নজরুলের কফিন রহমানের পেরেক

AR Rahman version of Nazrul Islam's song: আমরা রহমানের বাপবাপান্ত করার আগে প্রশ্ন করছি না, এই প্রকল্পে তো বহু বাঙালি কাজ করেছেন।

বাঙালি চটেছে। বলা নেই কওয়া নেই তার প্রাণপ্রিয় কবি নজরুল ইসলামের গান বিকৃত করা হয়েছে। এই কর্মকাণ্ডের মূল কারিগর, যে সে লোক নন, সাক্ষাৎ এ আর রহমান। সাঙ্গীতিক জ্ঞানকাণ্ডের নানা দিক— সুরারোপ, গান লেখা, গাওয়া, সঙ্গীত পরিচালনা- সবেই তিনি ছাপ রেখেছেন, পুরস্কৃতও হয়েছেন। ছ'টা ন্যাশানাল অ্যাওয়ার্ড, দুটো অ্যাকাডেমি, দুটো গ্রামি, একটা গোল্ডেন গ্লোব, পদ্মভূষণ— কী নেই রহমনের ঝোলায়! সেই লোক কিনা নজরুলের গান বিকৃত করল! ফেসবুকে তামাম বাঙালি বলছে, ধর ব্যাটাকে চেপে এক্ষুনি। এই সব ট্যু-মিনিট ইনস্ট্যান্ট নুডল জাতীয় রাগের আড়ালে কিছু কথা চাপা পড়ে যাচ্ছে অথবা ধরা পড়ে যাচ্ছে বাঙালির চরিত্র, যে চরিত্রের গুণে সে যাবতীয় দায় ঝেড়ে ফেলে, কেবল পরের দিকে আঙুল তোলে।

আমরা রহমানের বাপ-বাপান্ত করার আগে প্রশ্ন করছি না, এই প্রকল্পে তো বহু বাঙালি কাজ করেছেন, তাঁরা কেন এই প্রকল্পের বিরোধিতা করলেন না? অর্থের জন্যে? যশের লোভে? অবশ্য যে কোনো বিরোধাভাসে পৌঁছনোর জন্য সবার আগে হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্য থাকা প্রয়োজন। এই ঘটনাটি ঘটার আগে 'কারার ওই লৌহকপাট গানটির' কি আদৌ কোনো সমাদর ছিল? এই গানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইতিহাস কি জানা ছিল শিল্পীদের? শিল্পীদেরই বা কেন কাঠগড়ায় দাঁড় করাই, বিরোধিতা করছেন যারা তারাও কি গানটিকে ছেলেমেয়ের স্কুলের ১৫ অগাস্টের গানের অতিরিক্ত কিছু ভাবতে পেরেছিলেন? এখনও কতজন মানুষ জানেন এই গানটির হয়ে ওঠার ইতিহাস? আমরা সেই জাতির প্রতিনিধি  যারা অস্মিতা বিষয়ে উদাসীন হবো, নিজস্ব সংস্কৃতি বিষয়ে পল-অনুপল বীতরাগ থাকব, সংরক্ষণের প্রশ্নে আলস্যে চোখ বুজে আসবে। আর রাস্তায় ফেলে রাখা ধনরত্ন চুরি গেলে, দিনান্তে শোকগাথা লিখে চোরের শ্রাদ্ধ করব সোশ্যাল মিডিয়ায়।

খুব স্পষ্ট ভাষায় বলে রাখা জরুরি— রহমানের আগে, নজরুলের শিল্পসত্তাকে যথেচ্ছ হেলাশ্রদ্ধা করেছে বাঙালি নিজেই। বারবার তাঁর কাব্য-গান বিকৃত করেছে বাঙালিই। ইতিহাস বলছে, পাকিস্তান জমানায় পূর্ববঙ্গে নজরুলের কবিতায় ইচ্ছে মতো কাঁচি চালানো হয়েছে। ধরা যাক, এই কারার এই লৌহকপাটের মতোই প্যারেডের ছন্দে বাঁধা গান 'চল চল চল'-এর অংশবিশেষের কথা—

নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মশান,
আমরা দানিব নতুন প্রাণ
বাহুতে নবীন বল!

বাংলাদেশ গড়ে ওঠার আগে, একটা লম্বা সময় পূর্ব পাকিস্তানে এই মহাশ্মশানের জায়গায় গোরস্থান গাইতে হতো বাধ্যতামূলক ভাবে। হিন্দু পুরাণের ছোঁয়াচ আছে বলে নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত গাওয়া বাজাত না পাকিস্তান রেডিও। এমনকী বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এই ছুঁৎমার্গ দীর্ঘকাল বজায় ছিল। যদিও ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি আয়োজিত বাংলাদেশের তৎকালীন মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই বাংলাদেশের রণ-সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল।

নজরুল বাকশক্তি হারিয়েছিলেন ১৯৪২ সালে। সবাক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি দাঙ্গাহাঙ্গামার বিরোধিতা করেছেন, নিজের লেখায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে সবচেয়ে বড় জায়গা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অসুস্থতার পরের কয়েক বছরে লাগাতার দাঙ্গা দেখেছে বাংলা, আর ক্রমেই কোণঠাসা হয়েছে নজরুলের আদর্শ। কোণঠাসা হয়েছেন তিনি নিজেই। পূর্ববঙ্গে হিন্দু ঘেঁষা শব্দের জন্যে যে নজরুল কাঠগড়ায় উঠেছেন, পশ্চিমবঙ্গে সেই নজরুলের ইসলামি সঙ্গীত, মুর্শেদি গান গণস্মৃতি থেকে স্রেফ মুছে ফেলা হয়েছে সযত্নে। নজরুল রক্ষায় ব্রতী ফেসবুক বোদ্ধারা কি একটিও নজরুলের ইসলামি গানের কথা মনে করতে পারবেন?  সুযোগ বুঝে পরকে আঁচড়ে খিমচে সাধ মেটানোর আগে, আমরা কি একবার নিজেদের দিকে তাকাব? নজরুল রচনাবলীর মতো অসম্পাদিত, যুক্তিবিবর্জিত, অসংলগ্নতায় ভরা কাজ আর দুটো নেই— এ কথাটা আজ এই সংকটে স্মরণ করা যাক?  সংরক্ষণের প্রশ্নে নজরুলের মতো অবহেলিত আর দ্বিতীয় কেউ নেই, এ কথাটা উচ্চারণ করার সৎসাহস কি হবে  আমাদের? ভুল বলেছি মনে হলে, এবার শীতে নজরুল কলকাতা শহরে যে বাড়িগুলিতে থাকতেন তা একবার ঘুরে দেখে নিন না! এই অধমকেই তো নজরুলের বাড়ির ছবি তোলার সময়ে এক প্রোমোটারের মুখে এই শহরেই শুনতে হয়েছিল, ইয়ে নজরুল কৌন হ্যায় ভাই!

এ পর্যন্ত পড়ে অনেকেই নিশ্চয়ই মনে করবেন, আমি এ আর রহমানকে সমর্থন করছি। সত্য হলো, আমার সমর্থনে অসমর্থনে রহমনের কিছু এসে যাবে না। তিনি আর্থিক, সামাজিক কাঠামো অনুযায়ী যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তার কাছে মামুলি কলমচির কথা পৌঁছবেই না। কিন্তু তারপরেও দায় থাকে। অন্তত কারার এই লৌহকপাট গানটি যে সময়ে নজরুল লিখেছেন, সেই সময়কাঠামো নিয়ে লম্বা সময় কাজ করার দরুণ মতামত দেওয়ার দায় থাকে। আর এক্ষেত্রে আমার মত স্রেফ একটি হ্যাঁ বা একটি না-এ সীমাবদ্ধ থাকবে না।

ভিন্নরুচির অধিকারকে স্বাগত জানানোই গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাজ। সেই কারণেই রোদ্দুর রায় যখন তার রুচিতে বা ইচ্ছেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান নিয়ে তুর্কিনাচন নাচেন, অনেকের মতোই আমার কিছু এসে যায় না। তাঁর আচরণ আমাকে স্পর্শই করে না। আমি স্থিরনিশ্চিত, রবীন্দ্রনাথকেও স্পর্শ করে না। দু'টি কারণে আমার এই বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গান বইয়ের পাতা থেকে ডিজিটাল বাস্তুতন্ত্রে এতই বেশি সুরক্ষিত যে নিভৃতে যে তাকে পেতে চায়, সে পাবেই। শত নির্বোধ গায়ক যেমন গানগুলিকে জীর্ণ করতে পারবে না, তেমন শত রোদ্দুর রায় মিলেও গানগুলিকে সমূলে বিনাশ করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথের যে ধরনের গানের বিকৃতি নিয়ে এ যাবৎ কথা হয়েছে, তা রবীন্দ্রনাথের কলাকৈবল্যবাদী সৃষ্টি। জীবনের নানা মুহূর্তে, নানা অভিজ্ঞতায় কবিমন সাড়া দিয়েছে। এ কথাটি সেই সৃষ্টির উচ্চতাকে একচুলও ছোট করতে বলছি না। এ লেখা শেষ করেই হয়তো বা আমাকে ফিরতে হবে সেই গানের কাছেই। শুধু বলতে চাইছি, বিকৃতির কবলে পড়া রবীন্দ্রগানের সঙ্গে উপমহাদেশের ইতিহাসে সরাসরি, জোরালো সম্পর্ক নেই। আর নজরুলের কারার ওই লৌহকপাট গানটি ঠিক এর বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে।

১৯২০ সালের মার্চ মাসে সেনাবাহিনীর ৪৯ নং বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে গেলে  নজরুল কলকাতায় আসেন। নজরুলের সেনাবাহিনী যোগদান সম্পর্কে তাঁর কামরাদারির বন্ধু মুজফফর আহমেদের মত ছিল, আর পাঁচজন ভারতীয়র মতোই সমরবিদ্যার কৃৎকৌশল জানতেই তিনি সেনায় যোগ দিয়ে থাকবেন। যদিও সে সময় বাহিনীতে বাঙালিকে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হতো না। কিন্তু নজরুল সেই সেনাজীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন জীবনে বারবার। 'কারার এই লৌহকপাট' গানটি লেখা হয় ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জেলযাত্রার পর তাঁর স্ত্রী বাসন্তীদেবী 'বাঙ্গালার কথা' সাপ্তাহিক পত্রিকার দায়িত্ব নিলে। বাসন্তীদেবীর অনুরোধে সাড়া দিয়েই নজরুল গানটির কাব্যরূপ সুকুমাররঞ্জন দাশ মারফত তাঁর কাছে পাঠান।  'ভাঙার গান' শিরোনামে 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার '২০ জানুয়ারি ১৯২২' সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এই গান। সে বছরেই নজরুলের ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ হবে। সেই পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতার আনন্দময়ীর আগমনের জন্যে তিনি রাজরোষে পড়বেন। একের পর এক বই নিষিদ্ধ হবে তার। 'বিষের বাঁশি', 'ভাঙার গান', 'প্রলয় শিখা', 'চন্দ্রবিন্দু', 'যুগবাণী'— নজরুলের নিষিদ্ধ গ্রন্থের তালিকা দীর্ঘ। পরাধীন ভারতে আর দ্বিতীয় কোনো বাঙালির এত গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়েছিল বলে জানা যায় না। উল্লেখ্য, এই নিষিদ্ধ গ্রন্থ ভাঙার গান-এই সংকলিত হয় উক্ত গানটি।

গানটির সুরাঙ্গ তৈরির ক্ষেত্রে নজরুল বেছে নেন সেই সামরিক মার্চ বা প্যারেডের সুর। বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর ২৫ বছর গানটির নথি হিসেবে কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু গানটি ঘুরেছে জেল থেকে জেলে, পাকা জায়গা করে নিয়েছে গণস্মৃতিতে। ১৯২৯ সালে অ্যালবার্ট হলে নজরুল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ঘোষণা করেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে নজরুলের গান গাওয়া হবে, কারাগারেও আমরা তাঁর গান গাইব।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্য নিষিদ্ধ গ্রন্থের মতোই ভাঙার গান গ্রন্থটি প্রকাশ হলে, ১৯৪৯ সালে গানটির লিখিত রূপ ফের সামনে আসে ন্যাশানাল বুক এজেন্সির সৌজন্যে। গানটি রেকর্ড করেন গিরীন চক্রবর্তী। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন নামক চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহৃতও হয়।

এইখানে, আরও একবার, খুব স্পষ্ট ভাবে বলতে চাই— উপমহাদেশে র‍্যাপ মিউজিকের প্রথম সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন নজরুল ইসলাম। উপমহাদেশে পাওয়ার পোয়েট্রি ধারার জন্মদাতা নজরুল ইসলাম। তাঁর রাজনৈতিক কবিতায় অনুপ্রাস আর সুরের মিশেল মস্তিষ্কের ধাক্কা দেওয়ার কাজ করে। সত্তরের দশকে পশ্চিমে জনপ্রিয় হওয়ার আগে এই ধারাটি উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করেছে নজরুলের হাত ধরে। হ্যাঁ, নজরুল এই শব্দটি দিয়ে তাঁর গানকে চিহ্নিত করেননি। কিন্তু প্রান্তিককে স্বর দিতে, কালো মানুষকে শক্তি দিতে, তার আবেগকে মর্যাদা দিতে,  মঞ্চ দিতে যে ভাবে ধ্বনিকে, শব্দ-সুর— এই সাঙ্গীতিক ঘরানাকে পশ্চিমী দেশের সমাজ আন্দোলনকারীরা ব্যবহার করেছেন, নজরুলও তাঁর বহু গান ঠিক সেই কার্যকারণেই নির্মাণ করেছেন। ব্যবহার করেছেন দাসত্ব শৃঙ্খল পায়ে জড়ানো নিম্নবর্গকে ভাষা দিতে।

গোটা বিশ্বে, বিশেষত ডিজিটাল দুনিয়া অ্যালগোরিদমের দৌলতে এই মুহূর্তে এ আর রহমানের নাম ও কাজ নজরুল ইসলামের থেকে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। আগেই বলেছি, ডিজিটাল দুনিয়ায় রবীন্দ্রনাথের মতো নজরুল সুসংরক্ষিত নন। কাজেই কারার এই লৌহকপাট গানটির রহমানকৃত রূপটি মূল গানের থেকে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে চোখের নিমেষে। বিপদ এখানেই। রহমানের ভাটিয়ালির চাপে মূল গানটি ক্রমেই বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। আরও একবার মনে করিয়ে দিতে চাই, এই গানটি বিকৃত হওয়া মানে কেবল একটি গানের, একটি কল্পনার বিকৃতি বা বিনির্মাণ নয়। আদতে তা ক্ষমতা ব্যবহার করে ইতিহাসের বিলোপসাধনের কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রচেষ্টা। ঠিক যেমন করে ইতিহাস বিলোপ করে বিজেপি। ফারাক এই, বিজেপি কাজটা জেনেবুঝে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে করে। রহমান হয়তো উদ্দেশ্যহীন ভাবেই এমন প্রচেষ্টা সামনে আনলেন।

অনেকেই চাইছেন, এবার রহমান সর্বোচ্চ শাস্তি পান। আসলে এই গানটি বিকৃত করা বা না করা আইনি বিষয়ই নয়। এর প্রত্যুত্তর খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে গণশুনানিও নয়। এটা মূল্যবোধের প্রশ্ন, ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়— এসব আমরা হারিয়েছি সেই কবেই।

প্রশ্ন হলো, বাঙালি এবার কী করবে! নজরুল সংরক্ষণে ব্রতী হবে?  আমার ধারণা বাঙালি স্রেফ ফেসবুক করবে। তার সমস্ত বিপ্লবই একদিনের। প্যাভলভের সূত্র সেই কবেই বলেছে— ঘণ্টাধ্বনি হলেই সারমেয়র লালাক্ষরণ হবে।

More Articles