আনন্দগ্রন্থ, শোকগ্রন্থ : আলো-আঁধারির আবিষ্কার কবি অভিরূপ মুখোপাধ্যায়
Joy Goswami: কবির অবচেতন যে কীভাবে কাজ করছে তার নিজের কবিতার মধ্যে তা কবি নিজেই অনেকসময় বুঝতে পারেন না।
এখন দু'টি কবিতার বই আমার সামনে। এই বই দু'টি নিয়েই দু'চার কথা লেখার চেষ্টা করব আজ। বলা দরকার, এ দু'টি বইয়ের লেখক একজনই, অভিরূপ মুখোপাধ্যায়। প্রথম বইটির নাম ‘এই মন রঙের কৌতুক’। প্রকাশ সময় জানুয়ারি ২০২০। এখানে বলে রাখতে ইচ্ছে করছে নিজের কবিতা, আমি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশ করি ১৯৭৭–এর জানুয়ারি মাসে। অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বইটির প্রকাশের ঠিক তেতাল্লিশ বছর আগে। অর্থাৎ, এই কবি আমার চার প্রজন্ম পরে লিখতে এসেছেন। আমি কি এঁর কবিতার মনকে ঠিকভাবে স্পর্শ করতে পারব? এই সন্দেহ আমার যাচ্ছে না। কারণ প্রজন্ম ব্যবধান, যাকে বলে জেনারেশন গ্যাপ, তাকে অতিক্রম করা তো সহজ কাজ নয়! আমি পুরনো যুগের লোক– নতুন যুগের কোনও কবিতাগ্রন্থের ভিতর প্রবেশ করতে গিয়ে আমি ভুল পথ নেব না তো?
এই ভুল পথ গ্রহণ করার আশঙ্কা শুধু এই কারণে আমার মধ্যে জন্মাচ্ছে না যে, আমার প্রথম বইয়ের তেতাল্লিশ বছর পরে এই কবির প্রথম বই প্রকাশ পেয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি আরও গুরুতর। সে কারণ হলো, এই যুবকটিকে আমি প্রায় দিনানুদৈনিকভাবে চিনি। কারও মনে হতে পারে, কবিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনলে তো আরও সহজ হয় কবির লেখাকে চিনতে পারা। কিন্তু, চার দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন কবিদের সঙ্গে মেশার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, ব্যক্তি মানুষকে চিনলেই তাঁর কবিতার সর্বস্ব আমি জেনে নিতে পারলাম এই ধারণার আলেয়া কবির আসল মনকে চেনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভুল পথে নিয়ে যায় পাঠককে– বলা দরকার এই পাঠক অবশ্যই নিজে কবিতা লেখেন এমন পাঠক।
আমি এই আলেয়ার কবলে পড়তে চাই না। কেননা এখনও, এমন কোনও কোনও কবি আছেন, নবীনদের মধ্যেই আছেন– যাঁরা বিবরণধর্মী কবিতার দিকে না গিয়ে নিজের মনের অজানা আলো-অন্ধকারের মুখোমুখি হতে চান। ‘এই মন রঙের কৌতুক’ নামক বইটি পড়তে গিয়ে আমি তেমনই এক রচনাকারের পরিচয় পাচ্ছি। সেই পরিচয় কেমন তা আমার অক্ষম ভাষার দ্বারা সাধারণ পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টার পথে অগ্রসর হওয়ার সময় আমি পূর্বোক্ত কাব্যগ্রন্থ থেকে কয়েকটি কবিতা সামনে রাখব যাতে পাঠক সে-কবিতা সম্পর্কে আমার ধারণায় কোনও ভুল-ভ্রান্তি আছে কিনা নিজের অনুভবের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারবেন।
২
নিজের হাতেই তুমি রেঁধে দাও পরমান্ন রোদ
তবে দুটো খেতে পাই
তোমার ওই থালা-বাসন
দু-বেলা টালার জল
তোমার শরীর মানে এরা
এদের ভেতর থেকে আমি সারাদিন
তুলে আনি মন
দু-কামরার ছোটো ঘর
দুয়ার, উঠোন!
এ কবিতাটির প্রথম লাইন যা বলছে তা প্রত্যক্ষ অর্থসীমার মধ্যে ধরা নয়। কারণ যা ‘রেঁধে দেওয়া’ যায় তার মধ্যে ‘রোদ’ পড়ে না। ‘রোদ’-কে কখনও রন্ধন করা সম্ভব নয়। কিন্তু রন্ধনসম্ভব একটি বস্তু ‘রোদ’ –এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। তা হলো পরমান্ন। কিন্তু যেই পরমান্নের সঙ্গে 'রোদ' কথাটি যুক্ত হলো সঙ্গে সঙ্গে যে রোদ দেখতে আমরা অভ্যস্ত তার অর্থসীমার বাইরে চলে গেল এই রোদ্দুর। আর 'পরমান্ন' শব্দের পবিত্রতা এই রোদ্দুরকে এক আনন্দে রূপান্তরিত করল।
এবার কবিতাটির পরবর্তী অংশের দিকে যাই। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম লাইন বলছে যে ওই ‘রোদ’ রেঁধে দিলে তবে আমি দুটো খেতে পাই। এখানে থালা-বাসন কথাটি আসছে। কারণ খাওয়ার সঙ্গে থালা বাসন সম্পর্কিত। কিন্তু এই থালা-বাসন আসলে কী? এ কবিতায় থালা-বাসন দু'রকম– এক ‘দু'বেলা টালার জল’। টালার জল মানে টালা ট্যাঙ্কের জলই বোঝানো হচ্ছে যা বাড়িতে বাড়িতে কল দিয়ে পড়ে নির্দিষ্ট সময় অন্তর। এইবার আসছে দ্বিতীয় অর্থস্তর ‘থালা-বাসন’ –এর। ‘তোমার শরীর মানে এরা’ – দু'বেলা টালার জল এ-কবিতায় এসে হয়ে গেল তোমার শরীর, তার আগে এরা ছিল থালা-বাসন। কবিতার রহস্যটি এখানেই খেলছে যে ‘তোমার ওই থালা-বাসন’ একবার জল হলো, একবার শরীর হলো। তাহলে কী দাঁড়ায়? এক এক জন পাঠকের কাছে এক এক রকম জিনিস প্রতিভাত হবে ঠিকই কিন্তু আমি এর মধ্যে একটা স্নান করাও দেখতে পাচ্ছি। এরপর কবিতাটির কথক স্বর বলছে : ‘এদের ভেতর থেকে আমি সারাদিন / তুলে আনি মন’ – অর্থাৎ ওই থালা-বাসন যা জল ও শরীরের সহাবস্থানে মিশ্রিত হচ্ছে সেখান থেকে কবিতার কথক তুলে আনছেন কী? মন!
আমরা জানি মনই কবির সবচেয়ে বড় সম্পদ। সে-মন কোথা থেকে পাওয়া যাচ্ছে? তোমার ‘থালা-বাসন’ থেকে যে ‘থালা-বাসন’ –এ তুমি নিজের হাতে ‘পরমান্ন রোদ’ রেঁধে দাও। ‘মন’ শব্দটি আসার পর কবিতাটি একটি স্পেসের বিরতি নিচ্ছে। এবং এই বিরতির পর পাওয়া যাচ্ছে একটা শান্ত ছবি :
“দু-কামরার ছোটো ঘর
দুয়ার, উঠোন!”
এই রোদের পরমান্ন পেতে গেলে অনেক বিরাট আয়োজনের দরকার নেই আমাদের এই কবির কাছে। ‘দু-কামরার ছোটো ঘর / দুয়ার, উঠোন!’–ই যথেষ্ট, বা যথেষ্টর বেশি। এখানে আমরা খেয়াল করলাম না, কবিতাটির রচনাকার একটি অন্ত্যমিল লুকিয়ে রাখলেন কবিতার মধ্যে। কখন যে স্পেসের আগের শেষ শব্দ ‘মন’ কবিতার শেষ শব্দ উঠোনের সঙ্গে একটি মিলন তৈরি করল তা যেন অদৃশ্যই থেকে গেল– কেবল পাঠকের শ্রবণে একটি হাওয়া বয়ে যাওয়ার মতো স্পর্শ দিয়ে গেল এই অন্ত্যানুপ্রাস।
শান্ত, অচঞ্চল একটি আনন্দের কবিতা কীভাবে নারী শরীরকে এনেও তার তোলপাড় আনল না, বরং এক স্থির সৌন্দর্যের দিকে নিয়ে গেল পাঠক হৃদয়কে – সে-কথা পরিস্ফুট হতে পারল কেবল দ্বিতীয় মনযোগী পাঠেই!
এবার অন্য একটি কবিতায় যাই,
আহুতি সবুজ পাতা।
আহুতি মাত্রই
সে-বর্ষার প্রাণ।
এভাবে কি ছুঁতে আছে, বলো?
যজ্ঞাগ্নি নিজেই বলে : হল তো অনেক হল,
এই দেহ তুই আর
কতবার কতভাবে চাস?
আমি শুধু জলের সাধক
ডুবন্ত নৌকায় বসে দেখি –
তোমার শরীর থেকে
জন্ম নিচ্ছে কত না আকাশ!
এর আগের কবিতায় আমরা ‘রোদ’ শব্দটি সম্পূর্ণ নতুন রূপে ব্যবহৃত হতে দেখলাম কেননা তার আগে ‘পরমান্ন’ শব্দটি ছিল আর এই কবিতায় দেখছি ‘আহুতি’ শব্দটির মধ্যে নতুন অর্থস্তরের জন্ম : ‘আহুতি সবুজ পাতা’ এর পরেই আসছেই ‘আহুতি মাত্রই / সে – বর্ষার প্রাণ’। প্রাণের আহুতি তো আমরা বহুকাল ধরে গদ্যে, কবিতায়, বীরবন্দনায় পড়ে এসেছি, তাহলে নতুন কেন? নতুন এই জন্য যে, শুরুতে ‘আহুতি’র পরেই এই প্রথম ‘সবুজ পাতা’ কথাটি এল। ‘আহুতি’ যে সবুজ পাতা হতে পারে একথা আমরা আগে ভাবিনি। ১৯৬২ সালে একটি গদ্যে জানিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ :
“একই শব্দে হয়তো কাজ চলে যায় যেমন এক লোহাতেই সমানভাবে তৈরি হতে পারে শিকল আর হাতিয়ার, কিন্তু শিকলের গাঁটগুলিকে আঘাত করে ভেঙে দেবার কথা ভাবতে হয় কবিকে। একটি বাক্য বা বাক্যখণ্ডের মধ্যে শব্দ সাজাবার যে পদ্ধতি, তারই মধ্যে থেকে যায় এই গাঁটগুলি। ... দুই শব্দের সংযোগ বিন্দুর উপর আক্রমণটাই সবচেয়ে জরুরি, ওইখানে যে মৃত বাঁধনে জড়িয়ে থাকে তারা, সেই বন্ধন খুলে দেওয়াই কবির কাজ”।
বন্ধন খোলার কাজটি পরপর দু'টি কবিতায় আমরা সম্পন্ন হতে দেখলাম। ‘রোদ’-এর আগে ‘পরমান্ন’ এসে এবং ‘আহুতি’র পরে ‘সবুজ পাতা’ এসে ওই কাজটি করিয়ে নিল কবিতাকে দিয়ে– যদিও একথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ‘থালা-বাসন’ কথাটিকেও আমরা নতুন অর্থস্তর লাভ করতে দেখেছি আজকের উল্লেখিত প্রথম কবিতাটিতে। এখানে বলে নেওয়া দরকার, যে বইটি নিয়ে কথা বলছি এখন, তার কোনও কবিতারই নামকরণ করা হয়নি– মাত্রই সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত তারা। ৩ সংখ্যক কবিতাটি নিয়ে আগে কথা বললাম এখন বলছি ১০ সংখ্যক কবিতা নিয়ে। ‘আহুতি সবুজ পাতা’ যেমন প্রথমেই একটি বিস্ময় নিয়ে এসেছিল অভাবিতপূর্ব প্রয়োগের দ্বারা – অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী বিস্ময়ের জন্ম দিচ্ছে ‘আহুতি মাত্রই / সে-বর্ষার প্রাণ’। কেন? কারণ ‘সে’ এবং ‘বর্ষা’ কথাটির মধ্যে একটি হাইফেন অবস্থিত। সে-বর্ষা? কে বর্ষা? ‘সে’ হাইফেন ‘বর্ষা’ থাকায় দ্বিতীয় পাঠে আমরা বুঝি ওই ‘আহুতি সবুজ পাতা’ সে একই সঙ্গে বর্ষাও! এখানে আবার আমাকে ফিরে যেতে হচ্ছে ১৯৬২ সালে লেখা শঙ্খ ঘোষের ওই ছোট প্রবন্ধটির কাছে। সেখানে শঙ্খ ঘোষ বলছেন :
“... বড়ো কবির রচনায় ... ছন্দকে ... তার শব্দ বা তার প্রতিমাকেও মুহূর্ত মধ্যেই চোখে পড়তে দেখি না, তা পড়তে পারে কেবল দ্বিতীয় পাঠে। তাঁর এই উপাদান উপকরণগুলিকে কবি এমন একাগ্র ক্ষমতায় এবং সমগ্রতায় মিলিয়ে দেন যে পৃথকভাবে তার ধাক্কাটা বড়ো হয়ে উঠতে পায় না, আমরা আস্বাদন করি কেবল সমগ্রের।”
এই জন্যই ‘দ্বিতীয় মনযোগী পাঠ’ কথাটির ওপর আমি জোর দিয়েছিলাম আগের কবিতাটির ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রেও সেই দ্বিতীয় পাঠেই আমি ধরতে পারছি যে ‘আহুতি’ একবার যদি সবুজপাতা তো এক লাইন পার হয়েই ওই ‘আহুতি’ হল : ‘সে-বর্ষার প্রাণ!’
এই তিনটি ক্ষুদ্র পঙক্তিতেই সমাপ্ত হল প্রথম স্তবক এবং একটি স্পেসের বিরতি নিল সে। নতুন স্তবক শুরু হচ্ছে একটি সংলাপ দিয়ে – সংলাপটি কে বলছে তা স্পষ্ট করছে না কবিতা – শুধু বলছে ‘এভাবে কি ছুঁতে আছে, বলো?"
এরপর কবিতাটি এই স্তবকে যোগ করছে আরও তিনটি লাইন : ‘যজ্ঞাগ্নি নিজেই বলে : হল তো অনেক হল / এই দেহ তুই আর / কতবার কতভাবে চাস?" তাহলে আমরা দেখলাম প্রথম লাইনের সংলাপটির উত্তর জানাল ‘যজ্ঞাগ্নি’। অর্থাৎ, আগুন এসে পড়ল কবিতায় – এইখানে আমরা ভুলে যাই না যে কবিতার প্রথম শব্দে ‘আহুতি’ আছে যে! ‘আহুতি’ কি অগ্নিতে হয় না?
এরপর আবার স্পেসের শূন্যতা ডেকে আনে কবিতাটি। নতুন স্তবক হিসেবে আসে মাত্র দু'টি লাইন ‘আমি শুধু জলের সাধক / ডুবন্ত নৌকায় বসে দেখি’ – কী দেখে সে? কবিতার কথকস্বর? সে উত্তরে পৌঁছবার আগে আমাদের আবারও একটি স্পেসের বিরতি পেয়ে থমকে দাঁড়াতে হয়। নতুন স্তবক কবিতার সমাপ্তি এনে দেয় এই বলে : ‘তোমার শরীর থেকে / জন্ম নিচ্ছে কত না আকাশ!’ এই শেষ দু'টি লাইন তার প্রথমটিকে আট মাত্রায় থামিয়ে রাখে কিন্তু শেষে কোনও যতিচিহ্ন আনে না। ফলে পরবর্তী দশ মাত্রায় লাইনটিকে আমরা যখন পড়ি তখন আমাদের অজান্তেই আগের লাইনের আটমাত্রা পরের লাইনের দশ মাত্রার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ১৮ মাত্রার একটি দীর্ঘ বাক্য হিসেবে কবিতাটিকে সম্পূর্ণ করে। এইবার আমরা আবার এই কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের শেষ লাইনে ফিরে যাই। সেখানে আছে ‘কতবার কতভাবে চাস’ এই লাইনের সঙ্গে ‘জন্ম নিচ্ছে কত না আকাশ’ দূরে দূরে স্থাপিত অন্ত্যমিলে যুক্ত হয়। দ্বিতীয় স্তবকের শেষ তিনটি লাইন যদি আমরা ছন্দের দিক থেকে দেখি তাহলে আমরা ‘যজ্ঞাগ্নি’-র প্রশ্নটিকে ৩৪ মাত্রায় পাই, ৩ টি পঙক্তিতে ভগ্ন অবস্থায়। ভগ্ন, কিন্তু ভগ্ন নয় – কারণ ২ মাত্রা পূর্ণ হওয়ার চাহিদা প্রথম দু'টি লাইন বজায় রাখছে। এই চাহিদা কেন আসছে, ছন্দের ক্ষেত্রে? কারণ কবিতাটির বিষয়বস্তু বলছে, ‘যজ্ঞাগ্নি’–র স্বর নিয়ে বলছে, এই দেহ আর কতবার কতভাবে চাস তুই? এই প্রশ্নটির মধ্যে বারবার শরীর দেওয়ার সংকেত ধাক্কা দিচ্ছে পাঠককে – কারণ আগুনে শরীর দেওয়া মানে তো এখানে শেষ সৎকার নয়। এ হল শরীরকে শরীর দেওয়া! তার একটা তোলপাড় আছে না? তাই জন্য ৩৪ মাত্রা ধরে ওই তোলপাড় ঘূর্ণিত হচ্ছে ছন্দে অপূর্ণ পর্ব ২ বার অব্যবহৃত রেখে– অর্থাৎ শ্বাসটি আমরা শেষ পর্যন্ত চাইছি! মিলনের ক্ষেত্রেও, শরীর মিলনে শ্বাস স্বাভাবিক থাকে না নারী পুরুষের। শ্বাস দ্রুত হয়, দ্রুততর হয়। তাই পরপর দু'টি লাইনে অপূর্ণ পর্ব রেখে ছন্দকে শ্বাস ফেলতে দেওয়া হল না। আগুনের সঙ্গে ‘আহুতি’র সম্পর্ক তার টানাপোড়েন নিয়ে এইভাবে অবস্থিত রইল কবিতাটিতে কোনও উচ্চকিত উত্থান পতন ছাড়াই। তৃতীয় স্তবক এবং চতুর্থ স্তবক পড়ার পর আমরা দেখি যে আসলে পুরো কবিতাটি জুড়ে না হলেও, দ্বিতীয় স্তবক থেকেই একটি সংলাপ চলছে। সে – সংলাপ কখনও উত্তেজিত কখনও শান্ত। উত্তেজিত কীভাবে? দ্বিতীয় স্তবকের দ্বিতীয় লাইন থেকে চতুর্থ লাইন পর্যন্ত ছন্দের মাত্রা বণ্টনের টেনশন প্রয়োগে এ কবিতা উত্তেজিত।
কবিতার প্রথম স্তবকের শেষ লাইনে আমরা বর্ষাকে পেয়েছি যে বর্ষা আহুতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে নতুন অর্থজন্ম নিয়েছে। বর্ষা মানে জল। কবিতার তৃতীয় স্তবক উদাসীন কণ্ঠে বলছে : ‘আমি শুধু জলের সাধক’। প্রথম স্তবকের শেষ লাইন বর্ষায় যে জলের সংকেত ছিল তা ফিরে এল কবিতাটির তৃতীয় স্তবকের প্রথম লাইনে। এইভাবে আগুনের সঙ্গে আগুন, জলের সঙ্গে জল যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু আমি একটু আগে কবিতাটির কথকস্বরের ক্ষেত্রে ‘উদাসীন’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। কারণ এই ‘জলের সাধক’ কোথায় রয়েছে? সে রয়েছে এক ‘ডুবন্ত নৌকায়’। ডুবন্ত কিন্তু সে নিরাশ নয়। সে দেখছে ‘তোমার শরীর থেকে জন্ম নিচ্ছে কত না আকাশ!’ একটি নদী বা সমুদ্রবক্ষ, একটি রাত্রিকাল এবং তারা ভরা আকাশ– সবই পাঠকের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। আর তারায় তারায় তো যজ্ঞাগ্নি জ্বলমান। তারায় তারায় আহুতিও! যে ডুবে যাচ্ছে সে কি কোনও শরীরে ডুবছে? আর আবিষ্কার করছে শরীরের মধ্যে ‘কত না আকাশ’! এ কবিতা দুঃখকে স্পর্শ করে না ডুবন্ত নৌকায় বসেও! বরং আহুতি – আনন্দকে দেখে! আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় না এ কবিতা মিলনে ডুবে গেল কি? নাকি পূর্ব কোনও মিলন স্মৃতির মধ্যে এই জলের সাধকের ডুবন্ত নৌকায় বসে থাকা? শরীর যখন মিলিত হয় শরীরের সঙ্গে তখন তো এক শরীর অন্য শরীরে ডুবেই যায়! অথচ ‘জলের সাধক’ শব্দটির মধ্যে মিলন সত্ত্বেও কবিতার কথকস্বরের এক দূরত্বও সূচিত হয়ে থাকে। ফলে কবিতাটি আমাদের রহস্যময় এক প্রেমের আলো অন্ধকারে ভাসিয়ে রেখে ছেড়ে যায়। এমন কবিতা পড়ার পর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধভাবে বসে থাকতে হয়। কাব্যগ্রন্থের পরের কবিতাটি তৎক্ষণাৎ পড়তে পারা যায় না। আমরাও একটু অপেক্ষা করি।
৩
নিজের শরীরকে ঈর্ষা হয়।
পাখিদের ঈর্ষা বোঝো খোকা?
ঈর্ষাটি গড়িয়ে পড়ে সন্ধ্যার বাতাসে
শরীরে অনেক যুগ ছিল
সে – যুগের শালিখ আলাদা
নিজমনে বলছে মায়াদিদি
দিদির কণ্ঠের মালা পুরাতনী ঘাসে...
আমি এবার দেখছি এই কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতাকে যেটি ২২ সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত। এই নবীন কবি আবারও এমন একটি লাইন প্রথমেই লিখছেন যে অনুভবের কথা আমরা বাংলা কবিতায় আগে দেখিনি। ‘নিজের শরীরকে ঈর্ষা হয়’ সত্যি সত্যিই কি কখনও মানুষ নিজের শরীরকে ঈর্ষা করে? নিজের শরীর সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী, গর্বোদ্ধত অনুভব আমরা কতই দেখি। অল্প হলেও দেখতে পাই নিজের স্বাস্থ্যহীনতায়, নিজ শরীর বিষয়ে হীনমন্য, কুণ্ঠিত, সসংকোচ মনোভাবও। কিন্তু নিজের শরীরকে ঈর্ষা? এখানে ‘ঈর্ষা’ শব্দটি নতুনভাবে কাজে লাগল কবিতায়। প্রথম লাইনটি নিয়ে কথা বললাম এতক্ষণ। দ্বিতীয় লাইনটি তৎক্ষণাৎ আরও একটি অভাবিতকে এনে দিচ্ছে আমাদের সামনে : ‘পাখিদের ঈর্ষা বোঝো খোকা?" নিজের শরীরকে ‘ঈর্ষা’ করা পরিবর্তিত হয়ে এখানে পাখিদের ‘ঈর্ষা’য় গিয়ে দাঁড়াল। তারপরেই একটি অপ্রত্যাশিতের আঘাত আনল ‘খোকা’ শব্দটির প্রয়োগ। একি কবিতার কথকস্বর নিজেকেই বলছে? নাকি তাকেই বলছে অন্য কেউ? এখানে বলা দরকার, এ লাইনে ‘বোঝো’ শব্দটির পর আমি একটি অদৃশ্য কমা কল্পনা করে নিচ্ছি। কেননা ‘বোঝো’ কথাটির পরে অর্থযতি আমাকে নিতেই হচ্ছে। কবিতাটির লেখক অধিকন্তু বিবেচনায় কমাটি বসাননি কারণ তিনি জানেন ‘বোঝো’ পড়বার পর পাঠককে আধ সেকেন্ড থামতেই হবে। তাহলে আমি অকারণে একটি কমা নষ্ট করব কেন! এর পরের লাইনে ঘটছে আবারও এক অভাবিতের আগমন : ‘ঈর্ষাটি গড়িয়ে পড়ে সন্ধ্যার বাতাসে’। ‘ঈর্ষা’ কখনও সন্ধ্যার বাতাসে গড়িয়ে পড়ছে এমন কোনও অভিব্যক্তি আমরা বাংলা কবিতায় এর আগে দেখেছি কি? ‘ঈর্ষা’ শব্দটির সঙ্গে একটি কালিমাচিহ্ন যুক্তই থাকে। ‘সন্ধ্যার বাতাসে’ শব্দদু'টি এসে সেই কালিমা চিহ্নকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল সাঁঝবেলার স্নিগ্ধ স্পন্দনে। এইখানেই থেমে গেল প্রথম স্তবক। এসে পড়ল স্পেস অর্থাৎ আমরা থামলাম। এই তিনটি লাইনে ‘ঈর্ষা’কে নিয়ে যা বলা হলো তা সবটাই এতদিন পর্যন্ত জানা ‘ঈর্ষা’র চরিত্র থেকে পৃথক। প্রথমত নিজের শরীরকে ঈর্ষা হয় এই স্টেটমেন্ট। এ কখনও শুনিনি। দ্বিতীয় লাইনে তা হয়ে গেল ‘পাখিদের ঈর্ষা’ এবং ‘খোকা’ সম্বোধন যুক্ত হয়ে মৃদু কৌতুক – ঢেউ এসে পড়া – এই দু'রকম অচেনা অনুভবের অনুচ্চকিত ঘর্ষণ তৈরি হলো। ‘পাখিদের ঈর্ষা’ কি হয়? হতে পারে? যেমন ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ একসময় হতে পারত না তেমনই এখনও কারও কারও মনে ‘পাখিদের ঈর্ষা’ কি হওয়া সম্ভব? এমন প্রশ্ন জাগা অসঙ্গত নয়। কিন্তু কবিতা যিনি লিখছেন তিনি যদি বিবরণধর্মীতার পথ ত্যাগ করেন তাহলে নানারকম অসম্ভবকে কবিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করা তাঁর পক্ষে আশ্চর্য বিষয় হবে না। এক্ষেত্রেও হয়নি।
বাকি কবিতাটিতে আছে আর চারটি মাত্র লাইন। তা এসেছে কীভাবে? দু' লাইন স্পেস দু' লাইন, এভাবে এসেছে। দ্বিতীয় স্তবকে ঢোকার আগে এটুকু বলে নিই যে এই কবিতার প্রথম স্তবকে পরপর দু'টি লাইন শেষ হয়েছিল দাঁড়ি এবং জিজ্ঞাসাচিহ্ন দিয়ে। স্তবকের তৃতীয় বা শেষ লাইনের অন্তে কোনও যতিচিহ্ন বসানো হয়নি। এর ফলে এমন ধারণা আসে যে ‘ঈর্ষাটি’ সন্ধ্যার বাতাসে গড়িয়ে পড়ে যেন এক অকূল দূরে মিলিয়ে গেল! কেননা পরের চারটি লাইনে কোথাও ‘ঈর্ষা’র উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে না।
দ্বিতীয় স্তবকের প্রথম লাইন আবার এক বিস্ময়কে নিয়ে এল : ‘শরীরে অনেক যুগ ছিল’। শরীরে যে অনেক ‘যুগ’ থাকতে পারে এই ভাবনাও আমি কোনও কবিতায় পূর্বে দেখিনি, ঠিক এইভাবে দেখিনি। সত্যিই তো ‘যুগ’ কথাটির একটি ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Age’। আবার ‘Age’-এর অর্থ দাঁড়ায় বয়স। ফলে বাইরের দিক থেকে শরীরে অনেক বয়স আসতে পারে– বাল্য, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব– এমন সহজ সাধারণ অর্থ হতে পারত কবিতাটির কিন্তু লেখক সে দিকে নিয়ে গেলেন না পাঠককে বা বলা যেতে পারে পাঠকের মন সেদিকে বাঁক নেওয়ার পূর্ব মুহূর্তেই পরের লাইনটি যুক্ত করে কবিতাটিকে আবার প্রত্যক্ষ অর্থস্তর থেকে ছাড়িয়ে তার একটু ওপরে ভাসমান রাখা হল। পরের লাইনটি কী? ‘সে যুগের শালিখ আলাদা’। ‘শালিখ’ কথাটি যেই বলা হচ্ছে তখনই একদিকে প্রত্যক্ষ অর্থস্তরের বাইরে চলে যাচ্ছে কবিতাটি, কারণ যুগের আবার শালিখ হয় নাকি! আবার অন্যদিকে প্রথম স্তবকের ‘পাখিদের ঈর্ষা’ যে বলা হয়েছিল সেই উচ্চারণের সঙ্গে একটি সেতু তৈরি করছে ‘শালিখ’ কথাটি। কারণ শালিখ তো পাখিই! আর ‘শরীরে অনেক যুগ ছিল’ সব যুগ মিলে একটিই যুগ হয়ে যায় যেন কেননা ‘সে-যুগ’ কথাটি আছে। অর্থাৎ দু'টি মাত্র লাইনে একবার শরীরকে অনেকযুগে ছড়িয়ে দেওয়া হলো পরবর্তী লাইনেই যুগগুলিকে একত্রিত করা হল যেন মুঠোধৃত ধুলোর মতন। এই হল সংকেত ধর্মে গতিশীল কবিতার মুহর্মুহ বিস্ময়সঞ্চার!
এদিকে দ্বিতীয় স্তবক শেষ হয়েছে। স্তবকের দু'টি লাইনেরই শেষে কোনও যতিচিহ্ন নেই। অর্থাৎ লাইন দু'টি মুক্ত। এইবার এসে পড়ছে শেষ স্তবক। শেষ স্তবকও দু'টি লাইন দিয়েই তৈরি। এবং তার প্রথম লাইনের শেষ শব্দ হিসেবে দেখা গেল একটি চরিত্রনাম। ‘মায়াদিদি’। মায়াদিদি স্বগতোক্তি-নিমগ্না এটুকু জানাল শেষ স্তবকের প্রথম লাইন। আর শেষ লাইন কী জানাল? সে জানাল এক অপূর্ব সৌন্দর্যকে : ‘দিদির কণ্ঠের মালা পুরাতনী ঘাসে ...’। এই দিদিরই কি এতক্ষণ উপস্থিত ছিল কবিতায়? প্রথম স্তবকের দ্বিতীয় লাইনের শেষ শব্দ ‘খোকা’ এইবার, এই মায়াদিদির প্রবেশমাত্র যেন আরও এক অর্থস্তর পরিস্ফুট করে। কবিতার দ্বিতীয় লাইনটি কি ‘খোকা’ সম্বোধনে বহন করছে এই ‘মায়াদিদি’রই স্বর? কবিতা সেকথাও আবছা রেখে দেয়। ‘পুরাতনী’ শব্দটি আমাদের সংযুক্ত করে ‘শরীরে অনেক যুগ ছিল’ – এই ‘ছিল’-র অতীত স্পর্শের সঙ্গে। ছিল মানেই তো যা এখন আর ধরা যাবে না। আবার ‘পুরাতনী’ বললে পুরাতনী গানের কথাও মনে আসে। ‘দিদির কণ্ঠের মালা’ সেই ঘাসকে স্পর্শ করে নিজেই ‘পুরাতনী সংগীত’ হয়ে ওঠে।
এই কবিতার অনির্বচনীয় ভাববস্তু কোনও স্পষ্ট ও একমাত্রিক অর্থের দিকে অগ্রসর হয় না। বরং দিকে দিকে কবিতার অর্থ কল্পনার দ্যুতি বিকিরণ করে। আমরা একথা মনে রাখি যে দিদির নাম ‘মায়াদিদি’। ইনি কি স্বয়ং ‘মায়া’? দিদিরূপ ধরে এ লেখায় দেখা দিয়েছেন? এইসব ভাবনার মৃদু আলোকিত মেঘবলয় আমার মনের চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মনে হয় এমন স্বাধীন কবিতা পড়ার ভাগ্য কত অল্পই ঘটে এখন!
এরপরে আমরা পড়ে দেখব এই বইয়ের ৩৩ সংখ্যা চিহ্নিত কবিতাটি।
শালিখের বাসা
ক-ফোঁটা রোদ্দুর তার খসে পড়া জানো?
না যদি জানোই
তবে কেন ফুলগাছ লাগাও
এমন সবুজতর ভুলে?
সতীর বাগানে এসে ‘অ’ নিজে বসেছে মুকুলে ...
এই কবিতাটিতেও আমরা ‘শালিখ’ শব্দটি দেখতে পাচ্ছি প্রথম লাইনেই। কিন্তু শালিখ নিজে আর এ কবিতায় নেই। আছে মাত্র শালিখের বাসা। প্রথম লাইনের পরে শালিখ ও তার বাসার উপস্থিতিও আর দেখা যাবে না কবিতাটির মধ্যে। দ্বিতীয় লাইন বলছে : ‘ক-ফোঁটা রোদ্দুর তার খসে পড়া জানো?’ শালিখের বাসা গাছ থেকে খসে পড়ছে। এই সহজ দৃশ্যটি আমাদের সকলেরই পরিচিত। কিন্তু লাইনটি অপ্রত্যাশিতের দিকে উড়ে যাচ্ছে তার দু'টি কারণ। প্রথম কারণটি প্রধান। ‘ক-ফোঁটা রোদ্দুর’ কথাটির মধ্যে রোদ্দুরকে জলবিন্দু করে দেওয়া হলো। ‘ক-ফোঁটা রোদ্দুর’ জানতে পারে শালিখের বাসা খসে পড়ার সংবাদ?
এই হলো কথক স্বরের প্রশ্ন। এই প্রশ্নেই থেমে যাচ্ছে প্রথম স্তবক। দ্বিতীর স্তবকের আরম্ভেই আমরা বুঝতে পারছি কথক স্বর এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। তাই আসছে কবিতায় পরের তিনটি লাইন। ‘না যদি জানোই’ দিয়ে যে স্তবকের শুরু। এবং সে স্বরের মৃদু অনুযোগ না জানলেও ‘কেন ফুলগাছ লাগাও/ এমন সবুজতর ভুলে?’
রোদ্দুর কি ফুলগাছ লাগায় কখনও? এ তো অবাস্তব! এবং ‘সবুজতর ভুল’ কথাটির মানে কী? প্রথম কথা, রোদ্দুর ক'ফোঁটা হতে পারে না। দ্বিতীয় কথা, রোদ্দুর ফুলগাছ লাগাতে পারে না। অতএব দু'টিই ভুল কথা যা কবি লিখছেন? কিন্তু তা কেমন ভুল? তা এক ‘সবুজতর ভুল’! এমন ‘সবুজতর ভুল’-এর দিকে যদি কবিতা এগোয় তাকে আমরা ভুল কবিতা বলতে পারি কেননা এমন সংকেত ধর্মী বাক্য ব্যবহার নবীন প্রজন্মের কবিতা নিজের শরীরে নিতে চায় খুব অল্পই। বরং সরলরৈখিক প্রক্রিয়াকেই মান্য বলে ধার্য করেছে কবিতা লেখার সাম্প্রতিক গতিপথ। ফলে এই বইটির মধ্যে যে একটি লাইন থেকে অন্য লাইনে যাওয়ার সময় ‘উল্লম্ফন ক্রিয়া’-র ব্যবহার ঘটাচ্ছে কবিতাগুলি তার বহুবর্ণ অর্থবিচ্ছুরণ প্রত্যেক কবিতাকেই দু'টি করে ডানা উপহার দিচ্ছে। আর কবিতাগুলি উড়ে যাচ্ছে একগামী অর্থের সীমাবদ্ধতা ভেঙে দিগন্তের দিকে!
যে কবিতা নিয়ে কথা বলছিলাম, সে কবিতাটি তার দ্বিতীয় স্তবক সম্পূর্ণ করেছে ‘এমন সবুজতর ভুলে’ কথটি দিয়ে এবং শেষে রেখেছে একটি জিজ্ঞাসাচিহ্ন। প্রথম স্তবকটির শেষেও অমন জিজ্ঞাসাচিহ্ন বিদ্যমান। অর্থাৎ কবিতাটি চলেছে প্রশ্ন করতে করতে। এইবার, দ্বিতীয় স্তবক থেমে যাওয়ার পর, একটি স্পেসের বিরতি নিয়ে, সব প্রশ্নেরই উত্তর কবিতাটি জানায় একটি মাত্র লাইনে : ‘সতীর বাগানে এসে ‘অ’ নিজে বসেছে মুকুলে...’।
চরম সৌন্দর্যের দিকে আমাদের আহ্বান করে লাইনটি। সঙ্গে সঙ্গে সমাজকেও সে ভোলে না। সমাজ যাকে অসতী বলে সে তো এক ‘মুকুল’! যে মুকুলের সামনে ‘অ’ নিজে এসে বসে। অর্থাৎ জীবনে একটি পুরুষ সম্পর্ক নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পরে কোনও নারী যদি অন্য পুরুষে জড়িত হয়ে পড়ে তা হলেই সে কি ‘অসতী’? সমাজ সেকথা বলে বটে কিন্তু এমন সম্পর্ক তো ঈশ্বরেরই দান। ঈশ্বরের ঐশ্বর্যের আরও এক রূপ সে। কে? কেন, ওই ‘অ’, যে নিজে এসে সতীর বাগানে ঢুকে পড়ে। কবিতা সিংহের কবিতা আমাদের জানায় :
কিন্তু পুরুষ দেখ – ‘অসতী’ নামক শব্দ পুংলিঙ্গ হীন
এবং ‘বেশ্যা’ শব্দ, এবং ‘ছিনাল’!
হ্যাঁ, অসতী শব্দ সমাজেরই সৃষ্টি যে সমাজ পুরুষের আধিপত্য দ্বারা চালিত। কিন্তু কবিতা সিংহের লাইনগুলির মতো আমাদের এই অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাটি কোনও ক্ষোভ, রোষ, দোষারোপকে জানায় না। পরিবর্তে এক পুষ্পগুচ্ছের মতো মাধুর্যের স্তোত্রগান সামনে এনে দেয়। এই কবিতার বিশেষ ও শেষ লাইনটির মধ্যে এটিও প্রমাণিত হয় যে, বয়সে নবীন হলেও এ কবির ছন্দবোধ কী অসামান্যতায় পৌঁছতে পারে! কেন বলছি একথা? কারণ ‘অ’ বর্ণটিকে ২ মাত্রা ধরা হয়েছে কবিতায় অথচ বিন্দুমাত্র ছন্দপতন ঘটেনি! ‘অ’ কথাটিতে ১টি মাত্রা কম রাখার মানে কি এই যে ‘অসতী’ বলে সমাজ যাকে চিহ্নিত করে, তার পরিচয়ের আগে ‘অ’ একটি বর্ণ অথচ ২ মাত্রা পূর্ণ করে দিচ্ছে উচ্চারণ সময়ে! কেন তা হচ্ছে? কেন ‘অ’ বর্ণটিকে একটু বেশি সময় নিয়ে উচ্চারণে আমাদের বাধ্য করছেন লেখক? কেন না ‘অসতী’ বলে তো কিছু হয় না। প্রেম হয়। একাধিক প্রেম! হয়তো বা একই সঙ্গে একাধিক। গৌড় সারঙ্গ আর শুদ্ধ সারঙ্গ – দুটোই তো মধ্যাহ্নের রাগ। কিন্তু গৌড় সারঙ্গের মাঝখানে আমরা স্বরসংগতির মধ্যে বেহাগ আভাস পাই। বেহাগ তো রাত্রের! অর্থাৎ, দুপুরের রাগের মধ্যে রাত্রির রাগ মিশে থাকতে পারে। তাহলে একটা জীবনে কি একাধিক প্রেম মিশে থাকতে পারে না? সমাজ বলে, পারে না। কবি বলেন, পারে। সেই কারণেই ‘অ’ বর্ণটিকে ছন্দসিদ্ধ নবীন কবি এমনভাবে প্রয়োগ করলেন যাতে ছন্দের দ্বিতীয় মাত্রাটি এখানে যুক্ত হয়ে গেল। অর্থাৎ বাইরের চোখে সে ‘অসতী’ কিন্তু তার অন্তরে, তার প্রণয়ের কাছে সৎ। ছন্দ কোথা থেকে আসে? বিষয়বস্তুর জরায়ু থেকে। তাই, এই কবিতাটির ক্ষেত্রে আমাদের নবীন কবি তার প্রথম বইতেই প্রমাণ করলেন ছন্দকে তিনি বাইরের আইন-কানুন, বাইরের আঙুলে গোনা মাত্রা দিয়ে বিচার করেন না। তার ছন্দ তৈরি হয় অর্থবস্তুর উদ্ভাসন ঘটানোর জন্য। তাই ‘অ’ একটি বর্ণে তিনি ২ টি মাত্রা আমাদের দিয়ে উচ্চারণ করিয়ে নেন। কেননা ‘অসতী’ বলে তো কিছু হতে পারে না – তাই ‘অ’ বর্ণের পরে ওই মাত্রাটিকে ফাঁকা রাখা হলো অথচ উচ্চারণ ভরিয়ে দিল সেই ফাঁক। ফলে আমরা পেলাম এই অবিস্মরণীয় কবিতা পঙক্তি : ‘সতীর বাগানে এসে ‘অ’ নিজে বসেছে মুকুলে’ এবং শেষ লাইনটির সৌন্দর্য বিস্তারে অভিভূত হয়ে আমরা ভুলেই গেলাম যে এই কবিতার অন্তিম দুই পঙক্তির মধ্যে গাঁথা রইল ‘ভুলে / মুকুলে’ - এই অন্ত্যমিল! নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থেই কোনও কবি সংকেত ধর্মের এই উচ্চতা এবং প্রকরণ দক্ষতাকে গোপন করবার এই সামর্থ্য প্রস্ফুটিত করছেন বলে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা হয়। আমার নিজের প্রথম বইয়ে আমি কি তা পেরেছিলাম? আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, পারিনি।
এরপর আমরা এই কাব্যগ্রন্থ থেকে ৪ লাইনের একটি কবিতা নিচ্ছি। কবিতাটি এইরকম :
দেখামাত্র জন্ম নিল মেঘে
দেহজল। পাওয়া মাত্র মরি মরি।
তুমি নিজে আনন্দের নেতা।
রঙ, রূপ, শ্রীহরি শ্রীহরি!
৪ লাইনের কবিতা দু'টি খণ্ডে বিন্যস্ত। ১০ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে বাঁধা এই লেখা। প্রথম লাইন : ‘দেখামাত্র জন্ম নিল মেঘে’ - এখানে যখন লাইনটি শেষ হয় তখন পাঠকের মনে এক কৌতুহল জাগে, কী জন্ম নিল? পরবর্তী লাইনের প্রথম শব্দটি তার উত্তর দেয় : ‘দেহজল’। উত্তরটি পাওয়া মাত্র আমরা একটি পূর্ণচ্ছেদ দেখি। অর্থাৎ ‘দেহজল’ এক্ষেত্রে নিশ্চিত একটি সিদ্ধান্ত।
‘দেহজল’ প্রাপ্তির পরক্ষণে কী ঘটে? কবিতার কথকস্বর জানায় : ‘পাওয়া মাত্র মরি’। এরপর আবার পূর্ণচ্ছেদ এবং পূর্ণচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে স্তবকের সমাপ্তি। তারপর স্পেস। স্পেসের পর নতুন স্তবকের প্রথমে আমরা দেখি এক স্বীকারোক্তি যা বলছে : ‘তুমি নিজে আনন্দের নেতা’। আবারও পূর্ণচ্ছেদ। ‘আনন্দের নেতা’ এই শব্দদু'টির পাশাপাশি অবস্থানও রবীন্দ্রনাথের কবিতার পর এইখানে এসে সম্পূর্ণ নতুনভাবে পুনর্জন্ম নিল। আর এই উচ্চারণ শোনায় এক বন্দনার মতো। ‘বন্দনা’ শব্দটির অনুমান যে সম্পূর্ণ ভুল নয় তার নিশ্চয়তা দেয় স্তবকের এবং কবিতার শেষ লাইনটি : ‘রং, রূপ, শ্রীহরি, শ্রীহরি’! রবীন্দ্রনাথকে সচেতন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে এনেই পরবর্তী লাইনে ‘শ্রীহরি শ্রীহরি’ ধ্বনির উত্থানকে যুক্ত করায় নতুন দিকনির্দেশ পেল কবিতাটি।
এই কবিতা যে ‘শ্রীহরি শ্রীহরি’ এমন প্রার্থনা গানে উদ্দীপিত হয়ে উঠবে তা আমাদের পূর্ব ধারণায় ছিল না কবিতাটির আরম্ভ-সময়ে। অপ্রত্যাশিত এক উত্থানে জগৎ আনন্দময় হয়ে ওঠে। ‘আনন্দের নেতা’ কথাটি কেন এসেছিল তা পরিস্ফুট হয় এবং প্রথম স্তবকের শেষ শব্দ ‘মরি’ কেন এল তাও বোঝা যায়। ‘রং, রূপ, শ্রীহরি শ্রীহরি’! জগৎবাসী এক ভাসমান আনন্দের তরঙ্গই আসলে ‘মরি’ শব্দটি দিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের গান ‘ওহে সুন্দর মরি মরি’। বাহার রাগের এই রবীন্দ্রগীতি যেন এই কবিতাটিকেও একই রাগাশ্রয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং এখানে আমাদের মানতেই হয় যে ‘এই মন রঙের কৌতুক’ এই বইটির মূল রাগ ‘আনন্দ’। ‘আনন্দ’ নামে যদিও কোনও রাগ আছে কিনা জানিনা শাস্ত্রীয় সংগীতে। তবু এই বইরের যে ‘আনন্দ’ রাগের উত্থান ঘটেছে তার জন্মকেন্দ্র প্রেম নামক চিরস্থায়ী মানব অনুভবে স্থাপিত। কেবল আনন্দআশ্রয়ী একটি কাব্যগ্রন্থ কতদিন পরে যে পড়লাম! এই আনন্দকে বিভিন্ন প্রকারে জানানো হয়েছে এই গ্রন্থের কবিতাগুচ্ছে এবং সম্পূর্ণ কবিতা নয় দু'একটা টুকরো লাইন বলব। তাহলেই ধরা পড়বে আমার এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর যৌক্তিকতা! ‘কম-সে-কম স্বর মে রাগ বাতাইয়ে,’ এই রকম প্রশ্ন গানের পরীক্ষা দিতে যাওয়া নবীন শিক্ষার্থীকে জানিয়ে থাকেন পরীক্ষকরা। কারণ রাগের মূল কীভাবে স্বল্প কয়েকটি স্বরে প্রতিভাত করা যায় তা এই শিক্ষার্থী অধিগত করতে পেরেছেন কিনা তারই প্রমাণ চান পরীক্ষক। আমিও এখানে ‘কম-সে-কম স্বর মে রাগ’ আনন্দকে কীভাবে ধরেছেন এই তরুণ কবি তা বলার চেষ্টা করছি। দু'টি লাইন ধরা যাক,
এই মন রঙের কৌতুক
তার শ্রীমস্তকে ওড়ে ভ্রম
এবং
স্বাদ ভ্রমে ইট পাতছে। লুকিয়ে বেড়ার জমি
এগিয়ে নিয়েছে ওই দীঘি অব্দি মন...
আনন্দকে এখানে এক ছদ্মবিবৃতি, ‘সিউডোস্টেটমেন্ট’ [‘সিউডোস্টেটমেন্ট’ শব্দটির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক অর্থে একটি টীকা যোগ করেছেন লেখক] দ্বারা ‘ভ্রম’ বলে চিহ্নিত করা হলো কারণ ‘ভ্রম’ এখানে ‘ভ্রম’ নয়। তা নতুন অর্থস্তর পরিগ্রহ করছে। ‘এই মন রঙের কৌতুক’ এটি কাব্যগ্রন্থের নাম, ফলে আমরা দেখি কাব্যগ্রন্থের শ্রীমস্তকে এক ‘ভ্রম’ ওড়ে। ‘মস্তক’ এর আগে ‘শ্রী’ যোগ করায় ‘ভ্রম’ আর ‘ভ্রম’ রইল না। তার আগের লাইনে ‘রঙের কৌতুক’ কথাটি এসে আনন্দকে একটি ‘স্পর্শ স্বরের’ মতো ব্যবহার করল। বইয়ের মূলকেন্দ্র ছুঁয়ে গেল। আবার ‘স্বাদ ভ্রমে ইট পাতছে’। এখানে ‘ভ্রম’ শব্দটি যেভাবে প্রযুক্ত হলো তা বাংলা কবিতায় কখনও হয়েছে বলে আমি জানি না।
[টীকা প্রসঙ্গে ছদ্মবিবৃতি বলতে কী বোঝায়? তিরিশের দশকে এক প্রধান কবি তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন :
‘জানি কোনও দিন ফিরবে না ফাল্গুনী;
তবে অঞ্জলি উদ্যত কেন পলাশে?
বনের বাহিরে ক্ষওয়া মাটি ধূ ধূ করে;
নেই ফসলের দুরাশাও অম্বরে;
যা ছিল বলার, কবে হয়ে গেছে বলা সে’।।
১৯৫৪ সালের ২৭ জুলাই এ কবিতা লেখার পরে ১৯৫৫-তেই তিনি প্রকাশ করবেন অনুদিত কাব্যের বই ‘প্রতিধ্বনি’ যেখানে শেক্সপিয়ার থেকে হাইনে মালার্মের, সকলের কবিতা থাকবে। ১৯৫৬ সালে প্রকাশ করবেন তার ‘দশমী’ নামক কবিতার বই। মালার্মের কবিতা সম্ভবত এই প্রথম আসবে বঙ্গানুবাদে। ১৯৫৭ সালে বেরোবে প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কুলায় ও কালপুরুষ’। কখনও কবিতায়, কখনও কবিতার অনুবাদে, কখনও প্রবন্ধে কবি বলে চলবেন তাঁর কথা। ১৯৬০ সালে আচমকা মৃত্যু না এলে আরও কি কিছু বলতেন না তিনি? তিনি, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত? প্রৌঢ়তায় পৌঁছে তো মাঝেমধ্যে বিরতি গ্রহণ করেই বলা তাঁর স্বভাবে দাঁড়িয়েছিল। ‘যা ছিল বলার কবে হয়ে গেছে বলা সে’ – এই কবিতা পঙক্তি নিজেকে শোনানো এক ছদ্মবিবৃতি নয় কি?]
‘স্বাদ’ –এর পর ‘ভ্রম’, এবং ‘ভ্রম’ দ্বারা পরিচালিত হয়ে ইট পাতা– এ আমাদের ধারণার বাইরে। এ কবিতায় পরে আমরা পাব ‘এই স্বাদ কে বলো তো’? ‘দু -পলক স্বাদ’? ‘স্বাদে’র আগে ‘পলক’ এবং ‘স্বাদে’র পরে ‘ভ্রম’ শব্দের ব্যবহার আবার আমাদের শঙ্খ ঘোষের ওই কথাটিকে মনে করায়, পরস্পরের সঙ্গে মৃত বাঁধনে জড়িয়ে থাকে শব্দ, মনে করায় গাঁটগুলিকে আঘাত করা জরুরি। এই কাব্যগ্রন্থে অভিরূপ বারবার মৃত বাঁধনে জড়িয়ে থাকা শব্দের গাঁটগুলিকে আঘাত করে আনন্দের উত্থান ঘটিয়েছেন এবং এর ফলে নানান নতুন প্রয়োগ দেখা দিয়েছে তাঁর কবিতায়। এইসব নতুনত্বের দ্বারা, এমনকী, অভিরূপের অব্যবহিত পূর্ববর্তী কোনও কবিতা লেখকও উদ্দীপিত হয়ে উঠেছেন এমন প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি। ২০২০ সালে জানুয়ারিতে প্রকাশিত অভিরূপের ‘এই মন রঙের কৌতুক’ বইয়ে যে লেখা আছে ‘তার শ্রীমস্তকে ওড়ে ভ্রম’ সেই লাইনটিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০২৩-এ প্রকাশিত অন্য এক কাব্যগ্রন্থের নাম ‘মুকুরে যে ভ্রম ওড়ে’। অর্থাৎ নতুন অর্থে প্রজ্জ্বলিত করার যে সামর্থ্য অভিরূপের মধ্যে রয়েছে তা অন্য কোনও কবির মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে দেখে অভিরূপেরই কাব্যশক্তি অন্যভাবেও প্রমাণিত হয়। আগুন যখন জ্বলতে থাকে তখন যে বস্তুর ভেতর থেকে সে আগুন জ্বলছে সে বস্তুকে ছাড়িয়ে তার পাশাপাশি অবস্থিত বস্তুগুলিকেও প্রথমে তা আলোকিত করে। পরে আগুন সেই প্রতিবেশী বস্তুর মধ্যেও ছড়িয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে : ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে / সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে’। কবিতাও একরকম অগ্নি। ‘ভ্রম’ শব্দটিকে নিয়ে ‘এই মন রঙের কৌতুক’ গ্রন্থটি বিচিত্র প্রয়োগে মেতেছে :
পুড়ে যাওয়া সিংহের ভঙ্গিমা
শুয়ে রয়েছে লেখার খাতায়
এ-পুস্তক মাঠে রাখল ঝোলা।
জলে রাখল মন।
উড়ে যাওয়া হলুদ বদ্রিকা
কাছে ডাকল জলে ভেজা কাছে
পরের পৃষ্ঠায় চলো যাই
এই ভ্রমে আর কতক্ষণ!
এ কবিতার বিশদ আলোচনায় আমরা যাচ্ছি না। কারণ আমাদের এই মুহূর্তে লক্ষ্য শুধু ‘ভ্রম’ শব্দটি। এখানেও ‘ভ্রম’ শব্দটির একটি নতুন ব্যবহার ঘটল। কারণ পুরো কবিতাটি লেখার পর শেষ লাইনে এসে কবি নিজেই কবিতাটির উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে পুরো রচনাটি ‘ভ্রম’ বলে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। এবং যেতে চাইলেন পরের পৃষ্ঠায় তারই লেখা নতুন কোনও কবিতার কাছে। তাহলে এতক্ষণ পুরো কবিতাটি তিনি লিখলেন কেন? তবে কি আমরা ধরে নেব কবিতাটি রচনা সময়ে তাঁর কাছে যা প্রতিফলিত হচ্ছিল, কবিতাটির শেষ স্তবকে এসে পুরোটাই ‘ভ্রম’ বলে পরিগণিত হল তাঁর কাছে? যদি তাই হয় তাহলে বলতে হবে এই কবিতাটির মধ্যে একটি নাট্য সংঘটিত হল।
নাট্য কথাটি যখন এসেই পড়েছে তখন আমরা বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার ও কবি বের্টোল্ট ব্রেখটের প্রসঙ্গে আসতে পারি। ব্রেখট নাট্য পরিচালনার ক্ষেত্রে এমন একটি নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করে দিয়ে গেছেন যা আজও সারা পৃথিবীর দেশে দেশে প্রথম শ্রেণির নির্দেশকেরা মান্য করে চলেছেন। কলকাতার নাট্য মঞ্চেও এই পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যায়। একে বলে ‘ভি-এফেক্ট’। ‘ভি’ কথাটি বোঝাচ্ছে জার্মান ভাষায় ‘ভার ফ্রামডুঙ্গ’ শব্দটিকে। ইংরেজিতে অ্যালিয়েনেশন থিওরি বলে একে চিহ্নিত করা হয়। এই ‘ভি এফেক্ট’–এর প্রয়োগ কীভাবে বোঝা যায়? ব্রেখটের নাটকে, কোনও চরিত্র অভিনয় চলাকালীন আচমকা সেই চরিত্র থেকে এক মুহূর্ত বেরিয়ে এসে চকিতে নিজ চরিত্রের সমালোচনা করে আবার নিজের চরিত্রের মধ্যেই ঢুকে পড়ে। অভিরূপের পূর্বোক্ত কবিতাটির ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটল না? পুরো কবিতাটি লেখার পর শেষ স্তবকে এসে পূর্বে লিখিত লাইনগুলিকে অর্থাৎ পুরো কবিতাটিকেই ‘ভ্রম’ বলে নস্যাৎ করে পরের নতুন কবিতায় প্রবেশ করল : ‘পরের পৃষ্ঠায় চলো যাই’। কিন্তু পরের পৃষ্ঠায় কি সত্যিই ‘নতুন কবিতা’? তাহলে কবি পৃষ্ঠা কথাটি লিখবেন কেন? ‘নতুন লেখায় চলো যাই’ বলতে পারতেন তো, তা তো বললেন না?
এইখানে আমি একটা জিনিস ভুলে গেছি! এই গ্রন্থে কোনও কবিতাই নাম দ্বারা চিহ্নিত নয়, সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত। তার অর্থ কী দাঁড়ায়? বইরের সমস্ত কবিতাগুলি আসলে একটিই কাব্যকে ধারণ করছে। যেমন শঙ্খ ঘোষের ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ এবং ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ সংখ্যা চিহ্নিত। সব লেখা মিলিয়ে এই গ্রন্থ দু'টি যেন একটিই কাব্য সামনে আনছে পাঠকের। ‘এই মন রঙের কৌতুক’ বইটির মধ্যেও সে রকমই ঘটেছে। সবগুলি একত্র করে দেখতে হবে এখানে। সেই জন্যই বলা হয়েছে : ‘পরের পৃষ্ঠায় চলো যাই / এই ভ্রমে আর কতক্ষণ!'
কোন ‘ভ্রম’? ওই যে ‘পুড়ে যাওয়া সিংহের ভঙ্গিমা’ যাকে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে লেখার খাতায় ! অথবা ‘এ পুস্তক মাঠে রাখল ঝোলা’ আর ‘জলে রাখল মন’ - এইভাবে সব, সবই, পুরো কবিতাটিই যেন এক ‘ভ্রম’ নামক আশ্রয়ে বাস করা! শেষ স্তবক ত্যাগ করতে চাইল ‘ভ্রম’ নামক সেই আশ্রয়। নিজের কবিতাকে নিজেই শেষ লাইনে এনে ‘ভ্রম’ বলে ছেড়ে চলে যাওয়া এটাই ব্রেখটের ‘ভি-এফেক্ট’। মনে রাখতে হবে, অভিনয় চলাকালীন যে চরিত্র হঠাৎই চরিত্র থেকে নিজ চরিত্রের মধ্যে ফিরে যায় বা প্রবিষ্ঠ হয়, অভিনয় চলতে থাকে, এখানেও কাব্যগ্রন্থটি চলমান রইল : ‘পরের পৃষ্ঠায় চলো যাই’ - পরের পৃষ্ঠায় তো আমরা অন্য একটি সংখ্যা চিহ্নিত রচনায় উপনীত হই। গ্রন্থটি তো সমাপ্ত হয় না। সেইজন্যই ‘পরের পৃষ্ঠায় চলো যাই’ -এর প্রয়োগ।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবিতা সম্পর্কিত এক সংক্ষিপ্ত রচনায় একটি কথা বলেছিলেন যা এখানে প্রনিধানযোগ্য : "...বস্তুত যে কোনো লেখকের পদ্যই দীর্ঘকাব্য - তিনি লেখেন টুকরো টুকরো করে, এই মাত্র"। সকল কবির সমস্ত কবিতা বিষয়ে, সর্বাবস্থায়, নিশ্চয়ই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই উক্তি প্রযোজ্য নয়। কিন্তু শক্তির একটি অভ্যাস ছিল কবিতা সম্পর্কে ‘ভারডিক্ট’ দেওয়ার। তিনি কারোর পরোয়া করতেন না। তিনি একাই যে এমন ‘ভারডিক্ট’ দিতে অভ্যস্ত ছিলেন তা নয়। আরও অনেক কবিই এমন ‘ভারডিক্ট’ দিয়েছেন, একালেও অনেকেই দিয়ে থাকেন। সব ‘ভারডিক্ট’ই আংশিকভাবে সত্য। যেহেতু সব কবির মনই অবিকল একরকমভাবে কাজ করে না তাই আংশিকভাবে সত্য হওয়ায় বেশি পূর্ণ সত্যতা লাভ করা অসম্ভব এইসব ভারডিক্টগুলির। তবে অভিরূপের এই গ্রন্থটি বিষয়ে এটা বলা যায় যে সংখ্যা চিহ্নিত কবিতাগুলি একে অপরের সঙ্গে সূক্ষ্ম সংযোগে গ্রথিত হয়ে একটি পূর্ণকাব্য উপভোগ করার অভিজ্ঞতা আমাদের দেয়।
‘এই মন রঙের কৌতুক’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তিন বছর হয়ে গেল। কিন্তু বইটির বিশেষত্ব নিয়ে গভীর বিচার চোখে পড়েনি। তাই আমি নিজের সামর্থ্য অনুযারী একটু চেষ্টা করলাম মাত্র।
এই বইয়ের কবিতা আরম্ভ হওয়ার আগে প্রথমে ভূমিকারূপ কয়েকটা কথা বলা আছে একটি সাদা পৃষ্ঠার নীচের দিকে - যা উৎসর্গে দেওয়া চারলাইনের কবিতাটির ঠিক আগের পাতায় স্থাপিত! কথাগুলি এই রকম : ‘বইটির রচনাকাল ১৪২৫ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাস। এই কার্তিক মাস হল শ্রীহরি সেবার মাস। আমাদের দেশের বৈষ্ণব সমাজে একে দামোদর মাসও বলা হয়ে থাকে’। এই বইয়ের শেষ কবিতায় শেষ লাইনটিতে আমরা দেখি ‘দামোদর মাস’ শব্দটিকে ফিরে আসতে : ‘এমন পাখির শব্দে পার হল দামোদর মাস...’ অর্থাৎ একই সঙ্গে, একথা আমাদের মনে না হয়ে পারে না যে এই বইটিকে আমরা পার হয়ে এলাম। বৈষ্ণব ধর্মের নানা ছোঁয়া আমরা এই বইয়ে দেখতে পাই। একটি কবিতা শুরু হচ্ছে : ‘সেবা নাও। সেবা নাও। হরি’। ঠিক তার আগের কবিতাটিতেই পেয়েছি পূর্বে উল্লেখিত : ‘রঙ, রূপ, শ্রীহরি শ্রীহরি’। আমরা এই বইয়ে পাব এমন লাইন : ‘পাত্র ভরে তুলে দিক তুলসীর মঞ্জরি’। মেয়েদের ব্রত বিষয়ক ছড়ায় বলা এমন লাইন কে না জানে :‘ডালে কৃষ্ণ, পাতায় হরি/ সরে বসো কৃষ্ণ, তুলসী তুলি’। এই ‘হরি’ শব্দ আধুনিক বাংলা কবিতায় শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না। রজনীকান্তের এবং অতুলপ্রসাদের গানে ‘হরি’ শব্দ আছে। রবীন্দ্রনাথেরও আছে। কিন্তু তার পরবর্তী কাব্যধারায় কোথাও আছে কি? সম্ভবত নেই। এ বইয়ে পাই এমন স্তবক :
‘ঘরভর্তি জানলা চুরি হল
সে-চুরির কীর্তনাঙ্গ রূপ
নীল রঙে পাথর কুড়লো
নীল রঙে কুড়লো পাথর ...’
দেখা যাচ্ছে ‘কীর্তনাঙ্গ রূপ’ কথাটি আমরা পেলাম খানিকটা অভাবিত ভাবেই – যেমন ঘরভর্তি জানলা চুরি হওয়াও একটি অভাবিত ঘটনাই। কিন্তু কীর্তনাঙ্গ রূপ? বৈষ্ণব সমাজে কীর্তন সমধিক প্রচলিত। এ বইয়ের ১৪ সংখ্যক কবিতার প্রথম দু'টি লাইন এরকম :
‘সে আমার হরিতকী বনে
একমুঠো অহৈতুকী কৃপা ...’
দেখছি যে ‘অইৈতুকী কৃপা’ শব্দটিও এই বইয়ে এল। এগুলি সবই – ‘হরি’ শব্দের একাধিক কবিতায় ব্যবহার, ‘কীর্তনাঙ্গ রূপ’, ‘অইৈতুকী কৃপা’ – এই সকল প্রয়োগই বলে দেয় বইয়ের কবিতারও আগে কেন ‘দামোদর মাস’ শব্দটির বিশেষ উল্লেখ ছিল। যে শব্দ ফিরে আসবে বইটির শেষ শব্দ রূপে। এই বৈষ্ণব ভক্তি ধারণার প্রয়োগ অভিরূপের ঠিক পূর্ববর্তী প্রজন্মের এক কবিতা লেখকের রচনায় দেখা দিতে থাকছে এখন - অথচ ২০২০ সালের জানুযারিতে ‘এই মন রঙের কৌতুক’ কাব্যগ্রন্থ বেরোবার আগে উক্ত রচয়িতার লেখায় তার চিহ্ন দেখা যায়নি। এইভাবে পূর্বজ লেখকের রচনাকে নিজ রচনার বিষয়বস্তু দ্বারা আলোকিত করা অভিরূপের কাব্যশক্তির আরেকটি প্রমাণ আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি। প্রয়াত কবি গৌতম বসু, যিনি ঘটনাচক্রে আমার প্রতিবেশী ছিলেন, আমরা পাশাপাশি পাড়ায় থাকতাম – ‘এই মন রঙের কৌতুক’ বইটির বিষয়ে মুগ্ধতা জানিয়েছিলেন আমাকে, কেননা বছরে দু'তিনবার আমাদের দেখা হতোই। তিনিও লক্ষ্য করেছিলেন বৈষ্ণব ভক্তির ধারণাটিকে প্রেমের আনন্দ আশ্রিত কবিতায় কীভাবে পুনর্জন্ম দিয়েছেন অভিরূপ তাঁর ‘এই মন রঙের কৌতুক’ গ্রন্থে। অথচ সমস্তটাই ঘটছে এক স্নিগ্ধ অন্তরাল বজায় রেখে। গৌতম বসুর অকাল প্রয়াণে, অভিরূপের মতো নবীন তাঁর এক অভিভাবককে হারিয়ে যে শোকের মুখোমুখি হলো তা পূরণ করা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?
৪
শোক। এই শব্দটি এখনই বললাম তো? এখনই আমরা এসে পড়ছি অভিরূপের দ্বিতীয় কবিতার বইতে যা ২০২২-এ বেরিয়েছে। এ বইয়ের নাম ‘দিদিমবাড়ি’। এই বইয়ের বিষয় উৎস : শোক। আগের বইয়ের বিষয় উৎস কী ছিল? আনন্দ। আগের বইয়ের প্রায় সব কবিতাই রচিত হয়েছিল অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। পরের বইয়ে সব কবিতা রচিত হয়েছে স্বরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। বইয়ের কেন্দ্রীয় বিষয় বদলেছে। বদলে গেছে প্রকাশ করার আঙ্গিকও। অর্থাৎ ছন্দ। এ বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্ঠা এই রকম :
‘দাদা মাম পাপান
আর
আমাদের সেই ছোট্ট বেলার
হারিয়ে যাওয়া
দিদিমবাড়ি-কে’
এবং উৎসর্গ পৃষ্ঠার পরের পাতায় নীচের দিকে ছাপা আছে এই লাইনগুলি :
"মায়ের মাকে আমরা দিদিমা না বলে ডাকতাম দিদিম। তাঁর বাড়িকে বলতাম দিদিম বাড়ি। মৃত্যুর একবছর পর দিদিমের বাৎসরিক কাজ যখন প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছে, উপস্থিত সকলে যখন মাথা নীচু করে গ্রহণ করছেন শান্তির জল, তখনই অকস্মাৎ আমার মনে জেগে উঠতে থাকে এই কবিতার স্রোত! পরবর্তী কয়েকমাস ধরে আমি সেই স্রোতকে গ্রহণ করি, তৈরি হয়ে ওঠে এই বই"।
আমার ধারণা, যে কোনও বইয়ে, ভূমিকাস্বরূপ কয়েকটি কথা লেখকের কাছ থেকে পাঠকের জানা দরকার। তার ফলে বইটির মধ্যে প্রবেশের পথ সুগম হয়। এই বই শোকের মধ্য দিয়ে পথ চলেছে, ঠিকই, কিন্তু তার দু'ধারে ছড়িয়ে আছে স্নেহ। শোক-স্নেহের এমন অসামান্য যুগলবন্দি আমাদের মনকে ঢেউয়ের পর ঢেউ দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে চলে। এ বইয়ের প্রথম কবিতাটিই, আঙ্গিকের দিক দিয়ে এক নতুনত্বকে উপহার দেয় যা গত ৪০ বছরের বাংলা কবিতায় আমরা দেখিনি। কবিতাটি পুরোটাই তুলে দিচ্ছি পাঠকদের জন্য :
গঙ্গা লেখা কার্ড
রান্না ঘরের সামনে উঠোন
আরও সামনে দত্তবাড়ি
গ্রামের পেশেন্ট টি. কে ঘোষের
গলির মধ্যে স্বর্ণময়ী
পুকুর পাড়ে ঝুলবারান্দা
সন্ধে নামছে ছাদের বাগান
স্নেহের মাটি, স্নেহের মাটি
আগুন। জলে। শীতের হাওয়ায়,
আরতি সরকার
আকাশে আজ হাঁটতে বেরোলেন
পথ দেখাল পঞ্চমুখী জবা...
আজ থেকে আর অন্নপূর্ণা-থালা-বাটি আওয়াজ করবে না। ধুলোয় পুড়বে কাঁথার আসন। ‘বনা- মিঠু’ নামটি লেখা সেলাই করে। ফোন করে কেউ খোঁজ নেবে না আর কোনওদিন। বাড়ি ফিরলি কখন বাবান? বাপি আমার ওষুধ আনো! ও মিঠুমা, আয় একবার। ছোট্টু আমার ফোন ধরে না। প্রণব এখন শরীর কেমন? গুড্ডি কোথায়? মাম বুড়ি রে, পাপান আমার! কখন খাবি? পাটিসাপটা? ছানার পায়েস? তোমার সেসব ভাঁড়ার-ঘরের লক্ষ্মী দুয়ার বন্ধ এখন। চাঁদের গাঁয়ে ছোট্ট সিঁড়ি। ওপর-নীচে নামছে-উঠছে সারাবাড়ি উড়ছে একাই বনা-মিঠু-র শান্ত মা-ডাক ...
আমরা তোমার হবিষ্যি লিখছি।
আমাদের সেই আজীবনের লেখার খাতায় কলসি গড়ায়। কলসি ভাঙে। কলসি-ভর্তি ছাইয়ের ভেতর কী অনন্ত ছাইয়ের ভেতর ছোট্ট ছোট্ট পাখির জন্মে যে-যার মতো হাত-পা ছুঁড়ছে ...
ইতি আমার,
নীল শিশুকাল, দিদিমবাড়ি।
কোনও ব্যক্তির প্রয়াণ ঘটলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে পারলৌকিক কাজের আয়োজন করা হয় আমরা জানি। শ্রাদ্ধবাসরে উপস্থিত হওয়ার জন্য আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের বন্ধুবর্গের কাছে যে আমন্ত্রণপত্র বা ছাপানো কার্ড পাঠানো হয় তার উপরে ‘গঙ্গা’ কথাটি মুদ্রিত থাকে। অর্থাৎ প্রয়াত ব্যক্তির গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়েছে, এই ইঙ্গিত সেখানে রইল। এমন আমন্ত্রণপত্র আমরা অনেকেই দেখেছি। কিন্তু কোনও কবি সেই কার্ডের আঙ্গিককে এক পূর্ণ কবিতার রূপ দিয়ে ব্যবহার করলেন এমন দেখিনি। ‘দিদিমবাড়ি’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটিতে এই অভিনব প্রয়োগের সাহস দেখা যায় গ্রন্থকারের হাতে। অথচ এর মধ্যে কোথাও কোনও ‘স্টান্ট’ বা ‘গিমিক’ নেই। বইয়ের বিষয়ের সঙ্গে একবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গেছে এই কবিতার ফর্মের এই নতুনত্ব। পুরো কবিতটি স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা। লেখাটির মধ্যে, প্রথম কয়েকটি লাইন কবিতার আকারে সাজানো। তারপরেই একটি স্পেস। স্পেসের পর আমরা দেখি : ‘আরতি সরকার / আকাশে আজ হাঁটতে বেরোলেন’, যেন মৃত্যু কোনও ঘটনাই নয়! বয়স্করা যেমন বিকেলে একটু হাঁটতে বেরোন, তেমনই একজন হাঁটতে বেরোলেন আকাশে। কে বেরোলেন? ‘আরতি সরকার’। আমরা ভুলে যাচ্ছি না যে শ্রাদ্ধের জন্য পাঠানো আমন্ত্রণ পত্রে প্রয়াত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা থাকে। এই কবিতাও সেই রীতিকে মেনেই তার আঙ্গিকের মধ্যে ছন্দের ভেতর দিয়ে গ্রন্থকারের লোকান্তরিকতা মাতামহীর নামটি ব্যবহারে আনল। এরপর এই কবিতায় যে দ্বিতীয় স্পেসটি আসছে তারপরে আমরা পাব একটিই লাইন যার পরেও স্পেস দেওয়া হয়েছে। লাইনটি হলো : ‘আমরা তোমার হবিষ্যি লিখছি’।
‘হবিষ্যি’-র পর ‘লিখছি’ কথাটি অভূতপূর্ব প্রয়োগ! এখানে আবার পরস্পরের সঙ্গে মৃত বাঁধনে জড়িয়ে থাকা শব্দের সংযোগ বিন্দুর ওপর এসে পড়ছে আঘাত। কারণ এই কাব্যগ্রন্থ যে লেখা হচ্ছে তা তো একরকম হবিষ্যি করাই! এই কবিতার একেবারে শেষে আবার একটি স্পেসের ব্যবহার আছে। সেখানে লিখিত : ‘ইতি আমার, / নীল শিশুকাল, দিদিমবাড়ি’। আমাদের মনে পড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বই ‘পদাতিক’-এ এমন কবিতা ছিল যেখানে ‘ইতি বঙ্গচন্দ্র পাল, ঢাকা’ দিয়ে কবিতা শেষ হচ্ছে। সে কবিতা অক্ষরবৃত্তে লেখা, তীব্র শ্লেষাত্মক তার ভাষা, বিষয় রাজনৈতিক এবং নিয়মিত অন্ত্যমিলযুক্ত করে তা রচিত। সাত প্রজন্ম আগের এক কবির আঙ্গিককে সম্পূর্ণ নতুনভবে এখানে ব্যবহারে আনা হল কিন্তু কোথাও শ্লেষ রইল না, রইল শোক। কোথাও অন্ত্যমিল রইল না; প্রযুক্ত করা হল স্বরবৃত্ত মুক্তকের ব্যবহার। অর্থাৎ এই কবি সম্পূর্ণভাবে ঐতিহ্য সচেতন। প্রত্ন আধুনিকদের জেনেই তিনি কাব্য রচনার অঙ্গনে পদার্পণ করেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও কিন্তু, ‘গঙ্গা লেখা কার্ড’ এমন নামকরণ ভাবেননি। সে কবিতা শুরু হয়েছিল ‘সম্পাদক সমীপেষু’ সম্বোধন দিয়ে। ‘ভারতবর্ষে একচেটিয়া নেতা গান্ধী’– সে কথাও বলা হয়েছিল। পুরোপুরি তৎকালীন রাজনীতিকে বিষয় করে রচিত সে কবিতার আঙ্গিককে ব্যক্তিগত শোকপত্রের মাধ্যমে ও ছন্দ পরিবর্তনের দ্বারা অন্ত্যমিল মুক্ত করে এক জন্মান্তর দেওয়া হল। অভিরূপের কৃতিত্ব আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে দেয়।
এ বইয়ের দ্বিতীয় কবিতাটির নাম ‘মা’। কবিতাটি একবার দেখা থাক।
মা
আমার মায়ের মা-হারা মুখ কেমন?
শীতের রাতে মাঠের মধ্যে যেন
আগুন জ্বলছে।
খাটের ওপর
রাত্রি কোথায়? এখন তো ভোরবেলা!
তোমার মৃতদেহের পাশে তোমার দুই মেয়ে
উঁচু লম্বা ঘাসের মধ্যে তোমার দুই মেয়ে
দাঁড়িয়ে আছে
শ্মশান পথের ঢেলা!
মাতামহীর মৃত্যু মানে আমার মায়ের যিনি মা, তিনি চিরতরে চলে গেলেন। এ তো সহজ কথা! এ কথা কি পাঠকরা বোঝেন না? এ কথা বলে কি আমি পাঠকদের অসম্মান করছি? অবুঝ ভাবছি? না, তা নয়। আমি কেবল বলতে চাইছি : ‘আমার মায়ের মা-হারা মুখ কেমন’ - এই চিন্তাটির দিকে নজর করলে আমরা এক আশ্চর্য নতুন কবি দৃষ্টিকেই দেখতে পাই। ‘মায়ের মা-হারা মুখ’? কী আশ্চর্য, না! এবং কেবল মা-ই নয়। মায়ের বোনও দাঁড়িয়ে। কোথায়? ‘তোমার মৃতদেহের পাশে তোমার দুই মেয়ে’। এই লাইনের শেষে কোনও যতিচিহ্ন নেই। আছে আগে-পরে স্পেস দেওয়া একটি মাত্র লাইন যা স্যুরিয়ালিস্ট ছবিকে আমাদের সামনে এনে দাঁড় করায় : ‘উঁচু লম্বা ঘাসের মধ্যে তোমার দুই মেয়ে’– এ লাইনেরও শেষে কোনও যতিচিহ্ন নেই। একেবারে চলচ্চিত্রের মতো শ্মশান উবে গিয়ে, উঁচু লম্বা ঘাসের মধ্যে মা আর মাসিকে দেখা যাচ্ছে যেন ওয়াস পেন্টিংয়ের মতো কিছুটা কুয়াশাময়। এবং কবিতার শেষে তারাই রূপান্তরিত হচ্ছেন শ্মশান পথের দু'টি ঢেলায় বা পাথরে।
এই বইয়ে এরকম অজস্র কবিতা আছে। তার মধ্যে একটি কবিতা সম্পূর্ণ তুলে না দিয়ে পারছি না।
দিদিম নামের বাৎসরিক
বারো মাসের দানের কলসি মাটির
ছায়ায় ভরা ছোটোবেলার গ্রাম।
তখন তোমার রঙের বয়স?
দেখা হয়েছে দাদাসোনার সঙ্গে?
না না সে তো অনেক পরে। উঠোনে মা-বাবা
আমি ছিলাম সবার ছোটোবোন।
জংলাঘাটে খেলার সঙ্গী সেই কবেকার শ্যাওলা ধরা পুকুর
তোমার জন্য বারো মাসের জল পাঠাল আজ ...
প্রেতের যেন কী নাম?
গোত্র কী যেন?
বলুন : শান্তি ... শান্তি ...
পুরোহিতের পাশেই রাখা খাট-বিছানা-বালিশ
তার ওপরে ঢেউয়ের মতো এই জীবনের রোদ্দুর -
নিজের চোখেই দেখছে নিজের পারলৌকিক কাজ!
এই কবিতাটির মধ্যে একটি সংলাপ চলছে মাতামহীর সঙ্গে দৌহিত্রের। সংলাপটি মাঝখানে আসছে, আবার উধাও হয়ে যাচ্ছে। কবিতা শুরু হচ্ছে শ্রাদ্ধবাসরের বর্ণনায়, মাঝখানে সংলাপটির আসা-যাওয়া চলল, এল পুরোহিত বচন, আবার দেখা দিল শ্রাদ্ধবাসরের ছবি– এরপরে এল একটি স্পেস। স্পেসের পর আমরা দেখতে পাই প্রয়াত অস্তিত্ব অদৃশ্যে দাঁড়িয়ে আছে; ‘নিজের চোখেই দেখছে নিজের পারলৌকিক কাজ’! মৃত্যুর পরে যে কোনও কিছুর অস্তিত্ব থাকে না সে বিশ্বাসে নির্ভর নেই আমাদের এই তরুণ কবির। তার কাছে মানুষের অস্তিত্ব জীবন-মৃত্যু মিলিয়ে এক অনন্তের দিকে কোনও অভিযাত্রায় চলমান। সেইজন্য, জেনে শুনে একটু আগেই ‘লোকান্তরিতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম অর্থাৎ জীবন লোক ছাড়াও জীবন শেষ হওয়ার পরে অন্য কোনও পরলোক আছে কোথাও। তর্ক উঠবে অন্ধবিশ্বাস নিয়ে। কিন্তু তর্ক ছেড়ে কবিতা চলতে থাকবে সীমাহারা সমুদ্রের অন্য পাড়ে অবস্থিত সেই পরলোকের কল্পনার দিকে। কবিতা চিরসময়ের মধ্যে বিস্তার পাবে।
এই কবিতাও পুরোটাই স্বরবৃত্তে লেখা। এখানে এমন লাইনও পাই : ‘কাঠের ভিতর পুড়ছে তোমার স্নেহ রঙের হাত’। কোন কবিতায় পাব?
শাকের শতনাম
কতরকম শাকের নাম তোমার মুখে শোনা
গিমের শাক। পাটের শাক। বেতের শাক। আরও ...
নিজের হাতে রেঁধে সেসব থালায় বেড়ে দিতে
দুপুরবেলা, সঙ্গে সাদা ভাত
কী ভালো সেই খাওয়া!
এখন
আকাশ অব্দি আগুন ...
কাঠের ভেতর পুড়ছে তোমার স্নেহ – রঙের হাত!
ওই কাঠে কি সে-হাত এখন রান্না করে?
গিমের শাক। পাটের শাক। বেতের শাক। আরও ...!
বসুধা তোর সবরকম শাকের নাম আজ
চিতায় জ্বলা হাওয়া ...
একটু আগে যে বলছিলাম স্নেহ-শোকের যৌথ পথভ্রমণের কথা। এ কবিতায় তার স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত। যে সব শাক একসময় রেঁধে দিতেন মাতামহী সেইসব নাকি আজ ‘চিতায় জ্বলা হাওয়া’! কাকে বলা হচ্ছে? তার আগে জানা দরকার শাক কোথায় জন্মায়? ক্ষেতে-মাঠে। ভূমিতে। অর্থাৎ বসুধায়! কবিতার শেষ বাক্যের সম্বোধনটি পৌঁছল বসুধার কাছে। এই বসুধায় আমরা জন্ম নিই, এই বসুধা থেকেই আবার চলে যাই, যেমন গেছেন দিদিম। তাই ‘বসুধা’ শব্দটি অমোঘ।
এই কবিতার বই প্রায় পুরোটাই স্বরবৃত্তে লেখা। ‘প্রায়’ বললাম কেন? কারণ দু'টি কবিতা পাওয়া যায় যা মাত্রাবৃত্তের ৭ মাত্রায় এবং ৬ মাত্রায় রচিত। ৭ মাত্রার কবিতাটিতে একটি বিশেষত্ব আছে। সে কবিতা শুরু হচ্ছে এইভাবে :
উঠেছ? ওঠো মন ডাকছে নিমফুল
আড়াল দেখে এল উধাও জানালাটি
এইভাবে চলতে চলতে কবিতাটি হঠাৎ এক জায়গায় বলে :
‘লিখেছি মেঘে মেঘে প্রথম পুস্তক’!
তারপরেই এসে পড়ে একটি স্পেস। স্পেসের পরে একটিই লাইন। তারপরে আবার স্পেস। তারপরে ২ লাইনে কবিতা সম্পূর্ণ হয়। সেই লাইনটি কী যার আগে পরে স্পেস?
সে-ই তো : ‘এই মন রঙের কৌতুক’
এখানে আবার ব্রেখট উদ্ভাবিত নাট্য নির্দেশনার অ্যালিয়েনেশন থিওরির প্রয়োগ ঘটল। কীভাবে? আগের বইটি তো সম্পূর্ণই অক্ষরবৃত্তে লেখা – যা এই লেখকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কবিতা নিজেই সে কথা স্বীকার করছে : ‘লিখেছি মেঘে মেঘে প্রথম পুস্তক’! তারপরেই আসছে স্পেসকে আগে-পরে রেখে সেই একলা লাইনটি : ‘সে-ই তো : ‘এই মন রঙের কৌতুক’ অর্থাৎ আগের বইয়ের সঙ্গে ডায়লগে অবতীর্ণ হল এই দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রথম বইয়ের নাম ছিল ‘এই মন রঙের কৌতুক’ তা ছিল অক্ষরবৃত্তের ১০ মাত্রায় রচিত, সে তো আমরা দেখেছি। এই কাব্যগ্রন্থে একবার বলা হলো ‘লিখেছি মেঘে মেঘে প্রথম পুস্তক’ অর্থাৎ লেখকই লেখার বাইরে চলে এসে বললেন আমিই এই বই লিখেছি যা আমার প্রথম পুস্তক! অবাক কাণ্ড, না? কী সেই পুস্তক? সে-ই তো : ‘এই মন রঙের কৌতুক’। ‘সে’ এবং ‘ই’ এর মাঝখানে হাইফেন আমাদের লক্ষ্য করতেই হয়। সেইসঙ্গে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় ‘কোলন’ যতিচিহ্নটিও। এবং আমরা অভিভূত হয়ে দেখি যে, অক্ষরবৃত্তের ১০ মাত্রায় গাঁথা ‘এই মন রঙের কৌতুক’ কীভাবে মাত্রাবৃত্তের ৭ মাত্রায় প্রযুক্ত হতে পারল এই নবীনের অসামান্য ছন্দবোধ দ্বারা।
এই বইটি নিয়ে বিশদ কিছু বলব না। কারণ এই বই প্রকাশের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রথম মুদ্রণ ফুরিয়ে দ্বিতীয় মুদ্রণে পৌঁছেছে। আপামর পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছে এই ‘দিদিমবাড়ি’ কাব্যগ্রন্থ। আমরা বরং চলে যাই ‘দিদিমবাড়ি’র পরে রচিত এ বছর ২০২২ সালের পুজো সংখ্যা ‘এই সময়’ পত্রিকায় প্রকাশিত অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের নতুন একটি কবিতার দিকে। এখানে আবার দেখা যাচ্ছে কীভাবে বাঁক নিয়েছেন এই তরুণ কবি।
মন্দিরের এক সেবাইতের জবানি
শিশুপাঠ্য যখন এই সহজ পাঠ শরীর
মায়ের মতো দিদির মতো তখন থেকে বই
গ্রামের লোক হেসে বলত : তুই ছেলে না মেয়ে?
আদি অন্ত অভিধানের আমি অর্থ নইতবু পাঠক এসে বসল ঘাটের ধারে-ধারে
কত শ্রোতাই নৌকা এনে ভাসিয়ে দিল ছই
পুস্তকের শেষে পৌঁছে বলে উঠল তারা :
নারীগর্ভ কোথায় তোর? নারীগর্ভ কই?কোথাও নেই এখন হরিমঠের সেবাদার
রাধাকুঞ্জ তিলকমাটি নবদ্বীপ ধাম
বুড়ো মানুষ, শ্রীকৃষ্ণের দালান ধুয়ে ভাবি,
জগৎ পাঠ করত যদি ভাগবৎ হতাম!
কবিতাটি নানা দিক দিয়ে আমাদের আকর্ষণ করে। প্রথমত এ কবিতার মধ্যে কাজ করছে এক চরিত্রের স্বর যে নিজেকে ‘আমি’ বলে। এক্ষেত্রে আমাদের মনে পড়ে টি. এস. এলিয়েটের ‘থ্রি ভয়েসেস অব পোয়েট্রি’ প্রবন্ধটির কথা। কবি কখনও কখনও কথা বলেন তার সৃষ্ট নাট্য চরিত্রের স্বর নিয়ে, এখানে তেমনই হয়েছে।
এমন অনেক পুরুষের কথা আমরা জানি যারা শরীরে পুরুষ কিন্তু অন্তরে নারী, জন্ম থেকেই। তাদের ‘মেয়েলি’ বলে সমাজ বিদ্রূপ করে। এই নিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ অভিনীত ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ ছবিটির কথা আমরা ভুলতে পারি না। অথবা ঋতুপর্ণ পরিচালিত ‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবিটিও আমাদের ধ্যানে রাখতে হয়। কবিতার প্রথম লাইন বলছে : ‘শিশুপাঠ্য যখন এই সহজ পাঠ শরীর’। ‘সহজ পাঠ’ বইটি তো শিশুদের পড়ার উপযোগী হিসেবেই লেখা। কিন্তু ‘সহজ পাঠ’ যখন ‘শরীর’ হয়ে গেল অমনি এসে দেখা দিল এই লাইন : ‘মায়ের মতো দিদির মতো তখন থেকে বই।’ এই নবীন কবি আবার একটি অভাবিতকে প্রয়োগ করলেন। ‘বই’ আর বই রইল না হয়ে গেল ‘শরীর’। এবং তাকে একথা জিজ্ঞাসা করা হতে লাগল ‘তুই ছেলে না মেয়ে’? দ্বিতীয় স্তবকের শেষে আমরা দেখি সেই মর্মঘাতী প্রশ্ন যা সমাজের মুখ থেকে উঠে আসছে, ‘নারীগর্ভ কোথায় তোর? নারীগর্ভ কই?’
এই প্রশ্ন কবিতার মধ্যে যে নাট্যস্বর ব্যবহার করা হচ্ছে তার কাছে পৌঁছয় এক হাহাকারের মতো! সত্যিই তো তার নারীগর্ভ নেই। সে তো সন্তান ধারণ করতে পারবে না। সেই শূন্যতাকে বোঝানোর জন্য একটি স্পেস এসে যায় কবিতায়।
স্পেসের পর আমরা কবিতাটির পরিণতির দিকে এগোই। সেই মেয়েলি বালকটি এখন ‘বুড়ো মানুষ’ এখন ‘হরিমঠের সেবাদার’। সে এখন দু'বেলা মন্দিরের দালান ধোয়, শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের দালান আর ভাবে : ‘জগৎ পাঠ করত যদি ভাগবৎ হতাম’।
এই নবীনের অপ্রতিরোধ্য কবিত্ব শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই এই শেষ লাইনটিতে পৌঁছে! ‘সহজ পাঠ’ ও একটি বই যা শিশুপাঠ্য, ‘ভাগবৎ’ও একটি গ্রন্থ কিন্তু তা শিশুপাঠ্য নয়। প্রবীণ মানুষরাই ভাগবৎ পাঠ করেন, পুরোহিতরা, কথকঠাকুরেরা। আর সেই ভাগবৎ পাঠ অনেক মানুষ শোনেন। মন্দিরের এই সেবাইতের কথা শোনবার কেউ নেই, এক এই কবি ছাড়া। এই কবি বয়সে তরুণ হলেও তিনি জানিয়ে দেন সেই সেবাইতের চরম আশা কী ছিল? ‘যদি ভাগবৎ হতাম’।
‘সহজ পাঠ’ থেকে ‘ভাগবৎ’-এ পৌঁছল একটি শরীর। তার শরীর যদি ভাগবৎ হতো তো জগৎপাঠ করত তাকে- এই তার একান্ত বাসনা, অনুচ্চ হাহাকার। একটি শরীর ভাগবৎ হয়ে উঠতে চায় এমন কথা কি আমরা কোনও কবিতায় পড়েছি? অন্তত আমার তো জানা নেই!
অবশ্য আমার পড়ার পরিধি তো সামান্যই! আমার লেখায় এই কবিকে কোথাও ভুল বোঝা রয়ে যেতে পারে। পাঠককে, সেক্ষেত্রে, আমি আমার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করার অনুরোধ করতে পরি।
পুনশ্চ : এই গদ্যের প্রথমে লিখেছিলাম যে কোনও কবিকে যদি প্রতিদিন দেখার, তাঁর সঙ্গে মেশবার প্রাত্যহিক সুযোগের মধ্য দিয়ে আমরা যাই, তাহলে এমন ধারণা আমাদের হতে পারে যে এই কবির কবিতা বুঝতে আমার কোনও পরিশ্রম না করলেও চলে! কারণ এই মানুষটি তো সহজ! ঠিক, বাইরের সহজ সৌজন্যময় ব্যবহার দেখেই কি আমরা বুঝতে পারি যে সেই কবির অবচেতনের মধ্যে কী কী ঘটছে? মনে রাখতে হবে প্রত্যেক দিনের যে ২৪ ঘণ্টা সময় আমরা অতিবাহিত করি তার মধ্য থেকেই উঠে আসে আমাদের কবিতা রচনার প্রবাহ। এবং এও মনে রাখতে হবে এই ২৪ ঘণ্টা সময় পরিধির ভেতরেই, প্রত্যেক রাত্রে নিদ্রার ভিতর আমরা অবচেতনের মুখোমুখি হই। কীভাবে? কারণ ঘুমের সময় আমরা স্বপ্ন দেখি যে! ৬/৭ ঘণ্টা ঘুম মানুষের দরকার হয়। নিজের অজান্তেই নিজের অবচেতনের অভিজ্ঞতার স্পর্শ লাভ করে। স্বপ্নের কোনও প্রথম দৃশ্য থাকে না। কোনও শেষ দৃশ্য থাকে না। খুব জোরালো স্বপ্ন হলে দু' একটি ভাসমান ছবি মাত্র মনে থেকে যায় ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরেও। এক্ষুণি বলেছি, ২৪ ঘণ্টা সময় পরিধি যা আমরা প্রতিদিন অতিবাহিত করি তার মধ্য থেকেই আসে কবিতার স্রোত। উক্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তো ধরা থেকে যায় ৬/৭ ঘণ্টার ঘুমের সময়টুকুও; সেইসূত্রে স্বপ্ন দেখার সময়টুকুও। যায় না কি? অতএব অবচেতনের এবং অবচেতনের অভিজ্ঞতাও কবিতার মধ্যে এসে পড়ে। অনেক কবি অবশ্য, পাঠকের কাছে কঠিন লাগবে বলে, অবচেতনকে কবিতার মধ্যে ঢুকতেই দেন না। সে হলো কবিতা লেখার আরেক রকম পথ। সে হলো আরেক ধরনের কবির গন্তব্য যেখানে পাঠকই মুখ্য, তিনি নিজে নন।
কিন্তু প্রত্যেক মানুষকেই যেহেতু তার অবচেতনের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জড়িত হয়ে পড়ে থাকতে হয় ঘুমের সময় বাধ্যতামূলক ভাবেই, তাই কবির অবচেতন যে কীভাবে কাজ করছে তার নিজের কবিতার মধ্যে তা কবি নিজেই অনেকসময় বুঝতে পারেন না। সে সব ক্ষেত্রে, তৎক্ষণাৎ লিখিত কবিতা হয়ে ওঠে তাঁর নিজেরই কাছে একটি আবিষ্কার।
অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাও, পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, যেন তাঁর নিজের কাছে নিজের এক একটি আবিষ্কারই।