কুয়াশা দেখে এঁকে ফেলেছিলেন তাজমহল, অবিশ্বাস্য প্রতিভা ছিল অবনীন্দ্রনাথের
এই গল্পটার শুরু হচ্ছে চিৎপুর রোড, বা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলিকে কেন্দ্র করে। চিৎপুর রোড, যা বর্তমানে পরিচিত রবীন্দ্রকানন নামে, সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোলেই চোখে পড়বে দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি। এই গলির পাঁচ এবং ছয় নম্বর বাড়ি হয়ে উঠেছিল নবজাগরণের ভরকেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ থেকে অবন ঠাকুর, একঝাঁক ক্ষণজন্মা প্রতিভার বিচরণভূমি এই দুই বাড়ি, যে বাড়ি ঊনবিংশ শতকের বাঙালিকে বাধ্য করেছিল নতুনভাবে ভাবতে। তবে মুদ্রার উল্টো পিঠটি মোটেই উজ্জ্বল নয়। চিৎপুর রোডের ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে যখন প্রবাহিত হচ্ছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির হাওয়া, ঠিক তখনই চিৎপুর অঞ্চলকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হচ্ছে বাঙালির 'বাবু কালচার'। এই প্রসঙ্গে সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলছেন, "সন্ধ্যে হলেই চিৎপুরের মাঠকোঠা থেকে গানের সুর আর ঘুঙুরের মিঠে আওয়াজ আরম্ভ হয়ে গেছে। চিৎপুরের আশপাশে চোখে সুরমাটানা বাবুদের ভিড়, জুড়িগাড়ি, গলায় ঝোলানো প্যাঁচানো চাদরের বাহার, চুনোট দেওয়া ধুতি… গা থেকে আতরের খুশবু চিৎপুরের সন্ধ্যের হাওয়া ও পরিবেশ মাতাল করে তুলতো।"
এই চিৎপুর রোডে বসেই তাজমহলকে বিষয়বস্তু করে অবনীন্দ্রনাথ মূলত তিনটি ছবি আঁকেন, 'ড্রিম অফ তাজ', 'বিল্ডিং অফ তাজ' এবং ‘পাসিং অ্যাওয়ে অফ শাহজাহান’। এই প্রসঙ্গে সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর 'ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা' বইটিতে। কথা প্রসঙ্গে তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একবার বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর মনে হয়, তাজমহল বেদনার প্রতীক, যদিও এই নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়। এই প্রসঙ্গেই তিনি অবনীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেন, তাজমহল দেখে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কী অনুভূতি? উত্তরে অবনীন্দ্রনাথ তাঁকে জানান, তিনি নিজের চোখে কোনওদিন তাজমহল দেখেননি। তাজমহল সিরিজের ছবিগুলো তিনি এঁকেছিলেন তাজমহল না দেখেই, এমনই ছিল তাঁর প্রতিভা। এমনকী, তিনি সুমিতেন্দ্রনাথকে এও জানান, মুসৌরি যাওয়ার সময় যমুনার ব্রিজের ওপর কুয়াশাময় প্রকৃতিকে দেখেই তিনি এঁকে ফেলেছেন তাজমহল। অথচ এই সিরিজের প্রতিটি ছবি ছিল অসম্ভব প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর।
একবার বাড়ির গুরুজনদের সঙ্গে তাঁর প্রচণ্ড তর্ক হয়। বাড়ির বাকি সবার ধারণা ছিল, অয়েল পেন্টিং আঁকা আয়ত্ত করলেও পোর্ট্রেট আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ এখনও অপারগ। অবনীন্দ্রনাথ হাসিমুখে বাড়ির বাকিদের বলেন, তিনি পোর্ট্রেট এঁকে দেখিয়ে দিতে পারেন। সেই সময় দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলির পাঁচ নম্বর বাড়িতে ছিল দ্বারকানাথ ঠাকুরের একটি পোর্ট্রেট। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বললেন একইরকম পোট্রেট তিনিও আঁকতে পারেন। বাকিদের মুখে তখন অবিশ্বাসের হাসি। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ির অন্যান্যরা ভুলে গেলেন অবনীন্দ্রনাথের সেই পোট্রেট আঁকার কথা, কিন্তু অবন ঠাকুর ভোলেননি। কিছুদিনের মধ্যেই দ্বারকানাথের প্রায় একইরকম একটি পোর্ট্রেট এঁকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বাড়ির বাকিদের।
আরও পড়ুন: বামেরা চেয়েছিল বাদ দিতে || কেন আজও প্রাসঙ্গিক ‘সহজ পাঠ’?
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঠাকুরবাড়ির হাতেই যেমন দিকনির্দেশ হত বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির, ঠিক একইভাবে ঠাকুরবাড়ির আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে ছিল এরকম হাজারও মজার বা প্রতিভার প্রাচুর্যে হতবাক করে দেওয়ার মতো স্মৃতি।