৬০০ কোটি পায়রাকে খুন করেছিল মানুষই! পৃথিবীর বুকে আর কখনও ফিরবে না যে প্রাণীরা
Extinct Animals: ১৯১৪ সালে পয়লা সেপ্টেম্বর প্যাসেঞ্জার পায়রা প্রজাতির শেষ পায়রাটি যার নাম ছিল মার্থা, মারা গিয়েছিল সিনসিনাটি চিড়িয়াখানায়।
এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম প্রাণীর স্বর্ণমুকুট যে প্রজাতির মাথায় সুসজ্জিত, তারা মানুষ। মানুষ অর্থাৎ আমরা পৃথিবীর বর্তমান অভিভাবক। এই শ্রেষ্ঠত্বের তকমা অবশ্য নিজেই নিজেকে দেওয়া, ওই অনেকটা নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ানোর মতো কার্যকলাপ আর কী! কিন্তু মানুষ কি কখনও ভেবে দেখেছে এই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট আদৌ তাদের মানায় কিনা? 'অভিভাবক' শব্দের অর্থ অনুধাবন করলে বোঝা যায়, যিনি লালনপালন করেন, যিনি আঙুল ধরে হাঁটতে শেখান, যিনি দুঃসময়ে বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া প্রদান করেন, দুর্যোগে আশ্রয় সাজেন, যিনি সন্তানদের প্রতি নিজের কর্তব্য যথাযথ পালন করেন, তিনিই! মানুষ কি কখনও ভেবে দেখেছে এই পৃথিবীর অভিভাবকত্বের উপযুক্ত আদৌ কি আমরা? কেন এরকম সন্দেহ?
পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও আরও লক্ষ কোটি প্রাণীর প্রজাতি আছে। আকাশে, বাতাসে, মাটিতে, জলে, জঙ্গলে, গাছে, ফলে, ফুলে সব জায়গাতেই বইছে প্রাণের মৃদুমন্দ বাতাস। প্রজাপতির পাখনার মতো রঙিন এ প্রাণ, কোকিলের কুহুর মতো মিঠে এ প্রাণ, হরিণের দুই নির্মল চোখের ন্যায় চঞ্চল এ প্রাণ, সিংহের গর্জনের মতো তীব্র এ প্রাণ, কাছিমের খোলসের মতো আশ্রিত এ প্রাণ, গাছের পাতার মতো সবুজ এ প্রাণ। আহা! কী যে নেশা এই প্রাণের উপস্থিতি উপভোগ করা! ডাইনোসরের অবলুপ্তির পর এই পৃথিবীর বুকে একচ্ছত্র রাজত্ব যদি কেউ করে থাকে তবে তা মানুষ। আর, এই মানুষ নামক প্রজাতির রাজত্বেই সবথেকে বেশি প্রাণের অবলুপ্তি ঘটে চলেছে। একটার পর একটা প্রাণী প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটছে মানুষের হাত ধরেই, মানুষের কাঁধ বেয়েই নেমে আসছে নির্মমতার তীক্ষ্ণ ফলা। আমাদের আজকের গল্প এমন দুই প্রজাতির প্রাণীকে নিয়ে যারা বর্তমানে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। মানুষের চরম নিষ্ঠুরতা, বিবেকহীনতা, অদম্য লোভ, ঘৃণ্য মানসিকতার সামনে তারা মাথা উঁচিয়ে রাখতে পারেনি নিজেদের প্রজাতিকে।
প্যাসেঞ্জার পিজিওন:
১৮৫০ সালের মে মাসে সাইমন পোকাগন নামক এক আদিবাসী মিশিগানের মানিসতি নদীর তীরে মাছ ধরছিলেন। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা একটা আওয়াজ তাঁকে খুবই বিচলিত করে। তাঁর জবানিতে, "মনে হল লক্ষ লক্ষ ঘোড়া যেন জঙ্গলের বুক চিড়ে আমার দিকে ধেয়ে আসছে। ধীরে আওয়াজটা যত স্পষ্ট হল তত মনে হল, না এটা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ নয়। বরং মনে হচ্ছে যেন এক নাগাড়ে বজ্রপাত হচ্ছে, অথচ আকাশ তো ঝকঝকে নীল। ধীরে ধীরে কালো হয়ে এল আকাশ। আমি দেখলাম কালো রঙের মেঘের মতো করে উড়ে আসছে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পায়রা। একসঙ্গে..."
আরও পড়ুন- মানুষ এক ছোবলেই ছবি! তবে কোন রহস্যে সাপের তীব্র বিষেও বেঁচে যায় বন্য প্রাণীরা?
প্যাসেঞ্জার পিজিওন বা পরিযায়ী পায়রা আকারে সাধারণ পায়রার থেকে বড়, মনোমুগ্ধকর রূপ, রঙচঙে পালক পিঠে নিয়ে এরা উড়ে যেত নর্থ আমেরিকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কখনও খাদ্যের খোঁজে, কখনও ডিম পাড়ার আদর্শ পরিবেশের সন্ধানে। এক গণনা অনুযায়ী, ১৮০০ শতাব্দীর শেষের কিছু দশকে এরা প্রায় সংখ্যায় ৬০০ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯১৪ সালে পয়লা সেপ্টেম্বর প্যাসেঞ্জার পায়রা প্রজাতির শেষ পায়রাটি যার নাম ছিল মার্থা, মারা গিয়েছিল সিনসিনাটি চিড়িয়াখানায়। জানতে ইচ্ছা করছে না যে কী এমন ঘটেছিল এই প্রজাতির সঙ্গে যা তাদের সংখ্যাকে মাত্র কয়েক দশকে ৬০০ কোটি থেকে শূন্যে পৌঁছে দিয়েছিল? উত্তরটা হল, মানুষ। মানুষের হিংস্রতা, মানুষের নির্মমতা একটা ৬০০ কোটির প্রজাতিকে মাত্র কয়েক বছরে শূন্যে নামিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু কীভাবে?
উত্তর আমেরিকার এই প্যাসেঞ্জার পায়রাদের একটা অদ্ভুত অভ্যাস ছিল। এরা সবসময় একসঙ্গে স্থান বদল করত। ফলস্বরূপ কোটি কোটি পায়রা যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় উড়ে যেত তখন শহরের বুক থেকে আকাশের দিকে তাকালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোটি কোটি পায়রা দেখা যেত। অন্ধকার নেমে আসত শহরের বুকে। মানুষ শুরু করল শিকার। খুব নিচু দিয়ে দলবদ্ধভাবে ওড়ার ফলে বন্দুকের এক একটা গুলিতে একসঙ্গে ডজন ডজন মৃত পায়রা মাটিতে এসে পড়ত। সেই প্রথম মানুষের মুখে এল প্যাসেঞ্জার পায়রার স্বাদ। অতীব সুস্বাদু মাংস মানুষকে আরও হিংস্র করে তুলল। দ্বিধাহীনভাবে চলতে লাগল শিকার। দেশ বিদেশ থেকে ছুটে এল শিকারি, খাদ্যলোভীরা। গড়ে রোজ অন্তত ৫০ হাজারের ওপর পায়রা মারা শুরু হল। শুধু উড়ন্ত পায়রা মেরে ক্ষান্ত না হয়ে মানুষ আরও লোভী হয়ে মারতে শুরু করল গাছে ডিম পেড়ে তা দেওয়া পায়রাদেরও। গাছের গোড়ায় সালফার পুড়িয়ে গোটা গাছে ছড়িয়ে দিল বিষাক্ত ধোঁয়া। হাজার হাজার পায়রা ধপ করে পড়ত গাছের ডাল থেকে। মানুষ একাধারে পায়রা মারল আবার অন্যদিকে তাদের প্রজননও করতে দিল না। খুব সহজ হিসাবে ৬০০ কোটির সংখ্যাটা শূন্যের দিকে ধেয়ে এল প্রবল বেগে।
মার্থা, মানে এই প্রজাতির শেষ পায়রাটি নিজের জীবনের শেষ বেশ কিছু বছর সম্পূর্ণ একলা কাটিয়েছিল সিনসিনাটি চিড়িয়াখানায়। রোজ সকাল থেকে রাত্রি তার কাটত চরম একাকীত্বে। বক-বক-বকম শব্দে মার্থা ক্রমাগত হয়তো ডেকে চলত তার সঙ্গীদের, ক্রমাগত হয়তো সে খুঁজতো নিজের প্রিয় সঙ্গীর ওম। বোকা মার্থা বোঝেনি সেই তার প্রজাতির শেষ প্রতিনিধি। ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর নিজের ২৯ বছর বয়সে মার্থা যেদিন ধপ শব্দ করে পড়ে যায় নিজের খাঁচার ডাল থেকে মাটিতে, সেদিনও মার্থা কি জানতে পেরেছিল মানুষ নামক এক প্রজাতির হিংস্রতার কাছে শেষ হয়ে গেল তাদের আস্ত প্রজাতি? কে জানে...
আরও পড়ুন- মিনারেল ওয়াটার আসলে জলহস্তীর প্রস্রাব! জলের এই অদ্ভুত তথ্য চমকে দেবে বিশ্বকে
কিকি- চিনের ইয়াংৎজে নদীর একটি ডলফিন:
চিনের বুকে প্রায় ১০০০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত একটি নদীর নাম হল ইয়াংৎজে নদী। এই নদীতে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এক বিশেষ ধরনের ডলফিনের প্রজাতি পাওয়া যেত। চিনের লোকেরা এই ডলফিনকে 'দেবী' বলে ডাকতেন। ২০০২ সালের পর চিনের সরকার ডলফিনের এই প্রজাতিটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এই বিশেষ প্রজাতির শেষ ডলফিনের নাম ছিল কিকি। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০২ সাল অবধি সে একলা কাটিয়েছিল একটি অ্যাকোয়ারিয়ামে। ২০০২ সালে এই বিশেষ প্রজাতির শেষতম প্রতিনিধিও বিদায় জানায় পৃথিবীকে। কিন্তু কী এমন হল যা ইয়াংৎজে নদীর বুকে থেকে কেড়ে নিল এই ২০ মিলিয়ন বছরের পুরনো প্রজাতিকে? এক্ষেত্রেও উত্তর সেই একই। মানুষ। দীর্ঘ সময় ধরে নদীর বুকে যথেচ্ছ ডলফিন শিকার, বড় বড় কলকারখানার দূষিত জল, নদীর বুকে মিশে যাওয়া প্লাস্টিক, প্রথমে এই বিশেষ প্রজাতির সংখ্যা কমিয়ে দিল। তারপর ফিশিং করে করে ধীরে ধীরে কেড়ে নিল এদের প্রিয় খাদ্য ছোট ছোট মাছদের। ১৯৮০ সালেও এই নদীর বুকে ডলফিনের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০-এর ওপর, যা ১৯৯৭ সালে এসে দাঁড়ায় মাত্র ১৩টিতে এবং ২০০২ সালে যার সংখ্যা নেমে আসে শূন্যতে। কিকি মারা যাওয়ার পর ৩০ জন বিজ্ঞানী মিলে তন্নতন্ন করে ইয়াংতজে নদীর বুকে খোঁজ চালায় এই প্রজাতির ডলফিনের। প্রায় ৬ সপ্তাহ পর তাঁরা জানান, গোটা নদীর বুকে একটিও ডলফিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিকি তার জীবনের দীর্ঘ ২২ বছর একটি বদ্ধ অ্যাকোয়ারিয়ামে একলা কাটাতে কাটাতে কী ভাবতো জানতে বড় ইচ্ছা হয়। তার কি নিজেকে খুব একলা মনে হতো? মন খারাপ করলে কার সঙ্গে কথা বলত কিকি?
মনুষ্য চরিত্র এমন এক চরিত্র যাদের পদতলে কোথাও গিয়ে মার্থা আর কিকি এক হয়ে যায়। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম প্রাণী, পৃথিবীর অভিভাবকের কিকি আর মার্থা নামক চারা গাছেদের পাশে বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল। তাই না?