অ্যাংলো সাহেবের বাংলোয় কাটুক ছুটি, ঘুরে আসুন মিনি বিলেত থেকে

Weekend Trip to McCluskieganj: ঢেউ খেলানো প্রান্তর, পাহাড়ি নদী, জঙ্গল, ঝর্না আর ঘাসের আশ্চর্য এক বুনোগন্ধের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে ম্যাকলস্কিগঞ্জ পর্যটকদের আশায়।

একটা সময় বাঙালি ছুটি পেলেই ছুটত হাওয়া বদলে। শরীর হোক বা মন, দু'য়ের দাওয়াই-ই যে হাওয়াবদল, এমন বিশ্বাস সেসময় বদ্ধমূল হয়ে ছিল সে সময়ের বাঙালির মনে। আর সেই হাওয়া বদলের জন্য পয়লা নম্বরের পছন্দছিল ঝাড়খণ্ডের মালভূমি, পাহাড় ঘেঁষা একাধিক ঠিকানা। ঝাড়খণ্ডের এক নিজস্ব মায়া রয়েছে। বুনো ঘাসের গন্ধ, জঙ্গলের যে মাদকতা ছড়িয়ে রয়েছে এই সব এলাকায়, তার আস্বাদ কিছুটা মেলে বুদ্ধদেব গুহ-র লেখায়। সেই লেখা পড়ে রাঁচি, ঝাঁড়খণ্ডের সেই অরণ্য-উপত্যকার প্রেমে পড়েননি, এমন পাঠক খুঁদে পাওয়া কঠিন। বুদ্ধদেব গুহ-র 'একটু উষ্ণতার জন্য' উপন্যাসটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের চোখের উপরে আজও ছবির মতো ভাসে সেই আশ্চর্য মায়াবী আস্তানার কথা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কলোনির জন্য বিখ্যাত এই জায়গা এককালে ছিল বাঙালির প্রিয় ছুটির ঠিকানা। ক্রমে সেই প্রতাপ কেটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগেকার স্মৃতি বুকে নিয়ে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে ম্যাকলস্কিগঞ্জ।

বুদ্ধদেব গুহ তাঁর উপন্যাসে লিখছিলেন, “এই জায়গাটায় সকাল হয় না, সকাল আসে। অনেক শিশির ঝরানো ঘাসে ভেজা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে অনেক শঙ্খিনী নদী পেরিয়ে সোনা-গলানো পোশাক পরে সকাল আসে এখানে।” সে কথা যে এক বিন্দু মিথ্যা নয়, তা মালুম হবে এখানে এলেই। সময় এখানে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে পুরনো বাংলো আর গির্জা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কলোনির ছায়া সর্বোত্র। এখানে কিন্তু একসময় বহু বাঙালিরও বাংলো ছিল। তবে ক্রমে মানুষ উঠে গিয়েছে ম্যাকলস্কিগঞ্জ ছেড়ে। স্মৃতিরা পড়ে আছে।

আরও পড়ুন: নদী-জঙ্গল মাখা রোদের আদর! এই শরতে ডাকছে পাহাড়ি মায়া-গ্রাম

একটা সময় ম্যাকলস্কিগঞ্জকে বলা হত মিনি বিলেত। উনিশশো শতকের গোড়ায় এখানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য গড়ে ওঠে কলোনাইজেশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া। এরপর ১৯৩৩ সালে ১ হাজার একর জমিতে তৈরি হয় ব্রিটিশ-ভারতের প্রথম অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কলোনি। কোঙ্কা, ল্যাপরা, হেসালং, মাহুলিয়া, ডুলি ও রামদাগা— এই ৬টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল কলোনি। তখন ৩০০ পরিবারের বাস ছিল এখানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ধীরে-ধীরে কমতে থাকে জনসংখ্যা। বর্তমানে এখনে বসবাস করে মাত্র ২৩টি পরিবার। এখন ম্যাকলস্কিগঞ্জে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই সব স্মৃতিদের বুকে নিয়ে একাধিক বাংলো।

তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একই রকম রয়েছে ম্যাকলস্কিগঞ্জের। এখানকার আবহাওয়া এমনিতে বেশ আরামদায়ক। অক্টোবর থেকেই হালকা ঠান্ডার পরশ লাগে হাওয়ায়। গায়ে যেন একটা হালকা চাদর চাপালে আরাম লাগে। ঢেউ খেলানো প্রান্তর, পাহাড়ি নদী, জঙ্গল, ঝর্না আর ঘাসের আশ্চর্য এক বুনোগন্ধের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে ম্যাকলস্কিগঞ্জ পর্যটকদের আশায়। সাহেবদের পরিত্যাক্ত বাংলো দাঁড়িয়ে থাকে একা একা। তার পাশ দিয়ে ঘন সবুজ জঙ্গল আর ছড়ানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে দেখতে পারেন পাহাড়ি জনপদ। দোকান-বাজার হাতে গোনা এই ম্যাকলস্কিগঞ্জে। স্টেশনের কাছে বাজার সংলগ্ন এলাকায় এলে মিলতে পারে বেশ কিছু দোকান। এককালের সাহেব কলোনি ম্যাকলস্কিগঞ্জে মুন্ডা, ওঁরাওয়ের মতো আদিবাসীদের বসবাসের জায়গা। প্রতি শুক্রবার ম্যাকলস্কিগঞ্জে বসে মহুয়ার হাট। সে-ও এক দেখার মতো ব্যাপার। রাস্তার পাশে মদের পসরা সাজিয়ে বসে আদিবাসী পুরুষ-রমনীরা। হাওয়ায় মহুয়ার গন্ধ মেখে গ্লাস থেকে চলকে ওঠে নেশা।

ম্যাকলস্কিগঞ্জের বাতাসে এক আশ্চর্য মাদকতা আছে, যা মহুয়ার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। অসংখ্য সাহেবী বাংলো তো দেখবেনই, তার সঙ্গেই ঘুরে দেখুন ম্যাকলাস্কি সাহেবের স্মৃতিতে গড়া সৌধটি। ই এল ম্যাকলাস্কি সাহেবের উদ্যোগেই একসময়ে ঝাড়খণ্ডের নাগপুর মালভূমিতে গড়ে উঠেছিল ওই অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের কলোনি। যা আজকের ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। কঙ্কনা সেনশর্মার তৈরি সিনেমা 'আ ডেথ ইন আ গঞ্জ'-এর দৌলতে আজকাল একটু প্রচারের আলো পেয়েছে ম্যাকলস্কিগঞ্জ। এককালে এখানেই ছিল প্রখ্যাত অভিনেত্রী, পরিচালক অপর্ণা সেনদের পৈত্রিক বাড়ি। বাড়ি ছিল বুদ্ধদেব গুহেরও। তবে সে সমস্ত বাংলোরই এখন হাতবদল হয়েছে।

সেসব ছাড়াও এখানে রয়েছে রোমান ক্যাথলিক চ্যাপেল অফ দ্য সেক্রেড হার্ট, জাগৃতি বিহারের মতো জায়গাগুলি। ঘুরে দেখতে পারেন সেসব। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রান্ত দিয়ে বয়ে গিয়েছে দামোদর ও চট্টি নদী। হাঁটতে হাঁটতে যেতে পারেন সেখানেও। ম্যাকলাস্কিগঞ্জকে পাখির চোখ দিয়ে দেখার জন্য যেতে পারেন হেসালাং ওয়াচ টাওয়ারে। বার্ড আই ভিউ যাকে বলে। এছাড়া যেতে পারেন ডেগাডেগি নদী ও কুমারপাত্রা নদী। ডেগাডেগি নদীর বুকে দেখবেন স্থানীয় খুদে ছেলেপিলেদের খেলাধুলা, সবই ওই নদীকে কেন্দ্র করে। মায়াপুর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেতে পারেন নাট্টা পাহাড়ের উপর। যেখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা কিন্তু হতে পারে আপনার জীবনভরের অভিজ্ঞতা। দেখতে পারেন কান্তি ফলস। কাছেই দুল্লি গ্রামে আছে সর্ব-ধর্ম-স্থল। যেখানে একসঙ্গে রয়েছে মন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বার-গির্জা।

বছরের যে কোনও সময়েই ম্যাকলস্কিগঞ্জ বেড়ানোর জন্য় আদর্শ। হাওড়া থেকে একমাত্র শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস সোজা যায় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। কিন্তু সেটা নামায় মাঝরাতে। তাই রাতের ঝক্কি এড়াতে আপনি রাঁচিগামী ট্রেন ধরতে পারেন। রাঁচি থেকে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ৫৬ কিলোমিটার। রাঁচি থেকে গাড়ি পেয়ে যাবেন ম্যাকলাস্কিগঞ্জ যাওয়ার। তবে ম্যাকলস্কিগঞ্জে থাকার জায়গা কিন্তু হাতেগোনা। অবশ্য ইদানীং বহু বাংলোতেই হোমস্টের ব্যবস্থা করেছেন গৃহকর্তারা। রয়েছে পুরনো কিছু কটেজও। গোর্ডন গেস্ট হাউজ, রানাস কান্ট্রি কটেজ, ম্য়াকলাস্কিগঞ্জ গভরমেন্ট গেস্ট হাউজ, ড্রিম ডেস্টিনেশন থাকার জন্য সেরা। সেসবও হয়ে উঠতে পারে আপনার দিন কয়েকের ঠিকানা। ম্যাকলস্কিগঞ্জের রেলস্টেশনটি বেশ পুরনো। এখনও ইংরেজ ঔপনিবেশের ছায়া লেগে রয়েছে সেসব জুড়ে।

আরও পড়ুন:দিঘা-পুরী বাসি! বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরে নির্জনে হোক সস্তার সমুদ্রস্নান

ম্যাকলস্কিগঞ্জের আসল মজা বোধহয় এর জঙ্গলমাখা বুনো হাওয়ায়। যা আপনাকে নস্টালজিক করবে। বুদ্ধদেব গুহর সেই উপন্যাসের মতোই আপনাকে ফিরিয়ে দেবে পুরনো প্রেমের কাছে। আবার সেখান থেকে টেনে নিয়ে যাবে এক অদ্ভুত নৈব্যক্তিক 'আমি'-র কাছে। বুনো ফুল, প্রজাপতি, পাখির ডাক আর পাহাড়ি পথে আলতো পায়ে হেঁটে যাওয়ার যে অনুভূতি ম্যাকনস্কিগঞ্জ দেবে, তা আর ভূভারতে মিলবে না, এ ব্যপারে একশো শতাংশ নিশ্চিত থাকতে পারেন। ফলে চেনা পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গলের বাইরে একটু অন্যরকম বেড়ানোর অভিজ্ঞতা চাইলে, আপনার পরবর্তী কাজ হতেই পারে এই মিনি বিলেত ম্যাকলস্কিগঞ্জ।

More Articles