বিনয় ও চাকারা আছেন একত্রে বইয়ের পাতায়

Binoy Majumdar: বিনয় মজুমদারের একদিন ছুটি হয়ে গেল। বিকেল ২২ নং বেডে গিয়ে দেখি কেউ নেই, বিছানা খালি। ঘরের চৌকি শূন্য।

'গতাসু শব্দের অর্থ পৃথিবীর মানুষ জানে না'। কাগজ-কলম টেনে নিয়ে এই প্রথম লাইনটাই লিখলেন বিনয় মজুমদার। অসুস্থ বিনয় ভর্তি কলেজ স্ট্রিট ইডেন হাসপাতালের এজরা বিল্ডিংয়ে। এক তলায় ডান দিকের ঘরে ২২ নং বেডে কবির ঠিকানা। ‘গতাসু’ শব্দের অর্থ সত্যিই তখন আমার জানা নেই। যেমন জানা ছিল না, ‘গতাসু শব্দের অর্থ পৃথিবীর মানুষ জানে না’ একটি আঠারো মাত্রার মহাপয়ার।

কলেজ স্ট্রিটকে তখন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যের মতো কলেজ স্ট্রিটের আয়না বলে মনে হতো। সেই যে সন্দীপন লিখেছিলেন, ‘বিজনের খেয়াল হল বৃষ্টি থেমে গেছে, শোকের মতো এখন পড়ছে, ওড়াওড়ি করছে হওয়ায়’। ঠিক সেরকম না হলেও বৃষ্টি থামার পর বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে শেষ বিকেলের আলোয় যেন গতজন্মের স্মৃতি। হর্ম্যের চূড়ায় বিঁধে ঠিকরে পড়ে রোদ। অমলের বইয়ের দোকান। খালেদের সিগ্রেট। কফিহাউজের পোস্টার-কোলাজ সিঁড়ি কুণ্ডলী পাকিয়ে এক গভীর ধোঁয়ার সুড়ঙ্গে ঢুকে যায়।

এরপর পর পর বেশ কয়েকদিন বিনয় মজুমদারকে দেখতে গেলাম। আমার এক বন্ধু সব্যসাচী ভৌমিক। থাকত হাওড়া গোলবাড়ির কাছে। দু’জনে মিলে বিনয়ের সামনে গিয়ে বসতাম। কবি কখনও কখনও কথা বলতেন। কখনও তারজালটানা জানালার বাইরে তাকিয়ে কী দেখতেন। শূন্যে আঙুল দিয়ে আঁক কাটতেন। কী লিখতেন? গণিতের কোনও জটিল উপপাদ্য? সিস্টার এসে বলতেন, 'নিন এই ওষুধটা এবার খেয়ে নিন'। বিনয় ফিরেও তাকাতেন না কখনও কখনও।

বিনয় লিখলেন: চৌকি দ্যায় যে ব্যক্তি তার নাম চৌকিদার হয়। আমিও একদা চৌকিদারই ছিলাম আর...পরের লাইনে: আমার ঘরের চৌকি শূন্য পড়ে আছে। লিখেই, সটান ঢুকে পড়লেন ডাফরিন হাসপাতালের পাশের গলি স্কট লেনে। লিখলেন, দূর থেকে চেয়ে দেখি, প্রসূন আমার কাছে কবিতা চেয়েছে... এজরা বিল্ডিংয়ের ২২নং বেডের রং-চটা দেওয়াল। বিনয় মজুমদারের দৃষ্টি গণিতের জটিল আঁক মনে মনে মুহূর্তে সমাধান করছে। একবার অ্যাসেন্ডিং। পরের মুহূর্তে ডিসেন্ডিং। ঘরের কোনায় কোনায় দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে, উঠে বসছে, ফের বনবন ঘুরছে তাঁর চাকা। হাসপাতালের বাইরে ঘুরে চলেছে মাথাখারাপ করা এক বিকেল। কবির আঙুলের নখ শক্ত হয়ে পাকিয়ে গিয়েছে। ‘আমার আঙুলগুলো দেখেছ?’ সুকিয়া স্ট্রিটের এক ছাপাখানায় নির্মাণ হচ্ছে এক প্রচ্ছদের।

আরও পড়ুন: বিনয় মজুমদার: আমার তিন টুকরো স্মৃতি

মনখারাপের এক অবিশ্রান্ত শ্রাবণ সেসময় মাথার ভিতর কালচে সবুজ বাটির মতো উপুড় হয়ে থাকত। স্নায়ু বিপর্যয়ের শিখা কেরোসিন শেষে নিভে যাওয়ার আগে মাঝে মধ্যেই যেমন দপদপ জ্বলে, বিনয় মজুমদারের চোখ জ্বলে উঠত ২২ নং বেডে। আর তাই বিনয়কে নিয়ে ভাবতে শুরু করি। লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত পাতলা চটি পুস্তিকা, ‘গায়ত্রী’কে সংগ্রহ করি। ঝোলায় ভরে রেখে দিই। সঙ্গে নিয়ে ঘুরি নিজস্ব যাপনে।

হাসপাতাল ছেড়ে বেরতে বেরতে সন্ধে হয়ে যায়। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। পাখিরা ফিরছে। ঝাঁকড়া গাছগুলোর ভিতর সম্মেলন করছে। হাসপাতালের উল্টোদিকের সিঁড়িতে উদ্বিগ্ন মানুষ-স্বজনের ভিড়। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে ভিজিটিং আওয়ার্স। কারও মৃত্যু-সংবাদে শ্মশান-গোঙানির শব্দ। পাখিরা ফিরছে। হাসপাতাল পার করে মর্গের পাশের দমচাপা গলির ভিতর দিয়ে আমরা কয়েক জন চলি কোহলের সন্ধানে। সঙ্গে বিনয়ের কবিতা। ‘গতাসু’ শব্দের অর্থ পৃথিবীর মানুষ জানে না।

বিনয় মজুমদারের সঙ্গে এই কয়েক দিনের সাক্ষাৎ মনোজগতে এক বিপুল প্রভাব নিয়ে এল।  আর্জেন্টিনার এক বিখ্যাত সিনেমা নির্মাতার ছবি দেখেছিলাম, ‘ডোন্ট ডাই উইদাউট টেলিং মি হোয়ার য়্যু আর গোয়িং।’ এলিসেও সুবিয়েলার ছবি। যে ছবির শুরুতে স্বপ্নকে সংগ্রহে রাখার কথা বলেন এক যুবক। প্রিয় সমাধিফলকের সামনে একা দাঁড়িয়ে সে। হুলস্থুল হাওয়া দিচ্ছে। ছবির ফ্রেমে এক নারীর মুখ। পিয়ানো বেজে চলেছে টানা। আলো উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেই যুবক অতীতকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। বিনয় মজুমদার চোখের নক্ষত্র হাসপাতাল ঘরের দেওয়ালে কোনায় কোনায় ছটফট করে কী যেন দেখতে চাইছে। তা কি অতীত? অতীতের ভবিষ্যৎ? নাকি ভবিষ্যতের অতীত?

পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্থলী
দীর্ঘ-দীর্ঘ ক্লান্তশ্বাসে আলোড়িত করে
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা।

চিরকাল দূরে দূরে থেকে মিলনের শ্বাসরোধী কথা। পরাগ সংযোগের কথা। আচ্ছা মিলন কেন চিরকাল শ্বাসরোধী? বিনয় মজুমদারের সঙ্গে এই কয়েক দিনের সাক্ষাৎ মনোজগতে এক বিপুল প্রভাব নিয়ে আসে। বাতাসে ওড়ে তুলোফুল। কখনও আবার ভ্রমরের গূঢ় অন্ধকারে নিঝুম হয়ে যায় হাসপাতাল বারান্দার সেই করিডর। হলুদ টেবিলের উপর জেগে ওঠেন অসম্ভব শুভ্র অ্যাপ্রন পরিহিত এক সিস্টার। কোনও এক বাংলার রাতে ইউরিনালের তীব্র জ্বালার পাশে, একা পুড়ে যাওয়া অনন্য তারার মতো চরম তাপমাত্রায় ঘুমিয়ে পড়ি।

বারবার অসুস্থ হয়ে পড়়তে লাগলেন বিনয় মজুমদার। পরে অগ্রজদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, আটের দশক থেকেই বিনয়ের ঠিকানা হয়েছে হাসপাতাল। কিছুদিন চিকিৎসার পর ফিরে গিয়েছেন ঠাকুরনগর। ফের কলকাতার হাসপাতালে। বিনয়ের মস্তিষ্ক গণিতের। ক্যালকুলাস ছিল পছন্দের বিষয়। কাব্যগ্রন্থের নাম দেন, ‘আমিই গণিতের শূন্য’। ঠাকুরনগর স্টেশনের ২ নং প্ল্যাটফর্মে বসে নাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ক্যালকুলাস, লগারিদমের আঁক কষতেন। হয়ত বিনয়ের মস্তিষ্কের এই কাঠামো, এই অনন্ত গাণিতিক জগৎ সম্পর্কের ফলাফল, কবিকে বিপন্ন মরাল করেছে। যে মরাল অবিরাম পলায়ন করে। যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে রয়েছে উদগ্র মাংস আর মেদ...

বিনয় মজুমদারের একদিন ছুটি হয়ে গেল। বিকেল ২২ নং বেডে গিয়ে দেখি কেউ নেই, বিছানা খালি। ঘরের চৌকি শূন্য। এক চৌকি ছেড়ে আর এক চৌকিতে আশ্রয় নিয়েছেন বিনয়। গোটা এক জীবনে একজন মানুষ কত বিছানার শরীরে মিশে থাকেন? কত বিছানা সেই মানুষের শরীরের কথা মনে রাখে? মিলনের শ্বাসরোধী কথা মনে রাখে? নাকি কখনও মিলন হয়নি বলেই কবির মরাল বিপন্ন? যে মিলন চায় আকাঙ্খার উদগ্র মাংস আর মেদ? কবি কি তাঁর আকাঙ্খিত নারীর সঙ্গে কখনও মিলিত হননি?

আরও পড়ুন: ‘আমি বিনয় চণ্ডাল’ : এক পংক্তির কবিতার দলিত পাঠ

সুকিয়া স্ট্রিটের এক ছাপাখানায় প্রস্তুত হলো কবির হাতের লেখা প্রচ্ছদ। বিজল্পে নয়ের দশকের কবিদের সংকলনে, মুখ হয়ে থেকে গেলেন বিনয় মজুমদার। আরও অনেক পরে পত্রিকার পাতায় কবির ছবি। ছোট করে ছাঁটা চুল। কেরোসিন ফুরিয়ে আসার আগে দপ করে জ্বলে ওঠা সেই শিখা, চোখের নক্ষত্র আরও কোটরে ঢুকে গিয়েছে। বাঁ-হাত সব সময় কাঁপে। মিলনের আর্তি আকাঙ্খাও হয়তবা ফুরিয়েছে। জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার।

আমার মাথার চুল ছোট করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোট করে ছাঁটা...

আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে
চিঠি লিখব না

আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।

দেখি কবি বলছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে সেই নারীর ঠিকানা জোগাড় করে দিতে। শক্তি চিঠি লিখে বলছেন, 'চেষ্টা চলছে।'

'অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে তোমার মুখ অশ্রু ঝলোমলো, লিখিও উহা ফিরত চাহ কি না'...

 

More Articles