ক্রিসমাস কেক ও থলকাবাদের বাঘ
Christmas In Barbil: বাইরে প্রথা মেনে বারা স্যার সান্তা হয়ে বেরোচ্ছেন, সিস্টার অ্যানি এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে, গাল টিপে আদর করে অস্ফুটে বলেছিলেন, ‘বি ব্রেভ সান’।
এই সময়টা আমাদের সেকেন্ড টার্মিনাল হত। ওই ঠিক ২৩ তারিখ নাগাদ শেষ পরীক্ষা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মরাল সায়েন্সই থাকত শেষে। ও আর কতক্ষণই বা লাগে! ফটাফট শেষ করে ফেলতাম আমরা। আর তারপর ওই ভাবে বসে কিংবা টিচারের নির্দেশে হেড ডাউন অবস্থাতেই উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতাম, ট্রে-তে করে কখন আসছে কেক! তখন অত পেস্ট্রি-ফেস্ট্রি কোথায় আর বুঝতাম! সবই কেক, ওপরে গোলাপী আর সাদাটে ক্রিম।
বাইরে আমাদের ইয়াব্বড় মাঠে তখন একটা উৎসবের সোঁদা গন্ধ, যেন বহুদিন পরের হগওয়ার্ট্স বা লীলা মজুমদারের প্রশ্রয়ী হাওয়া। লাল জোব্বা পরে ততক্ষণে রেডি আমাদের হিস্ট্রি স্যার, বারা স্যার। এমনিতেও অমনই চেহারা ছিল তাঁর কিন্তু মোটেও সান্তা-সুলভ সহৃদয় ছিলেন না। নম্বর কাটতেন যেন জন্মসিদ্ধ অধিকার, কানের লতি ধরে চিমটি কাটতেন, যেন অমন শাস্তি দেওয়াও তাঁর জন্মসিদ্ধ… হোয়াটএভার। কিন্তু সে দিন তিনিই যে সান্তা। ছুঁড়ে দিচ্ছেন মণিমুক্তো আর লুটোপুটি করে আমরা কুড়িয়ে নিচ্ছি ভবিষ্যতের স্মৃতি, এখন বুঝি।
আমার লক্ষ্য থাকত একটা সাদা ব়্যাপারে মোড়া কমলা রঙের লজেন্সে। বাকি সবাই যা ইচ্ছে নিক, আমার ওইটিই চাই। এক বার হুড়মুড়িয়ে সে সব তুলতে গিয়ে দেখি সামনে সিস্টার অ্যানি। আমাদের বড় স্ট্রিক্ট প্রিন্সিপাল। কিন্তু আমার যেন ভিতরে ভিতরে বহু দিন ধরেই মনে হত, সিস্টার অ্যানি শুধুই গম্ভীর বা রাগী নন, তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে নিশ্চয়ই চোখে জল আসে। কেন, কোথা থেকে সে জল আসে— ধারণা ছিল না, কিন্তু একটা বিশ্বাস ছিল। সিস্টার অ্যানি সে বিশ্বাসে আঘাত লাগতে দেননি। তো আমি সেদিন লজেন্স কুড়োতে গিয়ে তাঁকে সম্মুখে দেখে একটু থমকেই গিয়েছিলাম। তিনিই চোখে একটা বাল্যকালের দুষ্টুমি-ছোঁয়া এনে ঝুঁকে পড়ে কুড়িয়ে দিয়েছিলেন অজস্র চুমকিফুল, আর তার পর আমার মাথায় তাঁর হাত, আমার চুল ঘেঁটে যাওয়া— আর আমি ঘোরের মধ্যে দেখে যাই তাঁর বয়ে যাওয়া, আনন্দধারা হয়ে আরও কোনও থমকে থাকা বালক বা বালিকার উদ্দেশে।
আরও পড়ুন: আউআউ পাগল, রঙ-ওঠা কমলা চাঁদ আর গহিন জঙ্গলের সেই কান্না
অবশ্য আরও একবার সিস্টার অ্যানি’র মাথায় হাত বুলোনো মনে আছে। আমার স্কুল, সেন্ট মেরি’জে সেই শেষ বার ক্রিসমাস দেখা। বা ঠিক দেখা নয়, না-দেখতে পাওয়া। ’৯২, কিছুদিন আগেই বাবা অসুস্থ হয়েছে। ওই তীব্র শীতেও পাঁচে পাখা চলেছে, তা-ও বাবার অস্থিরতা কমেনি। তারপর, গোরাকাকু আসবে, প্রায় পেট্রল না-থাকা জিপে, কোন মায়াবলে বাবা ও আমাদের নিয়ে যাবে বরাজামদায়, হাসপাতালে। সেখানে রাতে আমি কিচ্ছু বুঝতে পারব না। আমার ভয়ে হিসি পাবে আর কিছুটা প্যান্টেও হয়ে যাবে। মা একা একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে থাকবে, ভেতরে প্রায় তেমন কোনও অস্ত্র না-থাকা সত্ত্বেও সাক্ষাৎ ঈশ্বর ডক্টর প্রসাদ অসম এক যুদ্ধ শুরু করবেন… আমি তার পর বাকি এক-দুটো পরীক্ষা দেব, পমদের বাড়ি থেকে। পম আমার বন্ধু। এক ক্লাসেরও। ওরা পরিবার আমাদের। খুকুমা আমায় দেখতে দেবে না কাঁদছে। কিন্তু আমি জানতাম, ঘুম থেকে ওঠার অত পরেও কারও চোখ ফুলে থাকে না। আমাদের কলকাতায় চলে যাওয়া সেদিন অসুস্থ বাবাকে নিয়ে। একটা অভাবনীয় অধ্যায়ের হবু শেষ, খানিক পরেই।
আমি তখন পরীক্ষা শেষ করে সিস্টার অ্যানি’র অফিসে চুপ বসে। বাইরে প্রথা মেনে বারা স্যার সান্তা হয়ে বেরোচ্ছেন, সিস্টার অ্যানি এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে, গাল টিপে আদর করে অস্ফুটে বলেছিলেন, ‘বি ব্রেভ সান’। নাকি আমি শুনেছিলাম তা? তবে হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন, কমলা লজেন্স। কত লীলা মজুমদার এ ভাবেই দূর-দূরান্তে হরিণের গাড়ি দাঁড় করিয়ে জলছাপ রেখে যান, আমরা খেয়ালই করি না!
না, এই দেখুন, আবার আমার দুঃখ-দুঃখ পাড়ায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছি পাঠককে। সরি।
কিন্তু ওই সব কিছু ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে এখনও মনে আছে, দুপুরে আন্টি কাকুদের বাড়িতে যত্ন করে খাওয়ানো অপূর্ব একটা আলুর ঝোল। আন্টি কাকু, এক জন পুরুষ, বাই দ্য ওয়ে। আমাদের পড়শি। গুজরাটি, ঝা। ওদের দুই ছেলে বান্টি ও ছোটু। আসলে, আমি প্রথমে আন্টিকে দেখেছিলাম। তারপর দেখি, ও মা! এই আন্টির সঙ্গে এক জন কাকু-ও আছে, সেই থেকেই ডাকা শুরু হল— আন্টি কাকু। ছোটু এক বার, যাকে বলে মন কেড়ে নিয়েছিল। পরীক্ষায় বেশ ধেড়িয়েছে। আর বান্টি ফাটিয়ে দিয়েছে। ফলে, ওরা বুঝতেই পারছিল না, যে কী করবে, আনন্দ না দুঃখ। তারপর দেখি আন্টি কাকু এসে বাবার কাছে, প্রায় সারেন্ডার। কী ব্যাপার না, ছোটু নাকি সাংঘাতিক উপদ্রব করছে। আসলে ও অঙ্কে ৭ বা ১৭ কিছু একটা পেয়েছিল। বেচারি আন্টি ওকে বকতে গেছে! উল্টে ছোটু-ই উপস্থিত সবাইকে স্তম্ভিত করে মা, অর্থাৎ আন্টিকে অ্যাটাক করে বলেছিল, ‘ছিঃ মা, আপ কিতনি লালচি হো! আপকো সির্ফ নম্বর চাহিয়ে? ম্যায় সোচ ভি নহি সকতা!’ (লালচি মানে লোভী)। এবং শুধু তা-ই নয়, এরপর নাকি ও অনেকক্ষণ চান করতে যায়নি এবং খেতেও রিফিউজ করেছিল, শুনেছিলাম। শেষে ওকেই বাবা-বাছা করে তুইয়ে-বুইয়ে শান্ত করা হয়েছিল। মনে মনে ওকে সে দিন 'দিল জিত লিয়া' বলেছিলাম বটে! এখন বুঝি, ম্যানেজমেন্টে কোর্সে পড়ানো উচিত, কাউন্টার-অ্যাটাক কাহারে কয় ও কী ভাবেই বা হয়!
তবে ছোটু’র ‘দৌরাত্মে’ আন্টি ও আন্টি-কাকু’র যেমন অবস্থা হয়েছিল, ঠিক তেমনই হয়েছিল থলকোবাদ গেস্ট হাউজের চৌকিদারের। আই গেস্। থলকোবাদ, বাঙালিরা এন্তার বলতো অবশ্য থলকাবাদ। তা সেই থলকোবাদ হলো গিয়ে একটু অপূর্ব এবং ওয়ান অফ দ্য আনএন্ডিং জঙ্গলস ওই তল্লাটে। আমরা গিয়েছি গোরা কাকু, খুকুমা, পম, সবাই মিলে। জঙ্গলের একদম মাঝমধ্যিখানে সাদামাটা গেস্ট হাউজ। মনে পড়ছে না আলাদা করে জবরজং কোনও বাউন্ডারি ছিল কি না! থাকলেও এমনই নগণ্য, যে জিরাফ থাকলে জাস্ট এক টোকায় ঢুকে পড়ত। এনিওয়ে থলকোবাদে জিরাফ নেই, বাঁচোয়া। কিন্তু বাঘ নাকি ছিল এককালে। শোনা কথা। আচ্ছা হাতি তো ছিলই, কারণ, পদে পদে তাদের মল দেখা যেত, ওয়াচটাওয়ারে না উঠলেও! তা এই গেস্ট হাউজের বিউটিফুল একটি ফিচার ছিল, ইলেক্ট্রিসিটি না থাকা। না, নামমাত্রও না। ফলে বুঝতেই পারছেন, শীতের রাতে, জাস্ট আদিম লেভেলের অন্ধকারে আমরা ফেলুদা স্টাইলে মুসুর ডাল, ভাত আর বনমোরগের ঝাল খাচ্ছি। আর বাইরে তখন রাতচরা পাখিদের শীতঘুম বিরোধী সমাবেশ সম্ভবত। চেনা আওয়াজই দেখগে যান, ওই পরিস্থিতির চাপে কী রহস্যাবৃত ঠেকে। কোথাও সড়সড়, কোথাও ঝুপ, কখনও দূরের শেয়াল ইকো হয়ে ফেরে, মানে শেয়ালের ডাক আর কী! আর এ সব গা সওয়া হয়ে গেলে পরে, একটা কিছু না-হওয়াও যেন অধিকতর মিস্ট্রি। মোদ্দা কথা, লালমোহনবাবু থাকলে সে অবস্থা দেখে বা অনুভব করে নির্ঘাৎ একটা কোটেবল কোট দিতেনই।
আরও পড়ুন:বুনো গন্ধের ঝোঁক ধরিয়েছিলেন গুহমশাই
থলকাবাদের সকাল অবশ্য, শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে বেরানোর মতো ক্রিস্প। গাছের পাতা ফুটো করে সেঁধিয়ে যায় রোদ। নকশা তৈরি করে যা জন্মদাগ হয়ে বোধহয় আজও আমার সে কোণে বিদ্যমান, যেখানে বহুকাল ঢুঁ মারা হয়নি। সে নকশার ছত্রছায়ায় দাঁড়িয়েই তো আমি আর পম চুপিচুপি মেরে দিয়েছিলাম মিল্কমেডের টিন থেকে, যাকে বলে নিট, গ্যালনখানেক মিল্কমেড। পাউরুটিতে মা আর খুকুমা তার পর ঠিক কী লাগিয়েছিল মনে নেই। কিন্তু মনে আছে চৌকিদারের ভীতসন্ত্রস্ত মুখ। আমাদের কাছে এসে চারদিকে তাকিয়ে বলেছিলেন তিনি, ‘বাবু কাল রাত কো শের আয়া থা!’ এবং সে শের নাকি ডেকেও ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই শিরদাঁড়ায় কারেন্ট খেলে যাওয়া অবস্থা, কিন্তু বাঘ ডাকল আর আমরা শুনতে পেলাম না কেন? এমন ট্যালা আমরা সবাই?
নাকি আমাদের মোর অর লেস জানাই ছিল, গোরা কাকুর কেমন নাক ডাকে!