রামকৃষ্ণ-সারদা-স্বামীজির স্মৃতি ছড়িয়ে, উইকএন্ডে ঘুরে আসুন ঘরের কাছের এই তীর্থে

স্বামী বিবেকানন্দর স্মৃতিধন্য এই গ্রামে এলে মনের মধ্যে ভক্তিরস জারিত হবেই, তা নিশ্চিত।

 

একথা নতুন করে বলার দরকার হয় না যে, বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। শনিবার এলেই মনটা যেন উড়ুউড়ু। তার ওপর সবসময় তো আর রেস্তো পারমিট করে না। কাজেই ঘরের কাছে পকেট ফ্রেন্ডলি ছোট ট্যুর কে না চায়? তাও আবার যদি সেই জায়গায় মিশে থাকে ইতিহাসের গন্ধ, তাহলে তা যে আপনাকে টানবেই, তা বলাই বাহুল্য। তাহলে আপনার ভ্রমণের তালিকায় টুক করে টুকে নিন আঁটপুর গ্রামের নাম। স্বামী বিবেকানন্দর স্মৃতিধন্য এই গ্রামে এলে মনের মধ্যে ভক্তিরস জারিত হবেই, তা নিশ্চিত। তাহলে হাতের নাগালে থাকা ব্যাগে দু'-একটা জামা ভরে বেরিয়ে পড়ুন।

 

স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুভাইদের স্মৃতিবিজড়িত গ্রাম আঁটপুর। ১৭০৮ সালে তৈরি মিত্রদের রাধাগোবিন্দের আটচালা শৈলির মন্দিরটির টেরাকোটার কাজ অতুলনীয়। বাংলার প্রাচীন কাঠ খোদাইয়ের অন্যতম নিদর্শন মেলে কাছের চণ্ডীমণ্ডপে। স্বামীজির গুরুভাই স্বামী প্রেমানন্দের জন্মস্থান আঁটপুর। আঁটপুর মন্দিরময়। নদীর ধারে অবস্থিত আঁটপুর গ্রামটি আটটি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত৷ আটটি গ্রাম তড়া, বোমনগর, কোমরবাজার, ধরমপুর, আনারবাটি, রানিরবাজার, বিলাড়া, লোহাগাছি। বর্ধমানের রাজা তিলকচন্দ্র বাহাদুরের দেওয়ান কৃষ্ণরাম মিত্র বৈদ্যবাটির নিমাইতীর্থের ঘাট থেকে গঙ্গাজল, গঙ্গামাটি এনে সেই মাটি পুড়িয়ে তাতে ইট তৈরি করে রাধাগোবিন্দের মন্দির নির্মাণ করেন। টেরাকোটার কাজের জন্য তিনি বিষ্ণুপুর থেকে মৃৎশিল্পী আনান। মন্দিরটি প্রায় ১০০ ফুট উঁচু৷ মন্দিরের সম্মুখভাগে ও দুই পাশের দেওয়ালে অজস্র টেরাকোটার প্যানেল আছে। সামাজিক দৃশ্য থেকে পৌরাণিক দৃশ্য সবই দেখা যায় টেরাকোটার ক্ষুদ্র প্যানেলগুলোতে।

 

শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদা মায়ের আগমন
১৮৫৪ সালে দুর্গাপুজোর সময় শ্রীরামকৃষ্ণ আঁটপুরের  জমিদার রামপ্রসাদ মিত্রর বাড়িতে আসেন। আবার পরবর্তীকালে ১৮৮৮ এবং ১৮৯৪ সালে শ্রীমা জমিদার তারাপদ ঘোষের বাড়িতে আসেন এবং দ্বিতীয়বার তাঁর উপস্থিতিতে সেখানে দুর্গাপুজো হয়। এসব ঘটনাগুলো পরবর্তীকালে আঁটপুরকে ইতিহাসে এক অতি মাহাত্ম্যপূর্ণ স্থানে পরিণত করেছে।

 

আরও পড়ুন: ভেসে এল দুটো পাথর, স্বপ্নাদেশে তাই হলো রাধা-কৃষ্ণর মূর্তি! গঙ্গার ঘাটগুলোতে লুকিয়ে যে ইতিহাস

 

স্বামীজির স্মৃতিবিজড়িত
শ্রীশ্রীঠাকুরের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর শোকে নরেন্দ্রনাথ,  বাবুরাম প্রমুখ ঠাকুরের নয়জন শিষ্য বাবুরামের  (পরবর্তীকালে স্বামী প্রেমানন্দ) জন্মস্থান আঁটপুরে যান। তাঁর মায়ের নিমন্ত্রণ পেয়ে ১৮৮৬ সালের ডিসেম্বরে সেখানে পৌঁছন তাঁরা। এবং বাবুরামের গৃহে কিছুদিন থাকেন। ভগবৎচিন্তা ও ঈশ্বরসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। বাবুরামের বাবা ছিলেন আঁটপুরের জমিদার তারাপদ ঘোষ ও মা মাতঙ্গনী দেবী। সেই সময় ২৪  ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ধুনি জ্বালিয়ে তার চারপাশে বসে তাঁরা গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন এবং ধ্যানান্তে যিশুখ্রিস্টের ত্যাগদীপ্ত পূত জীবনের কথা আলোচনা করতে করতে জগৎকল্যাণে তাঁরা সংসার ত্যাগ ও একটি সংঘ স্থাপনের সংকল্প গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে স্বামী শিবানন্দ পরবর্তীকালে বলেন, "আঁটপুরেই আমাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার সংকল্প দৃঢ় হল। ঠাকুর তো আমাদের সন্ন্যাসী করে দিয়েছিলেন- ওই ভাব আরও পাকা হল আঁটপুরে।"

 

ততক্ষণে সন্ধে পেরিয়ে গেছে। বেশ রাত। তারায় ভরা আকাশ। সামনে জ্বলছে ধুনি। ধ্যানে নিমগ্ন ন’টি যুবক। শ্রীরামকৃষ্ণের নয় ভক্ত। শেষ হল ধ্যান। শুরু হল ঈশ্বর নিয়ে আলোচনা। সেখানে মূল কথক অবশ্য একজনই। বাকিরা শ্রোতা। যিশুখ্রিস্টের জীবনকথা শোনালেন তিনি। অনেকের ত্যাগের মধ্য দিয়ে কীভাবে খ্রিস্ট ধর্ম ও খ্রিস্ট সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে তা শোনালেন। তিনি বোঝালেন, জগৎকল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করতে হলে ত্যাগই বড় কথা। আর এর প্রথম ধাপ হল সংসারত্যাগ। ন’জন গুরুভ্রাতা উঠে দাঁড়ালেন, ধুনির অগ্নিশিখাকে সাক্ষী করে সংকল্প করলেন মানুষের স্বার্থে সংসার ত্যাগ করবেন। সন্ন্যাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন নরেন্দ্রনাথ (বিবেকানন্দ), বাবুরাম (প্রেমানন্দ), শরৎ (সারদানন্দ), শশী (রামকৃষ্ণানন্দ), তারক (শিবানন্দ), কালী (অভেদানন্দ), নিরঞ্জন (নিরঞ্জনানন্দ), গঙ্গাধর (অখণ্ডানন্দ) এবং সারদা (ত্রিগুণাতীতানন্দ)। বাবুরামদের বাড়িই সেই পুণ্যতীর্থ। আজ সেখানে হয়েছে ধুনিমণ্ডপ। মণ্ডপের গায়ে বিবেকানন্দ-সহ নয় সন্ন্যাসীর খোদাই করা মূর্তি। এর চার দিকে পোড়ামাটির কাজে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী ও তাঁর কথা বিধৃত।

 

কী দেখবেন
আঁটপুরের সবথেকে বিখ্যাত মন্দির হল রাধাগোবিন্দজিউ মন্দির। এটি প্রায় ১০০ ফুট উঁচু। বর্ধমান রাজের দেওয়ান কৃষ্ণরাম মিত্র এই মন্দিরটি তৈরি করেন। মন্দিরটির গায়ে অসাধারণ টেরাকোটা বা পোড়ামাটির কারুকার্য আছে। মন্দিরের ভিতের ইটগুলো গঙ্গামাটি ও গঙ্গাজলে তৈরি। টেরাকোটার বিষয়গুলি নেওয়া হয়েছে ১৮টি পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, ভারতের ইতিহাস এবং মন্দির গড়ার সমসাময়িক বিষয় থেকে। মন্দিরটির চণ্ডীমণ্ডপ এবং দোলমঞ্চে কাঠের কারুকার্য আছে।

 

রাধাগোবিন্দজিউ-র মূল মন্দিরটি ছাড়াও এখানে রয়েছে আরও পাঁচটি শিবমন্দির। এগুলোর নাম হল যথাক্রমে গঙ্গাধর, রামেশ্বর (বড়শিব), বাণেশ্বর, জলেশ্বর, ফুলেশ্বর, এছাড়া রয়েছে দোলমঞ্চ। প্রত্যেকটি শিবমন্দিরের গায়েই টেরাকোটার কারুকার্য রয়েছে।

 

রাধাগোবিন্দজিউ-র মূল মন্দিরের উত্তরদিকে রয়েছে খড়ের ছাউনির চণ্ডীমণ্ডপ। এটি অসাধারণ কাঠের কাজের অন্যতম নিদর্শন। এটি প্রায় তিনশো বছরের পুরনো এবং এর গায়ে কাঁঠালকাঠের অসাধারণ কারুকার্য আছে।

 

রাধাগোবিন্দজিউ মন্দিরের সামনে রয়েছে ঐতিহাসিক বকুল গাছ। এই পূজাবেদিতে এখনও দুর্গাপুজো এবং শ্যামাপুজো হয়। এই মন্দিরটির ঠিক সামনেই প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো একটি বকুল গাছ আছে। গাছটি বহু ইতিহাসের সাক্ষী।

 

কীভাবে যাবেন?

ঘরের কাছেই, কাজেই ঝক্কি কম, সহজ রুটম্যাপ হল:

সড়কপথে: গাড়িতে গেলে কলকাতা থেকে রাজবলহাটের দূরত্ব প্রায় ৬১ কিমি, সময় লাগবে দুই ঘণ্টার মতো, কাছেই আঁটপুর রামকৃষ্ণ মঠ।

রেলপথ: ট্রেনে হাওড়া থেকে তারকেশ্বর, আরামবাগ বা গোঘাট মেন লাইনের লোকাল ট্রেনে চেপে হারিপাল স্টেশন, ওখান থেকে অটো বা গাড়ি রিজার্ভ করলে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ট্রেকার বা বাসে ২০ টাকা ভাড়া।

থাকবেন কোথায়: রাজবলহাট ভারত সেবাশ্রম অতিথি নিবাসে থাকতে পারেন। আঁটপুর রামকৃষ্ণ মঠের অতিথি নিবাসেও থাকার সুব্যবস্থা আছে। রুকস্যাক কাঁধে নেওয়ার ঝক্কি নেই, সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ইতিহাসের গন্ধ নিতে ও ভক্তিরসে ডুব দিতে আপনার গন্তব্য হোক আঁটপুর।

More Articles