বিজেপি তৃণমূলের দুর্নীতি ধরতে পারছে না, নাকি ধরতে চাইছে না?

Abhishek Banerjee Delhi : বিজেপিও মানুষকে বোঝাতে পারল না যে ১০০ দিনের কাজ হোক বা আবাস যোজনার টাকা — এগুলি নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে।

তৃণমূলের যুবরাজ রাজ্য থেকে তৃণমূলের কর্মী সমর্থকদের দিল্লি নিয়ে যাচ্ছেন। ইস্যু কী? দিল্লির বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের প্রাপ্য আর্থিক পাওনা আটকে রেখেছে। ১০০ দিনের কাজের টাকা বা আবাস যোজনার টাকা কেন্দ্রের সরকার দিচ্ছে না। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আটকে রেখেছে কেন্দ্র। কাজেই রাজ্যের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। গ্রামের যেসব খেটে খাওয়া মানুষ ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ করল, তারা তাদের মেহনতের টাকা পাচ্ছে না! সুতরাং 'দিল্লি চলো'। দিল্লির রাজপথে আন্দোলনকে নিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের এবং জাতীয় মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করো।

এই আন্দোলনে প্রাপ্য টাকা সত্যি আদায় করা যাবে কিনা বা এই আন্দোলনের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার মাথা নোয়াবে কিনা অথবা কৃষকদের আন্দোলনের মতো এই আন্দোলনেরও জোর আছে কিনা, তা অন্য কথা। কিন্তু এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার ইস্যুতে রাজ্যের মানুষের সহানুভূতি কুড়ানো যাবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেই বামফ্রন্ট আমল থেকেই রাজ্যের মানুষ কেন্দ্রীয়-বঞ্চনার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। তৃণমূল সরকারও জানে এই ইস্যু রাজ্যের মানুষ বেশ ভালো খায়।

এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও দু'টি বিষয়। এই আন্দোলনে সামিল হতে তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন দিল্লিতে থাকবেন বলে ঠিক রয়েছে, তখনই এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দুর্নীতির তদন্তের মামলায় ডেকে পাঠিয়েছে। অন্য বিষয়টি হলো, তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের দিল্লি নিয়ে যাওয়ার জন্য দল যে ট্রেন ভাড়া করতে চেয়েছিল, তার আবেদন রেল মন্ত্রক খারিজ করে দিয়েছে। ট্রেন না পেয়ে বাসে করেই সমর্থকদের দিল্লি নিয়ে যাওয়া হবে বলে ঠিক করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। ফলে 'বঞ্চনা' বা 'নিপীড়নের' ইস্যু নতুন মাত্রা পেয়েছে।

আরও পড়ুন- অভিষেকের সম্পত্তির পরিমাণ ঠিক কত

এটি আর কারও অজানা নয় যে, সিবিআই বা ইডির মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক বসদের কথাতেই ওঠা বসা করে। এটা ঠিক যে, এবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহার ধমক খেয়েই ইডি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তড়িঘড়ি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু বিচারপতি এটি বলে দেননি, যেদিন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দিল্লিতে থাকতে পারেন, সেদিনই তাঁকে ডাকতে হবে। কিন্তু আগের কয়েকবারের মতো ইডি কর্তারা ঠিক এই কাজটিই করেছেন। এর আগে ইন্ডিয়া জোটের সমন্বয় কমিটির বৈঠকের দিন ইডি অভিষেককে তলব করেছিল। তারও আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় নবজোয়ার যাত্রা চলাকালীন তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদককে ডেকে পাঠিয়েছিল ইডি।

এই সব জিজ্ঞসাবাদের নিট ফল যে শূন্য তা দাবি করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলেছেন অভিষেকই। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন, এই জিজ্ঞাসাবাদ শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকেই করা হচ্ছে। কারণ, না তো আদালতে কোনও তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পেরেছে ইডি, না গ্রেফতারের মতো কোনও পদক্ষেপ করতে পেরেছেন তদন্তকারীরা।

রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে এনে যেরকমই আত্মসুখ লাভ করুন না কেন ইডি কর্তারা বা তাঁদের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা, তাতে না তো বিজেপির রাজনৈতিক কোনও লাভ হচ্ছে, না লাভ হচ্ছে জনগণের। কারণ ১০০ দিনের বা আবাস যোজনার প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ হোক বা শিক্ষা ও অন্যান্য দুর্নীতিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগ — সব বিষয় নিয়ে রাজ্যের বিজেপি নেতারা নিজেদের আঙুল চুষছেন।

তবে কি পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি শেষ হয়ে গেল? শুধুমাত্র আদালতের প্রশ্ন ও নির্দেশই কি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখবে? গত ১২ বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার বিরোধীদের কম ইস্যু উপহার দেয়নি। সারদা চিট ফান্ড দুর্নীতি থেকে শুরু করে হালের শিক্ষক নিয়োগে কারচুপি— পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দুর্নীতির ঘনঘটা। তবুও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন ছাড়া তৃণমূলকে বেগ পেতে হয়নি কখনও।

আরও পড়ুন- মমতা-বর্জিত একনায়কতন্ত্রের চেষ্টা আদৌ সফল হবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের?

বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের দুর্বল ও ছন্নছাড়া সংগঠন যদিও তৃণমূলকে ওয়াকওভার দিয়েছে, কিন্তু ২০১৮-১৯ সালে বিজেপির উপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছিল রাজ্যের জনগণের একাংশ। এমনকী ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে সরকারে না আনলেও, নিরঙ্কুশ ভাবে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা বিজেপিকে দিয়েছে এ রাজ্যের নির্বাচকেরা। কিন্তু তারপর?

তারপর খোলা মাঠেই গোল দিয়ে চলেছে তৃণমূল!

এই যে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার দাবি তুলে তৃণমূল কয়েক হাজার কর্মী সমর্থকদের দিল্লি নিয়ে যাচ্ছে, তা তো বিজেপির নেতাদের অজানা ছিল না। সেই জুলাই মাসেই এই আন্দোলনের ঘোষণা করেছিলেন অভিষেক। কিন্তু এই দাবির পাল্টা কোনও তথ্য বা যুক্তি বিজেপি নেতাদের হাতে ছিল না?

এই 'বঞ্চনার' দাবি কি সত্যিই যুক্তি সঙ্গত? কেন্দ্রীয় সরকার ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে পশ্চিমবঙ্গের সরকারকে ১০০ দিনের কাজের টাকা দিচ্ছে না এটি সত্যি। তার ফলে যাঁরা ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কাজ করেছিলেন, তাঁদের প্রাপ্য টাকা আটকে রয়েছে। অন্য দিকে নতুন করে ১০০ দিনের কাজও শুরু করা যাচ্ছে না। নতুন পঞ্চায়েত বোর্ড নির্বাচিত হয়ে গেছে। যেহেতু পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প রূপায়িত হয়, ফলে তারা এবার উঠে পড়ে লাগবেই। কিন্তু কেন টাকা আটকে রাখা হয়েছে?

কারণ ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প নিয়ে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। ভুয়ো জব কার্ড বানানো থেকে প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের অভিযোগের ভিত্তিতেই কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক এই প্রকল্পের টাকা আটকে রেখেছে। তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রের অফিসারেরা এসে সরেজমিনে তদন্তও করে গেছেন। মহাত্মা গান্ধী রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি আইনের ২৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী অনুদান বন্ধ করার নির্দেশ কেন্দ্রীয় সরকার দিতেই পারে। কিন্তু সেই ধারাতেই রয়েছে, একটি পরিমিত সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পটি যাতে আবার ঠিক মতো চলে তার জন্য ব্যবস্থা নেবে।

এত দিনেও সেই তদন্তের ফলাফল জানা গেল না। প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হল না। কেন্দ্রীয় সরকার এটা প্রমাণই করতে পারল না যে ১০০ দিনের টাকা নিয়ে সত্যিই দুর্নীতি হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বিজেপিও মানুষকে বোঝাতে পারল না যে ১০০ দিনের কাজ হোক বা আবাস যোজনার টাকা — এগুলি নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে।

বরং উল্টে ইডিকে দিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তলব করিয়ে বা ট্রেন না দিয়ে তৃণমূলকে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিল বিজেপি।

More Articles