ভাষাপ্রেমিকরা কি স্রেফ ‘মান্য’ বাংলাভাষার জন্যে প্রাণ দিয়েছিলেন?

“ভাষা সম্পর্কে উগ্র আত্মসর্বস্ব রণনীতি অথবা আত্মতুষ্ট নৈর্ব্যক্তিক মায়াবাদ কোনোটিই বোধ হয় সামাজিক সুস্থতার লক্ষণ নয়।” —পরেশচন্দ্র মজুমদার

 এই ‘ভাষা’র ক্ষেত্রটি যদি আমরা অবিভক্ত বাংলার ক্ষেত্রটিতে সীমাবদ্ধ করে আনি, তবে এক অদ্ভুত পথচলা আমাদের চোখে পড়বে। বর্তমানে বাঙালির ভাষাপ্রেম দুটি কেন্দ্রে মূলত বিভক্ত। কলকাতাকেন্দ্রিক এবং ঢাকাকেন্দ্রিক। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাঝে মাঝেই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এবং যাবতীয় ব্যক্তি আক্রমণের মাঝে যে উৎকট ভাষাপ্রেমের নিদর্শন আমরা দেখি, প্রশ্ন উঠতে পারে তা কি আদৌও ভাষাপ্রেম? এত উচ্চগ্রামে উচ্চকিত স্বরে নিজেকে নিজেই শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করা কেন? মজার বিষয়, এইদুই গোষ্ঠীই আদতে ‘বাংলা’ নামের একটি ভাষাকে উদ্দেশ্য করেই লড়ছেন, এবং একে অপরের ভাষাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছেন। তাহলে ‘বাংলা’ কী? ‘বাংলা’ কি একটি কোনও ভাষা নয়? যদি একটি ভাষায় হবে তবে তাকে নিয়েই দুটি গোষ্ঠী লড়াই করে কীভাবে?

আমাদের ভাষাবিজ্ঞান বাংলাকে একটি ভাষা বলেই চিহ্নিত করে থাকে। বলে সংস্কৃত বাংলা ভাষার ‘জননী’। এবং সে ক্ষেত্রে লিখিত সংস্কৃত এবং কথ্য সংস্কৃত তত্ত্বের আমদানিও করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ সমস্যা খুব নতুন না। ভেবে দেখলে গোড়ার থেকেই বাঙালির ভাষাবিজ্ঞান চর্চার ধারাটি যে পথে ‘শিক্ষিত ভদ্রলোক’দের ভাবতে শিখিয়েছে, তাতে এই ধরনের হিংস্র কামড়াকামড়ির পরিণতিটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। উনবিংশ শতক থেকেই একরকম মধ্যবিত্ত বাঙালি ভষাবিজ্ঞান চর্চার একটি প্রবল ক্ষিদে অনুভব করে বলা যায়। এর অন্যতম কারণ অবশ্যই জাতীয়তাবাদ। উপনিবেশের জাতীয়তাবাদের মূলে এমন এক অপুষ্টির, অভাবের, বা বলা ভালো হীনমন্যতার বোধ থাকে যা সময় বিশেষে এই ধরণের ঝোঁক তৈরি করতে সক্ষম হয়। বঙ্কিমের ‘বাঙালির ইতিহাস নাই’ মার্কা কথাবার্তাও সেই অভাববোধজনিত তাড়না থেকেই একপ্রকার।

কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের জন্মপর্যায়টির সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা যদি আমরা দেখি, স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাবে  যে এই সময়ে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সারজলে নব্য-ব্রাহ্মণ্যবাদই আদতে পুষ্ট হয়েছে। কাজেই যাঁরা ভাষাবিজ্ঞান চর্চা করছেন তাঁরা মূলত ভদ্রলোক মধ্যবিত্ত হিন্দু উচ্চবর্ণ শ্রেণির। মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান, বিশেষত ভাষার ক্ষেত্রটিতে, এমন এক চর্চা আপাতভাবে যাকে দেখে নৈর্ব্যক্তিক মনে হলেও, আদতে তা বিজ্ঞানীর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। বিশেষভাবে ভাষার ক্ষেত্রটিতে বললাম, কারণ ভাষা ক্ষমতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। জ্ঞানের অন্যতম বাহন, মাধ্যম। জ্ঞান ও ক্ষমতার পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে ভাষাকে একটি সেতু বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। যে সেই সেতুর দখল নিতে পারবে, সেই ক্ষমতায় থাকবে। বাংলার ব্যুৎপত্তি পাতায় পাতায় ‘দেবভাষা’ সংস্কৃত ঘেঁষা হতে শুরু করল।

বাংলাভাষার জন্ম সংস্কৃত থেকেই হয়েছিল নাকি হয়নি–তা আলোচনা এই লেখার বিষয় নয়। তবে যে রাজনীতির থেকে বাংলার জন্ম, তা সংস্কৃতের রাজনীতির সম্পূর্ণ উলটো মেরুতে অবস্থান করে–তা অবশ্যই আলোচ্য। ভারতে বৈদিক আর্যবসতির প্রথম কেন্দ্রস্থল ছিল উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল। ঋগবেদ সংহিতার থেকে যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা অনুযায়ী এর ভৌগোলিক পরিসর হল–আফগানিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধুপ্রদেশ, কাশ্মীর, রাজপুতানার অংশবিশেষ এবং সরযূ নদী পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্বাঞ্চল। ঋগ বেদোত্তর যুগে আর্য সভ্যতার কেন্দ্র-বিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিল কুরু-পাঞ্চাল অধ্যুষিত মহাদেশ–বর্তমানে থানেশ্বর, দিল্লী, বেরিলি, বুদাউন, ফারাক্কাবাদ ইত্যাদি। বঙ্গ তখন আর্য সম্প্রসারণের দূরতম সীমানা মাত্র। ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠতা, জাতিপ্রথার বিষ তখনও এ অঞ্চলকে গেলান যায়নি, কারণ এ অঞ্চলের বেশিরভাগ অধিবাসীই তখন আদিবাসী এবং পরে যে সব সম্প্রদায়কে ‘নিম্নবর্ণ’ বলে চিহ্নিত করা হবে, তাঁরা। প্রত্যেকটি গোষ্ঠী নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করত। ফলে এই অঞ্চলে ভাষার সংখ্যা ছিল প্রচুর। নিজেদের মধ্যে যে তাদের সংঘাত হত না, তা নয়—তবে নির্দিষ্ট কোনও ভাষা ‘পবিত্র’ বলে প্রতিষ্ঠিত ছিল না।

কিন্তু আর্যদের তখন সাম্রাজ্য। কাজেই তাদের ভাষা ‘দেবভাষা’। যতদিন আর্যরা পূর্বের দিকে হাত বাড়ায়নি, এই ‘দেবভাষা’ উপাধির প্রয়োজন তেমন হয়নি। কিন্তু শাসন করতে গেলে এ বোঝানো বড়ই বাধ্যতামূলক যে তোমরা নিচ, তোমরা অশিক্ষিত, তোমরা আমাদের (অর্থাৎ কিনা মানুষের) পদবাচ্যই নও। উপরে ঊনবিংশ শতকের মধ্যবিত্তের যে হীনমন্যতা বা অভাববোধের কথা বলছিলাম–সেটাও অনেকটা একই কারণজাত। এখন নিজেদের ‘দীক্ষিতবাচ’ বলা এই আর্যেরা শাসনের স্বার্থে পূর্বাঞ্চল কেন্দ্রিক যে ‘অপর’ নির্মাণ করল, তার প্রধান একটা মাধ্যম কিন্তু ভাষা। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের ভাষাকে বলা হত ‘অশিষ্ট’, ‘ব্রাত্য’ ইত্যাদি। ‘বার্বারিয়ানস্‌’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আসলে ‘যারা তোতলায়’। গ্রীক সাম্রাজ্যেও গ্রীকরা যে ভাষায় কথা বলত, তা ছিল ‘আদর্শ ভাষা’। বাদবাকি সবাই ‘তোতলা’। এই একই রাজনীতি আমরা ‘দেবভাষা’ ও ‘ব্রাত্যভাষা’র মধ্যেও লক্ষ্য করব। যাবতীয় ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা’ নামের যে ডায়াক্রনিক পাঠ, তাতে আমরা লক্ষ করব আর্যভাষার মূল প্রবণতা ছিল ভাষার ধ্রুপদীকরণ এবং সাধারণীকরণ। বেদোত্তর যুগে এরই চরম পরিণতি হেসেবে এল ‘সংস্কৃত’। অর্থাৎ সৃষ্টির আদিতে যে ‘দেবভাষা’ এক এবং অদ্বৈত কণ্ঠে ‘ওম’ নাদ করেছিল।

সেই দেবভাষা ক্রমে ক্রমে পূর্বাঞ্চলের ‘ছোটলোক’দের পাল্লায় পরে পবিত্রতা হারাচ্ছে (অর্থাৎ বহুস্বর পাচ্ছে) বলে মনে করত আর্যরা। এই নোংরা অশুদ্ধ ভাষাকে পরিষ্কার বা সংস্কারের পথ ধরেই খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পাণিনি ব্যকরণ লিখলেন, তৈরি হল ‘সংস্কৃত’। অর্থাৎ বহুস্বরে ক্যাকোফোনাস অপবিত্র হয়ে যাওয়া থেকে রুখে দিতেই সুসজ্জিত ব্যকরণের নিয়মে আবদ্ধ ‘সংস্কৃত’-এর জন্ম। এর ঠিক উল্টোদিকে যে কথ্যভাষা, যার খানিকটা বঙ্গের অধিবাসীদের ছোঁয়া লেগে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল–তাকে নাম দেওয়া হল ‘প্রাকৃত’। প্রাকৃত অর্থ ‘প্রজাদের ভাষা’, অতি সাধারণ ভাষা। দেবত্বের বিপরীতে ‘প্রজাত্ব’; ভাষাকে ‘উপ’, ‘অপ’, ‘অব’–ভাবের দাগিয়ে দেওয়ার এই শুরু।

“ভবনির্ব্বাণে পড়হ মাদলা।

মণপবণবেণি করণ্ডকশালা।।

জঅ জঅ দুন্দুহিসাদ উছলিয়া।

কাহ্ন ডোম্বীবিবাহে চলিআ।।

ডোম্বী বিবাহিআ অহারিউ জাম।

জউতুকে কিঅ আণুতু ধাম।।

অহণিসি সুরঅপসঙ্গে জাঅ।

জোইণিজালে রঅনি পোহাবে।।

ডোম্বীএর সঙ্গে জো জোই রত্তো।

খণহু ন ছাড়অ সহজ উন্মত্তো।।”

 

চর্যাপদই বাংলাভাষার প্রথম নিদর্শন কিনা এই নিয়ে বহু বিতর্কের পরেও কোনও বিকল্প নিদানের হদিশ পাওয়া যায়নি। উড়িয়া, বাংলা, অসমিয়া–তিনটি ভাষারই আদিনিদর্শন হওয়া সম্ভব। তার পক্ষে বিপক্ষে অনেক কারণও রয়েছে। আমরা শুধুমাত্র তার বাঙালিয়ানার দাবিটি নিয়েই আলোচনা করব। এই ভাষার ভাব ও গঠন ‘সংস্কৃত’ থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছে। কী কী সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য তা আলোচনাও এই লেখার বিষয় নয়। আগেই বলেছি গঠনের রাজনীতি এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের লড়াই সমস্ত ইতিহাস জুড়ে। বিশেষত সহজযানেরা এমন একটি সম্প্রদায় যাঁরা ‘মূল’ বৌদ্ধ এবং হিন্দু–উভয়ের কাছেই অপর। চর্যাপদের কাল সুখময়বাবু আমাদের দেখিয়েছেন মোটামুটি ৭০০ থেকে ১১০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। বৌদ্ধদের কাছে এই সময়টি খুব সুখের সময় নয়। সহজযান সম্প্রদায়ের কাছে তা আরো দুর্বিসহ। নিজস্ব বিশ্বাস ও যাপনের ওপর মুহুর্মুহ আক্রমণ এবং গণহত্যা কাণ্ডে তারা বিপর্যস্ত। এমন এক সময়ে সৃষ্টি হচ্ছে সন্ধ্যা ভাষা। বাংলার আদিম নিদর্শন। যাবতীয় চাপিয়ে দেওয়া ‘মান্যতা’র শর্তের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে এক ক্যাকোফোনাস অস্তিত্ব যা নিজেকে স্তরের পর স্তরে ঢেকে ফেলছে। গোলকধাঁধার জন্ম দিচ্ছে। যে গোলকধাঁধা মূলস্রোতকে বিভ্রান্ত করে। ক্ষমতাচ্যুত করে। এবং যার কাছে সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরনোর সূত্র রয়েছে শুধুমাত্র সেই গোষ্ঠীকেই ক্ষমতান্বিত করে। ‘পবিত্রতা’র ধারণার আগ্রাসনকে গুলিয়ে টুকরো টুকরো করে দেওয়াই যেন এই সময়ের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলির অস্তিত্বের সংগ্রাম হয়ে উঠেছিল। কাজেই আমরা দেখছি যে রাজনীতি ‘সংস্কৃত’-এর জন্ম দেয়, বাংলার জন্ম হচ্ছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত রাজনীতির গর্ভে। জন্মসূত্রেই ‘বাংলা’ নামক ছাতাটি প্রান্তিকতার প্রতিরোধের স্বর।

বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বদা এবং সর্বথা বাংলার বিকাশ একই রকম হয়নি। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা এই ভাষার উপর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব ফেলছিল এবং নিজেরাও প্রভাবিত হচ্ছিল। একদিকে বাংলায় মুসলিম শাসন আসার সঙ্গে সঙ্গে যেমন ভাষার ক্ষেত্রটিতে আরবি ফারসি ঢুকেছে, অপরদিকে তাকে সংস্কৃত প্রধান ভাষা করে তোলার ঝোঁকও দেখা গেছে। অথচ এই দুই ক্ষমতাকেন্দ্রের বাইরে দেশি, সাধারণ শব্দগুলি, আঞ্চলিক শব্দগুলিকে প্রাধান্য দেওয়ার তেমন নজির নেই। আবার আরবি, ফারসি, লোকায়ত শব্দ, বিদেশি আগমনে নানা বিদেশি শব্দ–এসব কিন্তু অধিগ্রহণ ছিল না। এগুলি বাংলা নামক একটি বহুস্বরের ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করছিল, ভাষা গঠনের কাজও চলছিল একইসঙ্গে। অর্থাৎ সৃষ্টির আদিতে বাংলা ছিল এক এবং অদিতীয় সংস্কৃত ঘেঁষা ও পবিত্র, বাকি শব্দগুলি তাকে কলুষিত করছিল–এমন তত্ত্ব অত্যন্ত অনৈতিহাসিক এবং মনগড়া। আঞ্চলিক প্রভাবে বাংলার যে রূপ, তাই ছিল মানুষের কথ্য ভাষা। ‘মান্য বাংলা’ ধারণাটিই বাংলায় ছিল না, কারণ হিসাবে বলা যায় তার অবৈধ প্রতিরোধাত্মক জন্ম। আমরা ‘মধ্যযুগ’ বলে চিহ্নিত যে সাহিত্য পাই, তা মূলত রাজসভার ভাষা। কথ্যভাষার কী পরিবর্তন হয়েছিল তা জানার কোনও উপায় নেই। ফলত বাংলাভাষার যে ইতিহাস আমরা পড়ি, এবং মধ্যে মধ্যেই সংস্কৃত শিকড় খুঁজে পেয়ে আনন্দিত হই–তা মূলত রাজসভার বাংলার ইতিহাস। ক্ষমতার এককেন্দ্রিক ঝোঁক তাতে থাকলেও তা কথ্যভাষাকে বদলে ফেলবে এমন ক্ষমতা তার ছিল না।

এই যাবতীয় কথ্যভাষাগুলিকে ‘উপ’ বলা শুরু হল ঔপনিবেশিক শাসকদের শিক্ষাদীক্ষায় শিক্ষিত হয়ে। ইসলামি শাসনকে কলঙ্কিত করার কায়েমীস্বার্থ ইংরেজদের ছিল। তাদেরই আশকারায় একদল সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত জন্ম দিলেন সাধু বাংলা গদ্যের। যার মূল প্রবণতা সমস্ত ইসলামিক (আরবি, ফারসি ইত্যাদি) শব্দ বাদ দিয়ে আবার সেই ‘পবিত্র’ (অর্থে সংস্কৃত ঘেঁষা) বাংলার জন্ম দেওয়ার। উপনিবেশের ইংরেজি এবং বাংলা যেমন ডাইগ্লসিয়া বা দ্বিবিধ ভাষারীতি এনেছিল বাঙালির জীবনে, বাংলার মধ্যেই আরেকটি নোবেল ডায়ালেক্ট গড়ে তোলার খোঁজ খোদ বাংলা ভাষার ভিতরে আরেকটি ডাইগ্লসিয়া তৈরি করল। আদতে সমস্ত ক্ষমতায় আসীন শ্রেণিই ডায়াগ্লসিয়া প্রবর্তন করতে চায়। এক ভাষার আগ্রাসন ততক্ষণ সম্ভব নয় যতক্ষণ না সেখানে এই 'অপর' চিহ্নিত ক্ষেত্রটির অস্তিত্ব থাকছে।   হেটেরোগ্লসিয়া বা ভাষার বহুস্বর স্বীকার করলে ক্ষমতার একনায়কতন্ত্রের সমূহ বিপদ। তাই যুগে যুগে হেটেরোগ্লসিয়াকে চেপে দিয়ে ক্ষমতা এক ডাইগ্লসিয়ার পরিসর তৈরি করতে চেয়েছে।

এক্ষেত্রে যার এক দিকে রইল সংস্কৃত বহুল মান্য তথা পবিত্র বাংলা ভাষা, অপরদিকে কথ্য, আঞ্চলিক তথা অসভ্য তোতলাদের ভাষা। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইউরোপীয় শাসকদের কাছে যত অপমানিত হত, সেইসব অপমান তারা চারিয়ে দিত এই অপর করে রাখা নিম্নবর্গের ভাষার দিকে। মজার বিষয়, আরবি ফারসি শব্দের পাশাপাশি এই ‘উপভাষা’ ঘেরাটোপে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল ‘দেশি’ হিসেবে চিহ্নিত লোকায়ত শব্দ গুলিকেও। ভারতচন্দ্রের ভাষার প্রতিই তাই নবজাগরণের কান্ডারিদের প্রধান বিদ্বেষ। যৌনতা নয়। যৌনতা বঙ্কিম স্বয়ং ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ভারতচন্দ্রের যাবনীমিশাল ভাষা হিন্দু উচ্চবর্ণ জাতীয়তাবাদের রাজনীতির ক্ষেত্রটিতে ছিল বিপজ্জনক। 

আবার এই সাহিত্যের ভাষা এবং কথ্যভাষার দ্বন্দের মধ্যেও আবার কলকাতাকেন্দ্রিকতার একটি ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। কলকাতার বাইরের অঞ্চলের কথ্যভাষা ছিল তাই প্রান্তিকেরও প্রান্তিক। তাই সাধু চলিতে বিবাদ যখন খানিকটা প্রশমিত হল হিন্দু ভদ্রলোকদের উদ্যোগে, তখন সেই দুইয়ে মেশা ‘মান্য ভাষা’র কৃত্তিম রূপটিও কলকাতাকেন্দ্রিক হয়ে উঠল। বাঙালি ভদ্রলোকেরা তখন যে ভাষাতে লিখছেন, সে ভাষাতেই কথা বলছেন, অফিস এবং ঘরের ভাষার দূরত্বও খানিকটা মিটছে স্বাধীনতার পর, কিন্তু ডাইগ্লসিয়া তখন আরোপিত হচ্ছে ‘মান্যভাষা’ এবং অন্যান্য আঞ্চলিক স্বরগুলির উপর যে স্বরগুলিকে এতদিন পাত্তাই দেওয়া হয়নি। কাজেই প্যারীচাঁদ মিত্র বা নকশাসাহিত্য বা বটতলার ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষার ইতিহাস ভেবে উৎসাহিত হওয়ার যে কোনও প্রবণতাই আসলে কলকাতাকেন্দ্রিক প্রবণতাই। বস্তুত আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মানিক, অদ্বৈত, সতীনাথ ভাদুড়ির আগে কলকাতা থেকে দূরের প্রান্তিক ভাষা নিয়ে তেমন বড় অঙ্কের কাজ হয়নি বললেই চলে। এই ভাষার রাজনীতিরই পরিপূর্ণ বিকাশ আমরা লক্ষ্য করব এরপরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, অমিয়ভূষণ থেকে শহিদুল জহিরে। বাংলা সাহিত্যের একের পর এক বহুখ্যাত আন্দোলন (হাংরি, শ্রুতি, নিম, শাস্ত্রবিরোধী) হয়েছে। তার একটিও, দুর্ভাগ্যের বিষয় আঞ্চলিক ভাষাকে কেন্দ্র করে হয়নি।

কলকাতার হোক বা ঢাকা, ‘মান্য ভাষা’র রাজনীতির সঙ্গেই ক্ষমতার সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে অঙ্গাঙ্গীভাবে। মান্যভাষাকেই হাতিয়ার করে, বা তার একটি মাত্র ‘অপ’ চিহ্নিত অংশকে হাতিয়ার করে এই ক্ষমতার রাজনীতির বিরোধিতা করা যায় না। এটি একটি ফাঁদ। একটি প্যারাডক্স। যাবতীয় ‘অপ’, ‘উপ’ এবং ‘অব’-কে যদি প্রতিরোধের রাজনীতির উপযোগী করে ব্যবহার না করা যায়, বাঙালির বাংলাচর্চার অন্তর্ভুক্ত না করা যায়, তবে এই কেন্দ্রিক ঝোঁকের থেকে পরিত্রাণ নেই। তখন যাবতীয় ‘উপভাষা’ বলে চিহ্নিত ‘বাংলা’ নামক ছাতার তলায় থাকা মানুষের ভাষাগুলিকে মান্যভাষীদের ‘গাঁইয়া’ বলেই বোধ হবে। এবং প্রকারান্তে তাদের আবার নতুন করে একটি ডাইগ্লসিয়া মেনে নিতে বাধ্য করা হবে।

আজ ভাষাদিবস। একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলার প্রতি গদগদ আবেগ নয়, ক্ষমতার ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যে করতে পেরেছিলেন বাঙালিরা- তা স্মরণ করার দিন। এই প্রতিরোধের জন্য প্রাণ দিয়েছেন বহুজন। সংখ্যাটা সন্দেহাতীত ভাবে জানা এখনও সম্ভব হয়নি। যে পাঁচজনকে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমান—আজকের দিনে খুব জানতে ইচ্ছে করে তাঁরা কি চাপিয়ে দেওয়া তথা ‘মান্য’ উর্দুর বিরুদ্ধে কোনও চাপিয়ে দেওয়া ‘মান্য’ বাংলাভাষার জন্যে প্রাণ দিয়েছিলেন? মুর্শিদাবাদের আবুল বরকত বেঁচে থাকলে, তাকেও এই ‘গাঁইয়া ভাষা’র প্রতি বিদ্রুপ সহ্য করতে হত না কি? ময়মনসিং-এর পাঁচুয়া গ্রামের আবদুল জব্বারের পরিণতি কী হত শহিদ না হলে? মানিকগঞ্জের পারিল বলধারা গ্রামের রফিকউদ্দিন আহমদ? ফেণীর লক্ষ্মণপুর গ্রামের আবদুস সালাম? এঁরা কেউই কলকাতা বা ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন না। এদের কী চোখে দেখত ক্ষমতাকেন্দ্রিক বাংলাপ্রেমীরা? প্রশ্ন থেকেই যায়। এখনও যখন আঞ্চলিক ভাষাকে ‘উপভাষা’ হিসেবে দেখে বাঙালি ভদ্রলোকেরা, যখন টান, বানান বা উচ্চারণ নিয়ে, 'বহিরাগত' শব্দ ব্যবহার নিয়ে বিদ্রুপ ছুঁড়ে দেয়, তখন এই ‘মান্য’ রাজনীতির প্রতিরোধে জন্ম নেওয়া ভাষার উপর, ‘মান্যভাষা’ প্রতিরোধের লড়াইয়ে প্রাণ দেওয়া প্রান্তিক ভাষাশহিদদের মৃত্যু উদযাপনের উপর নিজেকে ‘বাঙালি’ বলে দেখতে চাওয়া এইসব ভদ্দরলোক শ্রেণির অধিকার কতটুকু–তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলা উচিত, অন্তত আজকের দিনটিতে।

More Articles