতে কড়ি থাকবে তবে না সে মেলায় যাবে! তার মানে আবার এও বলছি না যে পৌষ মাসেই সব মেলা হয়। অনেক সময়ই তিথি-নক্ষত্র মেনে বা বিশিষ্ট সব ব্যক্তিত্বের জন্মদিন অনুসরণেও হয়। তবে মূলত বড় বড় প্রাচীন মেলা, যেখানে কৌমসমাজের আধিপত্য, তা পৌষ মাস নাগাদই হয়ে থাকে। মেলা যেমন মিলিত হওয়ার শ্রীক্ষেত্র, বিনোদনের মহাসমারোহ তেমনই বৎসরান্তে দৈনন্দিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র কেনাকাটারও আদর্শ স্থান বলে পরিগণিত হতো একসময়। আজ সে দিন গেছে। নগরায়ন সমস্ত পাল্টে দিয়েছে। কেনাকাটার জন্য আর সারা বছর অপেক্ষা করতে হয় না। তথাপি মেলা আছে মেলাতেই।
আমার বিষয় যেহেতু শান্তিনিকেতন, তাই সেই কথাই এখানে লেখা ভালো। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জুড়ে দিয়েছিলেন বছরভর অসংখ্য মেলা ও উৎসব। পৌষ মেলা, বসন্ত উৎসব, মাঘোৎসব, হলকর্ষণ, বৃক্ষরোপণ ইত্যাকার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক সুনির্দিষ্ট যোগাযোগসমৃদ্ধ উৎসবের বার্তা দেওয়া ছিল এর মূল অভিপ্রায়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যোগাযোগ সম্ভাবনাকে প্রবল গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই মোতাবেক শুরু হয় মেলা উৎসব। এখানে উল্লেখ রাখি, মেলাকে তিনি এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, ক্ষিতিমোহন সেনকে বলেছিলেন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কেঁদুলির মেলায় যেতে। বলেছিলেন, এও এক বিদ্যালয় যেখানে সেভাবে কোনও পাঠ্যক্রম নেই। কিন্তু মেলায় গেলে ছাত্রছাত্রীদের অনেক কছু শেখা হবে। তাঁদের মনে এক বরিষ্ঠ আশাবাদের সঞ্চার হবে। জীবনকে মেলামেশার মধ্যে চিহ্নিত করতে পারবে।
আরও পড়ুন- রবিঠাকুরের গানের সুর বদলে দিয়েছে শান্তিনিকেতনের মুরুব্বিরা
পৌষমেলা রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলেও এর মূল ভাবধারাটি বেঁধে দিয়েছিলেন স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রাথমিকভাবে যা উৎসব হিসেবেই পালিত হতো। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ১২৫০ বঙ্গাব্দের ৭ই পৌষ তারিখে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ মহাশয়ের কাছে কুড়িজন সহব্রতীসহ দেবেন্দ্রনাথ ব্রহ্মের নামে অঙ্গীকার করে দীক্ষাগ্রহণ করেন। এই দিনটিকে সেকারণে ব্রাহ্মধর্মের দিক থেকে পবিত্র দিবস হিসেবে ধরা হয়। এই নির্দিষ্ট দিন থেকেই উৎসব পালন শুরু হয়। প্রথমবার এই উৎসবের আয়োজন অবশ্য শান্তিনিকেতনে হয়নি। দেবেন্দ্রনাথের পলতার ওপারে গোরিটির বাগানবাড়িতে আয়োজিত হয় পৌষ উৎসব। তবে মহর্ষির মনোবাঞ্ছা ছিল মেলা করার।
সেইমতো শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট ডিডে সে কথা লিখেও যান। এ কথা তো সবার জানা।
শতবর্ষ অতিক্রান্ত। এই মেলা শুরু হয়েছিল ১৮৯৪ সালে। মেলা প্রসঙ্গে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ট্রাস্ট ডিডে লেখেন,
"এই মেলা উৎসবে কোন প্রকার পৌত্তলিক আরাধনা হইবে না ও কুৎসিত আমোদ-উল্লাস হইতে পারিবে না, মদ্য মাংস ব্যতীত এই মেলায় সর্ব্বপ্রকার দ্রব্যাদি খরিদ বিক্রয় হইতে পারিবে। যদি কালে এই মেলার দ্বারা কোনও রূপ আয় হয়, তবে ট্রাষ্টীগণ ঐ আয়ের টাকা মেলার কিম্বা আশ্রমের উন্নতির জন্য ব্যয় করিবেন।"
আজ হয়তো একশো গুণ এগিয়ে গেছি কিংবা পেছিয়ে গেছি প্রস্তাবিত সেই ভাব ও ভাবনা থেকে। প্রথম যুগের মেলা ছিল অনেকটাই গ্রামীণ পরিসরে। ছোট কিন্তু সেই মেলার আত্মিক টান ছিল মারাত্মক। সবটাই শোনা ও পড়া থেকে লিখছি। সেই সময় অর্থাৎ প্রথম যুগে কিছু দোকানি পসরা সাজিয়ে বসতেন আশেপাশের গ্রাম থেকে এসে। হরিশচন্দ্রের উপাখ্যান গান করে গাওয়া চলত সেই সময়। সন্ধ্যা নামলে মেলার মধ্যবর্তী দিনে তখন আতশবাজির উৎসব হতো। জানা যায়, প্রথম পৌষমেলার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল ১৭৩২ টাকা ১০ আনা।
কালে কালে আজ তার বহর বেড়েছে। এখন থেকে তিরিশ চল্লিশ বছর আগেও মেলার একটা সুস্থ পরিবেশ ছিল। বর্তমানে ভিড় বেড়েছে মারাত্মক। মেলায় ঢুকে পড়েছে কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা। বাউল ফকিরদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে মেলা কর্তৃপক্ষ। মূল মঞ্চের অবস্থা অধিকাংশ সময়েই বেসামাল। গত চার-পাঁচ বছর মেলা হয়নি কোভিড ও একজন অস্থিরমতি দাম্ভিক উপাচার্যের জন্য। এই
বছর আবার সেই মেলা পূর্বপল্লীর মেলার মাঠে ফিরেছে। যখন এই লেখা লিখছি তখন মেলা চলছে। তিনদিনের মেলা এখন ছয়দিনের হয়েছে। তারপরেও ভাঙা মেলা চলবে আরও সপ্তাহখানেক। আগে এই মেলার তত্ত্বাবধায়ক ছিল বিশ্বভারতী। ইদানীংকালে সেখানে স্থানীয় প্রশাসনও মাথা গলিয়েছে। ফলে নানা বিষয়ে মতবিরোধ লেগেই আছে। তার সঙ্গে ঢুকেছে প্রবল পরাক্রান্ত বোলপুরের ব্যবসায়ী সমাজ।
আরও পড়ুন- বাবুদের শান্তিনিকেতন আসলে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় পঞ্চাশ হাজার গাড়ি একদিনে মেলা উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতন তথা বোলপুরে যাতায়াত করবে। আর আছে তিন হাজারেরও বেশি টোটো আর মেলার পদযাত্রী। ছোট্ট এই মহকুমা শহর কি এত কিছু ধারণ করতে পারবে? এর উত্তর হলো, পারবে না। আর পারছে না বলেই চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার যানবাহন নড়ছে না বেলা গড়ালে। মেলার মাঠের আনাচেকানাচে চলছে দেদার নেশা। পুলিশ আছে, আছে বিশ্বভারতীর নিরাপত্তারক্ষী। কারও সেভাবে কোনও দায় নেই। বাউল ও ফকিরদের জন্য করা পৃথক দু'টি ক্যাম্পের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। সম্পূর্ণত ঘেরা সেই ক্যাম্প দু'টির অত্যন্ত ছোট প্রবেশ পথ দিয়ে নির্দ্বিধায় ঢুকে যাচ্ছে পান্টারের দল (ছেলেছোকরা)। চলছে তুমুল মদগাঁজা। বাউল ফকিরদের মধ্যে অনেকেই তামাকসেবনে অভ্যস্ত। সেই সুবিধা নিতে সেখানে বিরাট জমায়েত। ক্যাম্পগুলোর মেঝেতে খড় পাতা। ফলে অসাবধানতার কারণে যে কোনও সময়ে ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রকৃতির মধ্যে মানুষে মানুষে মেলামেশার যে ভাবটির কথা ভাবা হয়েছিল তার এখন এই মেলায় স্থান নেই। পরিবর্তে চলছে মানুষে মানুষে ধাক্কাধাক্কি। এক সময় যে মেলার পসরা সাজাত মূলত গ্রামীণ মানুষ এবং আদিবাসীরা তারাই এখন এই মেলা খেলার মেলাখেলায় সংখ্যালঘু। প্রশ্ন উঠতে পারে অজস্র কিন্তু উত্তর দেওয়ার লোক নেই। যে মেলাকে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন, সেখানে প্রকৃতির সেই যোগাযোগসমৃদ্ধ অবকাশ আর নেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অস্বাস্থ্যকর দূষণ। তবে ফলে মেলা হবে, মাঠ পেরিয়ে তার কলেবর বৃদ্ধি পাবে কিন্তু প্রকৃত মেলা আর থাকবে না। সে চলে যাচ্ছে, যাবে প্রাণহীন শহুরে কার্নিভালের পথে।