বাংলা-সহ ৫ ভাষার মুকুটে 'ধ্রুপদী' পালক, এর ফলে যে যে সুবিধা পেতে চলেছে বাংলা ভাষা

Classical language: ফলে বাংলার ক্ষেত্রেও এই সব সুবিধাগুলি পাওয়া যাবে। বাংলার প্রাচীন পুঁথি এবং অন্যান্য লেখা সংরক্ষণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রাচীন গ্রন্থগুলো ডিজিটাল করা হবে।

কিছু দিন আগেই ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা। গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ওই স্বীকৃতির খবর আসে। তবে শুধু বাংলা ভাষা-ই নয়, একই সঙ্গে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে আরও পাঁচটি আঞ্চলিক ভাষা। কী কী রয়েছে সেই তালিকায়? জানা গিয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছে— মারাঠি, পালি, প্রাকৃত, অসমীয়া। ইতিমধ্যেই সেই তালিকায় ছিল সংস্কৃত, তামিল, তেলুগু, মালয়লম, কন্নড় এবং ওড়িয়া ভাষা। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হল আরও পাঁচটি। যার ফলে ভারতে ধ্রুপদী ভাষার সংখ্যা বেড়ে হল এগারোটি।

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলার জন্য ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা চাওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্যের দাবির প্রেক্ষিতে ২০০৪ সালে ইউপিএ-১ সরকার ভারতীয় ভাষায় 'ধ্রুপদী ভাষা' নামে সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিভাগ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওই কমিটিকে বিভিন্ন রাজ্য এবং সংস্থার 'ধ্রুপদি ভাষা'র মর্যাদা চেয়ে আবেদনগুলো, বিবেচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই স্বীকৃতির জন্য স্থির করা হয় নির্দিষ্ট মানদণ্ডও। যার অধীনে তামিলকে সর্বপ্রথম ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২০০৪ সালের ১২ অক্টোবর। এরপর সংস্কৃত, তেলেগু, কন্নড়, মালায়লাম ও ওড়িয়াকে ক্লাসিকাল ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের ২৫ নভেম্বর, সংস্কৃতকে 'ধ্রুপদি ভাষা'র মর্যাদা দেওয়া হয়।, ২০০৮ সালে পায় তেলেগু ও কন্নড়, ২০১৩ সালে মালায়লাম এবং ওড়িয়া এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

আরও পড়ুন: সাহিত্যের পীঠস্থান: বইপাড়ার এক নিভৃত আত্মকথন

ঠিক কোন কোন মানদণ্ডে নির্ধারিত হয়, আদৌ সেই ভাষাটি ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পাবে কিনা? বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছন, একটি ক্লাসিকাল ভাষার মানদণ্ড অনুযায়ী, ভাষার রেকর্ড ১৫০০ থেকে ২০০০ বছরের পুরনো হওয়া উচিত। এছাড়াও, ভাষার প্রাচীন সাহিত্য এবং গ্রন্থের সংগ্রহ থাকতে হবে। একটি ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর, প্রাচীন সাহিত্যিক ঐতিহ্য যেমন পাঠ্য, কবিতা, নাটক ইত্যাদি ডিজিটালাইজড এবং সংরক্ষণ করা হয়। এটি ভবিষ্যত প্রজন্মকে সেই ঐতিহ্য বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে সক্ষম করবে। সাহিত্য ঐতিহ্যে মৌলিকতা থাকতে হবে। ধ্রুপদী ভাষা এবং সাহিত্য আধুনিক ভাষা ও সাহিত্য থেকে আলাদা, তাই পরবর্তী রূপগুলির মধ্যে বৈষম্য থাকতে পারে। চলতি বছরের ২৫ জুলাই, ভাষা বিশেষজ্ঞ কমিটি (এলইসি) সর্বসম্মতিক্রমে ক্লাসিক্যাল স্ট্যাটাসের বা 'ধ্রুপদি ভাষা'র মানদণ্ড নতুন করে সংশোধন করে। মন্ত্রকের পক্ষ থেকে যুগ্ম সচিব অমিতা প্রসাদ সর্বতী এই বিবৃতি প্রকাশ করে জানান, নয়া মানদণ্ডগুলি হল: ১) ভাষাগুলোর ১,৫০০-২,০০০ বছরের ইতিহাস থাকতে হবে। ২) প্রাচীন সাহিত্যের ধারা সেই ভাষায় থাকতে হবে। ৩) ওই সব ভাষায় লেখালেখির ঐতিহাসিক, শিলালিপিগত প্রমাণ থাকতে হবে। ৪) সেই ভাষায় অতীতে কবিতা ছাড়াও গদ্যে জ্ঞানসমৃদ্ধ লেখালেখি থাকতে হবে। ৫) ধ্রুপদি ভাষার সঙ্গে তার বর্তমানের ধারার মিল থাকতে হবে।

এর পরেই কমিটি পাঁচটি নতুন ধ্রুপদি ভাষা তালিকায় যোগ করার সুপারিশ করেছিল। যার প্রস্তাব কয়েক বছর ধরেই কেন্দ্রের কাছে পড়েছিল। সম্প্রতি সেগুলোতেই অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। বাংলার সঙ্গেই এবার ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে মরাঠিও। ২০১২ সালে, মহারাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়, যেখানে মারাঠিকে ক্লাসিকাল ভাষার মর্যাদা দেওয়ার অনুরোধ করে। এই প্রস্তাব ভাষাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ কমিটিতে (LEC) পাঠানো হয়েছিল। তারপর ভাষাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ কমিটি ক্লাসিকাল ভাষার জন্য মারাঠি ভাষাকে সুপারিশ করেছিল। এটি মহারাষ্ট্র রাজ্যে একটি বড় নির্বাচনী ইস্যুও ছিল। পশ্চিমবঙ্গ এবং অসম রাজ্যের সরকারগুলোও তাদের নিজ নিজ ভাষার জন্য 'ধ্রুপদি' ভাষার মর্যাদা চেয়েছিল। এই উভয় ভাষারই উৎপত্তি 'মাগধী প্রাকৃত' থেকে। এই 'মাগধী প্রাকৃত' পূর্ব ভারতে জনপ্রিয় প্রাকৃতের একটি রূপ। যা ছিল, মগধের শাসকদের আমলের সরকারি ভাষা। ঠিক কোন তারিখে এই ভাষাগুলো তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে নানা মত আছে। পণ্ডিতরা বলছেন, ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে এই ভাষাগুলোর উৎপত্তি হয়েছিল। কিংবদন্তি ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ধারণা ছিল, ইন্দো-আর্য স্থানীয় ভাষা সম্ভবত বাংলার আগে অসমেই চালু হয়েছিল।

একই সঙ্গে মর্যাদা পেয়েছে প্রাকৃত ও পালি। পণ্ডিতদের মতে, কোনও একক ভাষাকে প্রাকৃত ভাষা বলা হত না। ভাষাবিদরা প্রাকৃত শব্দটি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ইন্দো-আর্য ভাষাগুলোর একটি গোষ্ঠীকে বোঝাতেন। যাদের সম্পর্কে বলা হত যে ওই ভাষাগুলো সংস্কৃতের বদলে জনসাধারণ ব্যবহার করতেন। আর, সংস্কৃত স্রেফ অভিজাত এবং উচ্চস্তরের সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ইতিহাসবিদ এএল বাশাম তাঁর 'দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ইজ ইন্ডিয়া (১৯৫৪)' এ লিখেছেন: 'বুদ্ধের সময় জনগণ এমন ভাষায় কথা বলতেন, যা সংস্কৃতের চেয়ে অনেক সহজ ছিল। এগুলোই ছিল প্রাকৃত। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি উপভাষা বলে প্রমাণিত হয়েছে।'

এখন প্রশ্ন ওঠে, এই যে পাঁচ- পাঁচটি ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হল, তার ফলে কী লাভ হল? বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, 'ধ্রুপদি ভাষা'র স্বীকৃতি পাওয়ায় এই ভাষাগুলোর সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত প্রভাব জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রসারিত হবে। শিক্ষা মন্ত্রক সেই উদ্যোগ নেবে। যেমন, ইতিমধ্যেই সংস্কৃতের প্রচারের জন্য ২০২০ সালে তিনটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেগুলি হল, রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত সংস্থা, নয়া দিল্লি; মহর্ষি সন্দীপনি জাতীয় বেদ বিদ্যা প্রতিষ্ঠান, উজ্জয়িনী; রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত বিদ্যাপীঠ, তিরুপতি; এবং শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত বিদ্যাপীঠ, নয়াদিল্লি। প্রাচীন তামিল গ্রন্থের অনুবাদের সুবিধার জন্য এবং তামিল ভাষায় কোর্স করার জন্য ২০০৮ সালে চেন্নাইয়ে সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ক্লাসিক্যাল তামিল (CICT) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কন্নড়, তেলেগু, মালয়ালম এবং ওড়িয়া অধ্যয়নের জন্যও একইরকম 'উৎকর্ষ কেন্দ্র' তৈরি করা হয়েছে। মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ২০১১ সালে এ সংশ্লিষ্ট ভাষায় অধ্যয়নের জন্য সেন্টার অফ এক্সিলেন্স তৈরি করে সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস (CIIL)।

আরও পড়ুন: ধ্রুপদী মর্যাদা পেল বাংলা ভাষা! নতুন প্রজন্মের কাছে সম্মান পাবে মাতৃভাষা?

মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের মতে, একটি ভাষাকে ক্লাসিকাল ভাষা হিসাবে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার সুবিধাগুলি হল, শাস্ত্রীয় ভাষায় অধ্যয়নের জন্য একটি উৎকর্ষ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা তো হয়ই, পাশাপাশি ভারতীয় শাস্ত্রীয় ভাষায় বিশিষ্ট পণ্ডিতদের দুটি প্রধান বার্ষিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিতরণ করা হয়। পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ধ্রুপদী ভাষার জন্য পেশাদার চেয়ারের কিছু পদ ঘোষণা করার জন্য অনুরোধ করেছে। এ ছাড়া তালিকায় থাকা ভাষাগুলির জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রক, (বিভিন্ন একাডেমির মাধ্যমে) শিক্ষা মন্ত্রক এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলো এইসব ভাষায় আরও বেশি জ্ঞান-আদান-প্রদান এবং গবেষণা করার ব্যবস্থা করবে। এছাড়াও, পণ্ডিতদের সুবিধার জন্য এই সব ভাষায় পাণ্ডুলিপিগুলো ডিজিটালাইজড করা হবে বলে সংস্কৃতি মন্ত্রকের আধিকারিকরা জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) এই ভাষাগুলির প্রচারের জন্য গবেষণা প্রকল্পও পরিচালনা করে। ইউজিসি ২০১৬-১৭ সালে ৫৬.৭৪ লক্ষ টাকা এবং ২০১৭-১৮ সালে ৯৫.৬৭ লক্ষ টাকার ফান্ড জারি করেছিল। ধ্রুপদী ভাষা জানা ও গ্রহণ করলে বৈশ্বিক পর্যায়ে ভাষার স্বীকৃতি ও সম্মান পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে এই সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে, যা ধ্রুপদী ভাষার সংরক্ষণকে উন্নীত করবে। শাস্ত্রীয় ভাষার জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ তাদের সংস্কৃতিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে এবং প্রাচীন সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সাথে আরও ভালোভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে।

ফলে বাংলার ক্ষেত্রেও এই সব সুবিধাগুলি পাওয়া যাবে। বাংলার প্রাচীন পুঁথি এবং অন্যান্য লেখা সংরক্ষণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রাচীন গ্রন্থগুলো ডিজিটাল করা হবে। আশা করা যায়, আরও বেশি করে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ এবং প্রকাশনা হবে এই স্বীকৃতির ফলে। কেবলমাত্র বাংলা ভাষার চর্চা করতে তৈরি হবে বিশেষ গবেষণা কেন্দ্র। বাংলা নিয়ে উচ্চশিক্ষায় গেলে বৃত্তি পাবেন পড়ুয়ারা। এছাড়াও বাংলা ভাষার সঙ্গে জড়িত স্থাপত্য, বিশেষ ভবনগুলোকে পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে এই স্বীকৃতির পর। বাংলার সঙ্গে যুক্ত সংস্কৃতিকেও বাঁচিয়ে রাখার আরও বেশি করে চেষ্টা করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাংলা পড়ানোর বিশেষ কোর্স থাকবে। ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার পরে বাংলা ভাষা নিয়ে একাধিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হতে পারে। বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করে কর্মসংস্থানের সুযোগও ভবিষ্যতে বাড়বে বলেই আশা করা যেতে পারে।

More Articles