ছোট্ট মাথা নিয়েও মানুষকে টক্কর, বুদ্ধিমত্তায় তাক লাগাল হোমো নালেডি-রা

Homo naledi: যদি যোগ্যতমের উদবর্তনে টিকে যেত হোমো নালেডিরা, তাহলে কি মানুষকে টেক্কা দিত তারা সমানে সমানে?

যত বড় মাথা, তত বেশি বুদ্ধি। প্রাণীজগৎ সম্পর্কে এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা রয়ে গিয়েছে। শুধু প্রাণী জগৎই বা বলি কেন, মানবসমাজেও কি তেমন ধারণা বসে নেই লতায়-পাতায়, শাখায়-শাখায়। যত বড় মাথা, যত ক্ষমতা, যত প্রতিপত্তি, ততই তার সম্মান। কিন্তু ছোট্ট মাথাতেও যে বিস্তর বুদ্ধি আঁটতে পারে, তার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছেন এবার বিজ্ঞানীরা।

বেশ কয়েক বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রেডল অব হিউম্যানকাইন্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত রাইজিং স্টার গুহা থেকে হোমিনিনের একটি নতুন প্রজাতি খুঁজে পান একদল গবেষক। যার নাম হোমো নালেডি। যাদের হাত-পা অবিকল মানুষের মতো হলেও, তা মানুষের থেকে আকারে অনেক ছোট। শরীর এবং মস্তিষ্কের আকার দেখে প্রাথমিক ভাবে ধরেই নিয়েছিলেন গবেষকেরা, আদিম মানুষের এই প্রজাতিটির বুদ্ধিশুদ্ধি নেহাতই কম। অন্তত সর্ববুদ্ধিমান মানুষের চেয়ে তো বটেই।

আরও পড়ুন: মদে চুমুক দিতে সোনার ‘স্ট্র’! সুরাপ্রেমের তাক লাগানো ইতিহাস…

মস্তিষ্কের আকার এবং গড়নের উপরে যে প্রাণীর বুদ্ধি অনেকটাই নির্ভর করে, প্রাণীজগৎ সম্পর্কে খুব পরিচিত একটি তত্ত্ব। ঠিক যে কারণে, হাতিকে তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমান প্রাণী বলে মনে করা হয়। তবে সেই তত্ত্বকে সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে এই আদিম মানব প্রজাতিটি। যতদূর জানা গিয়েছে, ৩,৩৫,০০০ থেকে ২,৩৬,০০ বছর আগে পৃথিবীতে বেঁচে ছিল ওই প্রজাতি। আর অত বছর আগে তারা যে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করত তা-ই নয়, মৃতদেহকে সমাধিস্থ করার ধারণা পর্যন্ত ছিল ওই আদিম মানবদের মধ্যে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের গবেষক ও প্যালেন্ত্রোপলজিস্ট (মানববিবর্তন এবং পুরাতত্ত্ব নিয়ে যারা গবেষণা করেন) লি বার্গার তাঁর দলবল মিলে অভিযান চালান ওই গুহায়। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ওই গুহায় চলে খননকাজ। আর তাতেই উঠে আসতে থাকে হোমো নালেডি প্রজাতির মানবের একের পর এক কঙ্কাল। শুধু কি তাই, তার সঙ্গে গুহার দেওয়ালে মিলছে খোদাই। যা আদতে সমাধিগুলিকে চিহ্নিত করতেই ব্যবহার হত বলে মনে করা হচ্ছে।

কোনওটা ত্রিভূজ, তো কোনওটা চতুর্ভূজ। কোথাও আবার হাল আমলের হ্যাশট্যাগ সাইন। কোথাও আবার খোদাই করা রয়েছে সমান সমান চিহ্ন। সেইসব চিহ্নের মর্মোদ্ধার করা না-গেলেও তার সঙ্গে যে ওই সব সমাধির যোগ রয়েছে, তা সম্পর্কে একপ্রকার নিশ্চিত বার্জার এবং তাঁর দলবল। হতে পারে, ওই সব চিহ্নগুলি সেই সব মানুষের পরিচয় বোঝাতে বা তাঁদের পূর্বপুরুষের নাম উল্লেখ করতে ব্যবহার করা হত। আজকের যে মানুষ, অর্থাৎ হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির সঙ্গে এই হোমো নালেডিদের আদৌ কোনও যোগসূত্র ছিল কিনা, তার হদিশ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে মনে করা হচ্ছে, কম করে হলেও ২৫০,০০০ বছর আগে অস্তিত্ব ছিল প্রাণীগুলির। খননকার্যে খুঁজে পাওয়া কঙ্কাল, হাড়গোড়গুলি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, যে তার সঙ্গে মানুষের আদৌ সাযুজ্য আছে কিনা।

মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের থেকে শ্রেষ্ঠ এবং আলাদা তাদের মস্তিষ্কের গড়নের জন্যই। তবে হোমো নালেডি প্রজাতির এই প্রাণীগুলির মস্তিষ্কের আকার শিম্পাঞ্জির মতোই। তবে যেভাবে ওই গুহা থেকে ওই প্রজাতির প্রাণীদের সমাধি উদ্ধার হয়েছে, তা চমকে দিয়েছে গবেষকদের। এমন বুদ্ধিমত্তার কাজ মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রজাতি করতে পেরেছে বলে জানা নেই। তবে ব্যতিক্রম এই হোমো নেলেডিরা। এখানেই শেষ নয়। হোমো নালেডিরা আগুনের ব্যবহার জানত বলেও ধারণা গবেষকদের। ওই খননকার্যের ফলে গুহা থেকে অন্যান্য প্রাণীদের হাড়গোড়ও মিলেছে। বোঝাই যাচ্ছে, সেইসব খেয়েই পেট ভরাত তারা। সব মিলিয়ে নয়া একটি সভ্যতার খোঁজ পেয়েছেন যেন বার্জার।

মাথা ছোট হলে কী হবে, লম্বায় কিন্তু বেশ বড় ছিল প্রাণীগুলি। তার উপর শীর্ণকায় চেহারা। মজার ব্যপার, নিদর্শনগুলি দেখে বহুযুগ আগের মনে হলেও, মাত্র ২৫০,০০০-৩৫০০০০ বছর আগে এই পৃথিবীতে বাস করত তারা। আর আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই সময়েই আধুনিক মানুষের বিবর্তনপর্ব চলেছে। তবে কবে এই পৃথিবী থেকে মুছে গেল হোমো নালেডিদের অস্তিত্ব, তা স্পষ্ট নয়। কেনই বা হারিয়ে গেল তাঁরা, স্পষ্ট নয় তা-ও। তবে বার্জারের অনুমান, এই প্রজাতির প্রাণীরা ছিল অত্যন্ত রহস্যময়। আর সেটাও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ।

দক্ষিণ আফ্রিকার ওই রাইজিং স্টার গুহাটিকে ১৯৯৯ সালে হেরিটেজ সাইট বলে ঘোষণা করে ইউনেস্কো। তবে তুলনামূলক ভাবে অনাবিষ্কৃতই রয়ে গিয়েছে গুহাটি। ২০০৮ সাল নাগাদ ওই গুহাটির মানচিত্র তৈরি করার পর গুহার ভিতরে একটি সরু গোলকধাঁধা খুঁজে বের করেন বার্জার। সেখানে মেলে একটি কুঠুরিও। আর সেই কুঠুরিতেই মিলছে প্রাণীগুলি অস্থি। না, সহজ ছিল না এই অভিযান। গুহার ভিতরের ওই রাস্তা মাত্র সাড়ে সাত ইঞ্চি চওড়া। ফলে সেখানে ঢোকার জন্য ৫৫ পাউন্ড ওজন কমাতে হয়েছিল বার্জারকে। স্বাভাবিক ভাবেই ৪০ ফুট লম্বা ওই সরু গলির ওই সফর ছিল বেশ কঠিন। যেখানে একবার ঢুকলে বেরতো সময় লেগে যেত বেশ কয়েক ঘণ্টা। তবে সেই অসুবিধার তোয়াক্কা না করেই দীর্ঘদিন ওই গুহায় খনন অভিযান চালিয়ে গিয়েছেন বার্জার ও তাঁর দলবল। ফলও মিলছে। হাতে উঠে এসেছে এই বিস্ময়কর বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্বের প্রমাণ।

আরও পড়ুন: সারি সারি কফিন ঝোলানো এই পাহাড়ে! ঝুলন্ত কবরের যে ইতিহাস স্তম্ভিত করবে

মানুষের বিবর্তন নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। ডারউইনের সূত্র মেনে কীভাবে মানুষ সমস্ত রকম সীমাবদ্ধতাকে পিছনে ফেলে টিকে রইল। কীভাবে বুদ্ধিবলে উঠে এল প্রাণীশ্রেষ্ঠ হয়ে, তা নিয়ে বিস্ময়ের শেষ নেই আজও। ক্রমে আগুনের ব্যবহার শিখে, চাকা আবিষ্কার করে গড়ে তুলল আশ্চর্য সভ্যতা, তা-ও সাড়া জাগানো। তবে সত্যিই যদি যোগ্যতমের উদবর্তনে টিকে যেত হোমো নালেডিরা, তাহলে কি মানুষকে টেক্কা দিত তারা সমানে সমানে? মানুষের পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে গড়ে উঠতে পারত অন্য এক শ্রেষ্ঠ প্রাণীর সভ্যতা। তার উত্তর সত্যিই জানা নেই আমাদের।

More Articles