এই সিরিয়াল কিলারের মূল নিশানা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষরা!
ইতিহাসের পাতা, টলি-বলি-হলিউডের রুপোলি পর্দা, ছোট পর্দার ইতিউতি এবং বইয়ের পর বইয়ের পাতা ওল্টালে জানা যায় এক সে বার কর এক সিরিয়াল কিলারদের লোম খাড়া করা কীর্তি কলাপ। এমনি খুনি এবং সিরিয়াল কিলারদের মধ্যে একটা প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, সিরিয়াল কিলাররা একটা খুন করে থেমে থাকে না। তারা একের পর এক খুন করতে থাকে একই প্যাটার্নে। একই উদ্দেশ্যে। ছোট থেকে আমরা যে সমস্ত সিরিয়াল কিলারদের গল্প শুনেছি, জেনেছি, পড়েছি বা দেখেছি তাদের বেশিরভাগের মুখ্যচরিত্রেই থাকেন কোনও পুরুষ। কিন্তু, আজ এই লেখায় আপনাদের মস্তিষ্কের ঘুলঘুলিতে দমকা বাতাসের মতো ধাক্কা মেরে এই সত্য কাহিনীর সিরিয়াল কিলার রূপে যিনি লিড রোলের সিংহাসনে বসবেন, তিনি একজন মহিলা; যিনি একটা নয়, দু'টো নয়, তিনটে নয়, করেছিলেন অন্তত ৯ খানা খুন। লোম খাড়া হয়ে উঠছে? আসুন তবে ডুব দেওয়া যাক গল্পের অথৈ রোমাঞ্চে।
সময়টা ২৪ জুন ১৯৪৯, বাবা মায়ের কোল আলো করে পশ্চিম জার্মানির রেহনবার্গে জন্ম নিলেন এক ফুটফুটে শিশু কন্যা। বাবা মা আদর করে নাম রাখলেন ব্রিগিতে মার্গারেট মোহনহাপ্ট। ব্রিগিতের বাবা কাজ করতেন একটি প্রকাশনী সংস্থায়। বয়স যখন মাত্র ১১, তখন বাবা মায়ের ডিভোর্স হলো। ব্রিগিতে মায়ের সঙ্গে থেকে গেলেন। ফিলজফি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করতে করতেই ১৯৬৮ সালে বিয়ে করলেন। কিন্তু সে বিয়ে টিকল না। মাত্র ২ বছরের মাথায় বিয়ে ভেঙে গেল। পড়াশোনা করতে করতেই কলেজ জীবনে তিনি জড়িয়ে পড়লেন বিভিন্ন সরকার বিরোধী মুভমেন্টের সঙ্গে। ১৯৬৯ সালে মিউনিখে ভিয়েতনাম ওয়ার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অংশ গ্রহণ করলেন। এই বছরেই তিনি মেম্বার হলেন 'সোশ্যালিস্ট পেশেন্টস কালেক্টিভ' এর। যাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশের ক্যাপিটালিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। ধীরে ধীরে ব্রিগিতে অর্গানাইজেশনের প্রিয় মুখ হয়ে উঠলেন। ১৯৭১ সালে এই সংস্থা উঠে গেলে, ব্রিগিতে 'রেড আর্মি ফ্যাকশন' বলে জার্মান সরকার দ্বারা ঘোষিত একটি সন্ত্রাসবাদী সংস্থায় যোগদান করেন, যেখানে তিনি সংস্থার রসদ এবং অস্ত্র কেনাবেচার দিকটা সামলানো শুরু করেন।
১৯৭২ সালে ব্রিগিতেকে জার্মান পুলিশ বার্লিনে গ্রেফতার করে রেড আর্মি ফ্যাকশনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে। দীর্ঘ ৫ বছর জেল খাটার পর ১৯৭৭ সালে ব্রিগিতে মুক্তি পান কারাবাস থেকে। ততদিনে রেড আর্মি ফ্যাকশনের সমস্ত বড় বড় নেতারাই একই জেলে ব্রিগিতের সঙ্গেই বন্দি হয়েছেন। বন্দি অবস্থায় তারা দিনের পর দিন ব্রিগিতেকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কীভাবে বাইরে বেরিয়ে সংস্থাটিকে পরিচালনা করতে হবে সে বিষয়ে। কারা দুর্নীতিগ্রস্ত, কারা জার্মানিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, কারা শেষ করে দিচ্ছে আম-জনতার পেটের ভাত- তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। অতঃপর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেই ১৯৭৭ সালেই ব্রিগিতে হত্যা করেন চিফ ফেডারেল প্রসিকিউটর সিগফ্রিড বুবাক, ড্রেসডনার ব্যাংকের চেয়ারম্যান জর্জেন পনতো এবং এমপ্লয়ার রিপ্রেজেন্টেটিভ হান্স মার্টিনকে। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ ছিল। একই বছরে পর পর তিনটে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠে আসে ব্রিগিতের নাম। দেশজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে যায়। একজন মহিলার ত্রাসে থরথর করে কাঁপতে থাকে দেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মীদের দুর্নীতিগ্রস্ত মন। প্রত্যেক দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারি ভাবতে শুরু করেন ব্রিগিতের পরের নিশানা তিনি নন তো?
১৯৭৮ সালের মে মাসে যুগোস্লভিয়ায় ফের গ্রেফতার করা হয় ব্রিগিতেকে। কিন্তু ভাগ্য তখন ব্রিগিতের সঙ্গে। সেই বছরেই নভেম্বরে ব্রিগিতেকে মুক্তি দান করে যুগোস্লভিয়ার সরকার কারণ পশ্চিম জার্মানি তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে নারাজ হয়।
এবার ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, মার্কিন জেনেরাল ফ্রেডরিক ক্রোয়েসেন-এর ওপর ফের হামলা করেন ব্রিগিতের রেড আর্মি ফ্যাকশন; যে হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন ব্রিগিতে নিজে। প্রচুর গা ঢাকা দেওয়ার পরেও, নভেম্বরে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট থেকে গ্রেফতার করা হয় ব্রিগিতেকে এবং শাস্তি হিসেবে অন্তত ২৪ বছরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দীর্ঘ ২৬ বছর জেলে কাটিয়ে ২৫ মার্চ ২০০৭ সালে ব্রিগিতে মুক্তি পান জেল থেকে।
ব্রিগিতে ভালো না মন্দ, তার কার্যকলাপ ঠিক না ভুল এই নিয়ে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মতামত থাকতেই পারে। ভেবে দেখার মতো বিষয় এটা যে ব্রিগিতে নিজের মতাদর্শে যা কিছুকে ভুল মনে করেছেন, তা শিকড় থেকে উপড়ে ফেলে দিতে চেয়েছেন সমাজ থেকে। এবং ফেলেছেনও। কাউকে ভয় পাননি। না সরকারকে, না পুলিশকে, না আইনকে, না ভগবানকে। যদি ব্রিগিতের চোখে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেরা মহিষাসুর হন, তবে ব্রিগিতে তাদের দুর্গারূপে দমন করেছেন...