০.৮৫% ভোটের হেরফের! হরিয়ানাতে বিজেপির হ্যাটট্রিক কেন ঠেকাতে পারল না কংগ্রেস?
Haryana Election Result 2024: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কংগ্রেস জাঠ ভোটারদের উপর খুব বেশি নির্ভর করেছিল। এই রাজ্যের ভোটারদের প্রায় ২৭% জাঠ।
বিশ্বাস ছিল জয় হবেই। ভুল বলা হলো। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ছিল যে, বিজেপির দশ বছরের শাসনকে হেলায় হারিয়ে হরিয়ানার ক্ষমতা দখল করবে কংগ্রেস! মঙ্গলবার সেই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বিশাল ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়ে গেল কংগ্রেসের। বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনে জিতে হ্যাটট্রিক করে ক্ষমতায় এল হরিয়ানাতে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জেতা ম্যাচ হেরে এল কংগ্রেস। ভোটের পরিসংখ্যানও তাই বলছে!
হরিয়ানাতে মোট ৯০ টি বিধানসভা আসন। কংগ্রেস জিতেছে ৩৭টি। অন্যদিকে বিজেপি ৯০টির মধ্যে জিতেছে ৪৮টি আসন। কংগ্রেসের এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর বিশ্বাসভঙ্গ, দুইয়ের নেপথ্যেই আছে লোকসভা নির্বাচন। লোকসভা ভোটে হরিয়ানায় দলের পারফরম্যান্সে খুশি ছিল কংগ্রেস। ১০টি লোকসভা আসনের মধ্যে কংগ্রেস জিতেছিল ৫টি, বিজেপিও পাঁচটি। তখন থেকেই কংগ্রেসের বিশ্বাস ছিল রাজ্যার ক্ষমতা দখলের লড়াই কঠিন হবে না। লড়াই হলো প্রবল। ১১ টি আসন বেশি জিতল বিজেপি। কংগ্রেস বুঝতে পারছে, জেতা বাজি হেরে যাওয়ার মাশুল গুনতে হবে তাদের। উত্তর দিতে হবে বহু প্রশ্নের।
বিরোধী নেতা ভূপিন্দর সিং হুডার উপর নির্ভর করা কি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল? মুখ্যমন্ত্রীর পদের জন্য হুডা এবং দলীয় সাংসদ কুমারী সেলজার মধ্যে লড়াই নিয়ে কী বলবে দল? প্রার্থী বাছাইয়ে কী কী ঘাটতি রয়ে গেল? হুডা বিরোধী শিবিরের লোকজন বলছেন, প্রার্থীর টিকিটের সিংহভাগ নিজের হাতে রেখেছিলেন তিনি। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং আত্মতুষ্টিতে ভুগেই কি কংগ্রেসের এমন দুর্দশা? এর দায় কি রাহুল গান্ধি নেবেন?
আরও পড়ুন- কাশ্মীরে ফুটল না পদ্ম, শেষমেশ ‘ইন্ডিয়া’ জোটকেই বেছে নিল উপত্যকার রায়?
বিজেপি এমন একটি রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রেখেছে যেখানে সেই দল সবচেয়ে বেশি বিরোধিরতার মুখে পড়েছিল কৃষকদের এবং কুস্তিগীরদের। কৃষিবিল নিয়ে চাষিদের আন্দোলন এবং যৌন হেনস্থার প্রতিবাদে কুস্তিগীরদের লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিলেন হরিয়ানার মানুষরাই। তারপরেও কংগ্রেস কেন জিতল না হরিয়ানাতে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কংগ্রেস জাঠ ভোটারদের উপর খুব বেশি নির্ভর করেছিল। এই রাজ্যের ভোটারদের প্রায় ২৭% জাঠ। জাঠ অধ্যুষিত আসনগুলির মধ্যে, কাইথাল, বরোদা, জুলানা, তোহানা, এলেনাবাদ, নারনাউন্দ, মেহম, গাঢ়হি সাম্পলা-কিলোই, বদলি এবং ঝাজ্জরে কংগ্রেস এগিয়ে থেকেছে ঠিকই তবে পানিপথ গ্রামীণ, সোনিপত, গোহানা এবং বাধরার মতো আরও কয়েকটি আসনের ভোট গিয়েছে বিজেপির পক্ষেই। মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক অবশ্য কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে। কংগ্রেসেরর ফিরোজপুর ঝিরকার প্রার্থী মাম্মান খান, ৯৮,৪৪১ ভোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হয়েছেন। নূহ এবং পুনাহানার মতো দু'টি মুসলিম-অধ্যুষিত আসনও কংগ্রেস জিতেছে।
তবে কংগ্রেসের এই হারের নেপথ্যে একটি মূল কারণ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। বিশেষত দলিত নেতা সেলজা এবং জাঠ নেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হুডার মধ্যেকার লড়াই দলের ক্ষতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কংগ্রেস কেন হুডার বাছাই করা প্রার্থীদের গুরুত্ব দিচ্ছে এই নিয়ে দলের উপর বিরক্ত ছিলেন সেলজা। প্রচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজেকে সরিয়েই রেখেছিলেন তিনি। সেলজা বারবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দাবি করেছেন। অন্যদিকে কংগ্রেস হুডাকে সরিয়ে দিয়ে বিপদ ডাকতেও নারাজ! এই অন্তর্দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়েছিল বিজেপি। তারা কংগ্রেসকে দলিত বিরোধী বলে অভিযুক্ত করে। প্রচার করতে থাকে তাঁদের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ নয়াব সিং সাইনি অথচ কংগ্রেসের তো মুখ্যমন্ত্রীর মুখ কে তাই স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে সাইনি ওবিসি সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ায়, বিজেপি তার পক্ষে অ-জাঠ ভোটব্যাঙ্ককে একত্রিত করতে পেরেছে।
কংগ্রেসের নেতাদেরই অনেকে বলছেন, হরিয়ানার এই নির্বাচন জাঠ বনাম অ-জাঠ ভোটের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু দল তাতে গুরুত্ব দেয়নি। হুডা নিজের ৭২ জন সমর্থকের জন্য টিকিট নিশ্চিত করেছিলেন। সবাই ভেবেই নিয়েছিল তিনিই মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন। অথচ কংগ্রেসের উচিত ছিল এই ধারণা তৈরি করা যে, এই নির্বাচন উন্মুক্ত! এই প্রতিযোগিতা স্বচ্ছ এবং সেলজা সহ যে কেউ মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন।
সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফলাফলের পরে কংগ্রেস নেতারা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিলেন। লোকসভা নির্বাচনে ১৫% ভোটের ভাগ বৃদ্ধিতে উজ্জীবিত কংগ্রেস কৃষকদের প্রতিবাদ, কুস্তিগীরদের বিক্ষোভ, অগ্নিপথ প্রকল্পের উপরই সমস্ত প্রচারের আলো এনে ফেলেছিল। কিন্তু শুধু এই ইস্যুগুলি দিয়ে ভোটে জেতা যায়নি, যায় না! উল্টে হরিয়ানা কংগ্রেস এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে যে অনেক আসনে বিদ্রোহী নেতাদের শান্ত করার কোনও প্রচেষ্টাও করা হয়নি দলের তরফে। সোনিপত, মহেন্দ্রগড় এবং সমলখায় কংগ্রেস প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সোনিপতের প্রার্থী সুরেন্দর পানওয়ার জেল থেকে ভোটে লড়েছেন। কংগ্রেস 'ইমেজ' বাঁচানোর চেষ্টা অবধি করেনি।
আরও পড়ুন- বিপুল ভোটে দুর্দান্ত জয়, হরিয়ানায় কংগ্রেসের মুখ রাখলেন কুস্তিগির বিনেশই
হরিয়ানা কংগ্রেসের নেতাদের অনেকেই বলছেন, অন্তত তিনটি আসনে যেখানে কংগ্রেস হেরেছে, সেখানে বিদ্রোহীরা হুডারই অনুগত ছিল। বল্লভগড়ে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন হুডার অনুগত। কংগ্রেস প্রার্থী পরাগ শর্মা ৮,০০০-এর বেশি ভোট পেয়েছিলেন আর বিদ্রোহী শারদা রাঠোর ৪৪,০০০ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে এসেছেন। তিগাঁওতে, কংগ্রেস প্রার্থী রোহিত নগরকে কংগ্রেসের বিদ্রোহী ললিত নগর পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন। ললিত নগরও হুডারই অনুগত। ভবন-খেরা আসনেও একই অবস্থা।
কংগ্রেস ২০১৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃতীয় হয়েছিল। ২০.৭% ভোট আর ১৫টি আসন জিতেছিল দল। ২০১৯ সালে ৩১টি আসন পেয়েছিল তারা। সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সুদিন ফেরে। কিন্তু বিধানসভা ভোটে আবারও আশাভঙ্গ। বর্তমান বিধানসভা ভোটের ফলাফল অনুসারে, কংগ্রেস, যারা ২০১৯ সালে ২৮.০৮% ভোট পেয়েছিল, তারা এবার পেয়েছে ৩৯.০৯% ভোট। অন্যদিকে বিজেপি ২০১৯ সালে ৩৬.৪৯% ভোট এবং ৪০ টি আসন পেয়েছিল, তাদের ভোট শতাংশ এবার ৩৯.৯৪%। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কংগ্রেস এবার ভোট পেয়েছে ৩৯.০৯% আর বিজেপি পেয়েছে ৩৯.৯৪%! সামান্যই ফারাক!
বিশ্লেষকরা বলছেন, হরিয়ানায় বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সমাজবাদী পার্টি এবং আপ কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জোট করতে চেয়েছিল। এমনকী খোদ রাহুল গান্ধিও এই জোট চেয়েছিলেন কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্ব জোটের সব সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেয়। এবার আপ ভোট পেয়েছে ১.৮%। যদি অখিলেশ যাদব, অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং রাহুল গান্ধির জোট হতো, তাহলে হরিয়ানায় বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট পাওয়া আরও সহজ হতো না কি? কংগ্রেস স্রেফ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জেতা নির্বাচন হেরে গেল!