দেহ উদ্ধারের পর সেমিনার রুমে কাদের ভিড়? যে সব প্রশ্ন তুলে দিল আরজি কর কাণ্ডের ভাইরাল ভিডিও
RG Kar Hospital Incident: ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে ভিড়ে ঠাসা একটি ঘরের ছবি। অন্তত জনা তিরিশেক মানুষ জটলা করে রয়েছেন সেখানে। কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে, কেউ বা হাঁটাচলা করছেন।
আরজি করে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের মামলাকে কেন্দ্র করে তোলপাড় রাজ্য-দেশ। ইতিমধ্যেই সেই মামলার জল গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। তদন্তভার গিয়েছে সিবিআইয়ের হাতে। এরই মধ্যে প্রকাশ্যে এল আরজি কর কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ৪৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। যতদূর জানা যাচ্ছে, ভিডিওটি আরজি কর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চার তলার সেই সেমিনার রুমের। যেখান থেকেই গত ৯ অগস্ট উদ্ধার হয়েছিল ওই চিকিৎসকের মৃতদেহ। যদিও সেই ভাইরাল ভিডিওটির সত্যতা যাচাই করেনি ইনস্ক্রিপ্ট। তবে সেই ভিডিওটিকে কেন্দ্র করে ফের শুরু হয়েছে জোর জল্পনা।
সেমিনার রুমে সেদিন দীর্ঘক্ষণ ওই চিকিৎসক -তরুণীর দেহ পড়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা, একবার মেয়েকে শেষ দেখা দেখার আশায়। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা কেটে গেলেও মেয়েকে দেখার অনুমতি মিলছিল না তাঁদের। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে মেয়েকে দেখার অনুমতি পেয়েছিলেন তাঁরা। আদালতে তেমনটাই অভিযোগ জানিয়েছেন নির্যাতিতার মা। ঘটনাস্থলে প্রবেশ নিষেধ ছিল সহকর্মী, সাংবাদিকদের জন্যও। অথচ সেদিন ওই জায়গায় উপস্থিত ছিলেন বহু বহিরাগতই। যাঁদের সে সময় সেখানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল না। তেমটাই ধরা পড়েছে ৪৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটিতে।
আরও পড়ুন: সেই রাতে যৌনহেনস্থা আর এক মহিলাকেও? যে ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এল আরজি কর-অভিযুক্তের পলিগ্রাফ টেস্টে
ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে ভিড়ে ঠাসা একটি ঘরের ছবি। অন্তত জনা তিরিশেক মানুষ জটলা করে রয়েছেন সেখানে। কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে, কেউ বা হাঁটাচলা করছেন। কেউ আবার কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে। ওই ৪৩ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের পরবর্তী মুহূর্তটি বন্দি রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। যদিও ওই ভিডিওয় মহিলা চিকিৎসকের দেহ কোনও ভাবেই দেখা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে সেই ভিডিও। যদিও ভিডিওটির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি ইনস্ক্রিপ্ট। তবে ওই ভিডিওতে ভিড়ের মধ্যেই দেখা গিয়েছে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের তৎকালীন আপ্তসহায়ক প্রসূন চট্টোপাধ্যায়,সন্দীপের আইনজীবী শান্তনু দে, হাসপাতালের ফরেন্সিক মেডিসিনের শিক্ষক দেবাশিস সোমের মতো লোককে। আরজি কর মেডিক্যালের আউটপোস্টের ওসি সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়কেও ওই ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই এই ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনেকেরই বক্তব্য, ভিডিয়োটি মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের পরে তোলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে যে জায়গা থেকে একটি রহস্যজনক দেহ উদ্ধার হয়েছে, সেখানে একসঙ্গে এত লোক কী ভাবে ঢুকে পড়লেন, তা-ও আবার পুলিশের উপস্থিতিতে? কেন পুলিশ তাঁদের বাধা দিল না? নিয়ম অনুযায়ী, দেহ উদ্ধারের পরেই তো সেই জায়গা সিল করে দেওয়ার কথা পুলিশের। নইলে তথ্যপ্রমাণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যা নিয়ে শেষ শুনানিতে প্রশ্ন তুলেছিল সুপ্রিম কোর্টও। তার পরেও সেমিনার হলে যাওয়া-আসায় ওই মুহূর্তে পুলিশের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না কেন? দেহ উদ্ধারের পর যাঁদের সেমিনার হলে দেখা গিয়েছে ভিডিয়োর সূত্রে, তাঁরাই বা সেখানে ঠিক কতক্ষণ ছিলেন? তাঁদের মধ্য়ে অনেকেই ‘সন্দীপ-ঘনিষ্ঠ’ বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে সেই মুহূর্তে তাঁদের ভূমিকা নিয়েও।
যে ভিডিয়ো সামনে এসেছে, তাতে দেখা গিয়েছে, সেমিনার রুমের বাইরে শান্তনু দে-কে। তিনি পেশায় আইনজীবী। স্বাস্থ্য ভবনের একাংশের মতে,এই শান্তনু দে হলেন সন্দীপ ঘোষের ছায়াসঙ্গী। কিন্তু সেখানে ওই মুহূর্তে একজন আইনজীবী ঠিক কী করতে গিয়েছিলেন? প্লেস অফ অকারেন্সে দেখা মিলেছে সন্দীপ ঘোষ ঘনিষ্ঠ ফরেনসিক চিকিৎসক দেবাশিস সোমেরও। যাঁকে সোমবার নিজাম প্যালেসে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা। জানা গিয়েছে, আদৌ আরজি করের কর্মী নন তিনি। তা সত্ত্বেও ঘটনার পর মুহূর্তেই সেমিনার রুমে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এমনটাই দাবি করেছে স্বাস্থ্য ভবনের একাংশ। হেলফ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের ডিটেইমেন্টে পোস্টিং ছিল দেবাশিসের। তাহলে সেদিন সেমিনার রুমে ঘটনার পরই কী করছিলেন তিনি? আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ছায়াসঙ্গী প্রসূন চট্টোপাধ্য়ায়কে নিয়েও একই প্রশ্ন উঠেছে। স্বাস্থ্য ভবনের একাংশের মতে, প্রসূন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে তিনি ডেটা এন্ট্রি অপারেটর হিসাবে কাজ করেন।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, এরকম একটা ক্রাইম সিনে কীভাবে ঢুকে পড়লেন ফরেনসিক মেডিসিনের ডেমনস্টেটর, সন্দীপ ঘোষের ছায়াসঙ্গী ডেটা অপারেটর আর তাঁর ঘনিষ্ঠ আইনজীবী? কী-ই বা করছিলেন তাঁরা? আদৌ তাঁদের মাধ্যমে কৌশলে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করা হয়নি তো? প্লেস অফ অকারেন্সে এই বহিরাগত ইস্যুতে সরব হয়েছেন চিকিৎসক মহলের একাংশ। চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, “দেহ তড়িঘড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার থেকে শুরু করে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা। ওখানকার চিকিৎসকরাই আমাদের জানান, সেদিন সেমিনার রুমে কারা কারা এসেছিলেন, কাদের ডাকা হয়েছিল সেখানে। সন্দীপ ঘোষ সিন্ডিকেটটা চালান। আমরা সিজিও কমপ্লেক্স অভিযান চালাব, কেন তাঁদের তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে না।” চিকিৎসক নেতা সজল বিশ্বাস বলেন, “সকালেই তড়িঘড়ি আমরা দেখি, শাসকদলের প্রভাবশালী চিকিৎসক নেতা হিসাবে পরিচিত, তাঁরা অকুস্থলে আসেন। এমনকি সেমিনার রুমে, যেখানে বডি পাওয়া গিয়েছিলেন, সেখানে মিটিং করে। ওই চিকিৎসক নেতারা কেউই আরজি করে কর্তব্যরত নন। স্বাস্থ্য দফতরের উচ্চ পদাধিকারীও নন। কেন তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন, তা তদন্তের আওতায় আনতে হবে।” চিকিৎসক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য “যেখানে ভাঙচুর করা হয়েছিল সংস্কারের নামে, ক্রাইম সিনে আশপাশের এলাকা ভাঙা হয়। আমরা জেনেছিলাম, উপস্থিত ইঞ্জিনিয়ররা ওয়ার্ক অর্ডার ছাড়া কাজ করতে চাননি, তবুও চাপ দিয়ে তাঁদেরকে দিয়ে কাজ করানো হয়েছে। ওইদিন পদাধিকারী যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা তদন্ত বিলম্ব করতে চেয়েছিলেন।”
আরও পড়ুন:চড়া দামে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, গ্লাভস, তুলো, প্রস্রাবের ব্যাগ বিক্রি করেছেন সন্দীপ ঘোষ?
এ প্রসঙ্গে রাজ্যের মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘আমিও দেখেছি ভিডিয়োটা। ওই সময় কেউ কেউ ঢুকে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফরেন্সিক আসার পর তালা দিয়ে সিল করে দেওয়া হয়েছিল সেমিনার হল। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কৌতূহলীরা এ রকম ভাবে এসে পড়েন। তবে আমি বিশ্বাস করি, এই জঘন্য অপরাধের শাস্তি হবে।’’ নির্যাতিতার পরিবারের হয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাটি নড়ছেন বিখ্যাত আইনজীবী ও বাম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। এ বিষয়ে তাঁর দাবি, “আমার তো আশঙ্কা ধৃত আসলে দাবার বড়ে। একজন সিভিক ভলান্টিয়র চিকিৎসককে খুন করলেন, কেউ দেখলেন না, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, হাসপাতালের চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় কীভাবে?” সব মিলিয়ে নতুন করে হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে ভাইরাল এই ভিডিওটিকে কেন্দ্র করে। ইতিমধ্যেই আরজি কর কাণ্ডে ধৃত সঞ্জয় রায়ের পলিগ্রাফ টেস্ট করা হয়েছে প্রেসিডেন্সি জেলে। সেখান থেকে বেশ কিছু বিস্ফোরক তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে জানিয়েছে সিবিআই। সেই সব তথ্যপ্রমাণ এবং পাশাপাশি ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওকে ধরে কি তদন্তে নতুন কোনও দিশা আনতে পারবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা? গত কয়েকদিন ধরে প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে লাগাতার জিজ্ঞাসাবাদ করে গিয়েছে সিবিআই। মিলেছে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির প্রমাণও। চলছে তাঁর পলিগ্রাফ টেস্টও। এবার নয়া এই ভিডিও আরও কোনও নতুন সত্যের কাছে পৌঁছে দেয় কিনা সিবিআইকে, সেটাই দেখার।