৪৮ ঘণ্টায় দশটিরও বেশি উড়ানে বোমা হামলার হুমকি! ভারতীয় আকাশপথে সন্ত্রাসের ছক?

Indian Flight Bomb Hoax: স্বাভাবিক ভাবেই পর পর বোমাতঙ্কের ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে কেন্দ্র সরকারের। বুধবারই এ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ডেকেছে অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রক।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একাধিক দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই রয়েছে। ইজরায়েল-গাজা যুদ্ধ শেষ না হতেই লেবানন ও ইরানের সঙ্গে নতুন করে যুদ্ধে জড়িয়েছে ইজরায়েল। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধও চলছে। এর মধ্যে আবার উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্ব বেঁধেছে দক্ষিণ কোরিয়ার। এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আতঙ্ক উস্কে এবার একের পর এক ভারতীয় বিমানে বোমা-হামলার হুমকি। বোমা মেরে বিমান উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে একের পর এক বার্তা আসছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। স্বাভাবিক ভাবেই আতঙ্কে কাঁপছে ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলি। সূত্রের খবর, গত ৪৮ ঘণ্টায় অন্তত দশটি ভারতীয় বিমানকে বোমা হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। যার ফলে উড়ান চলাচলে বহু ক্ষেত্রেই বাধার সৃষ্টি হয়েছে। বিলম্ব হচ্ছে বিমান চলাচলে।

মঙ্গলবার এয়ার ইন্ডিয়ার একটি এক্সপ্রেস বিমানে বোমার হুমকি পেয়েই সেটিকে জনবসতি থেকে দূরে নিয়ে যায় সিঙ্গাপুরের বায়ুসেনা। কার্যত দুটি ফাইটার জেট দিয়ে বিমানটিকে উদ্ধার করা হয়। তার কয়েক ঘণ্টা আগের কথা। দিল্লি থেকে শিকাগো যাওয়ার পথে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানকে কানাডার একটি বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করানো হয়। সেই বিমানে অন্তত ২১১ জন যাত্রী ছিল বলে খবর। নেপথ্যে ছিল সেই বোমাতঙ্ক। বিমানে বোমাতঙ্ক ছড়ানো, ভুয়ো ফোন নতুন কিছু নয়। তবে এ হারে ঘন ঘন বোমাতঙ্ক, বোমা হামলার হুমকি বিপাকে ফেলেছে বিমানসংস্থাগুলিকে।

সোমবারও মুম্বই থেকে ছাড়া তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানে ভুয়ো বোমা বিস্ফোরণের হুমকি দেওয়া হয়। জানা গিয়েছে, এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে বোমা হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘটনায় তিন জনকে তলব করা হয়। তার মধ্যে এক বাবা-ছেলে ছাড়াও রয়েছে ছত্তীসগঢ়ের এক বাসিন্দা। জনন্দগাঁওয়ের পুলিশ সুপার মোহিত গর্গ বলেন, ‘‘ওই এক্স হ্যান্ডল থেকে সোমবার এয়ার ইন্ডিয়ার মুম্বই-নিউ ইয়র্কগামী উড়ান এবং ইন্ডিগোর মাস্কাট ও জেদ্দাগামী দুই বিমানে বোমা হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এর জেরে প্রথম বিমানটি নয়াদিল্লিতে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। অন্য দু’টি বিমানও পূর্বনির্ধারিত সময়সূচির অনেক পরে ওড়ে। ঘটনায় তদন্তে নেমে সোমবারই মুম্বই পুলিশের একটি দল রাজনন্দগাঁওয়ে পৌঁছয়। এর পরেই ১৭ বছরের ওই কিশোর, তার বাবা এবং তৃতীয় আর এক ব্যক্তিকে তলব করা হয়েছে। তিন জনকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুম্বইয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছে।’’

এ ছাড়াও যে যে বিমানগুলি এ হেন হুমকির মুখে পড়েছে, তার মধ্যে রয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের ফ্লাইট IX765, যেটি জয়পুর থেকে বেঙ্গালুরু হয়ে অযোধ্যা যাচ্ছিল। রয়েছে স্পাইসজেটের ফ্লাইট SG116, যেটি দারভাঙ্গা থেকে মুম্বই সফর করছিল। রয়েছে বাগডোগরা-বেঙ্গালুরু আকাশা এয়ার ফ্লাইট QP1373 , দাম্মাম, সৌদি আরব থেকে লখনউগামী ইন্ডিগো ফ্লাইট 6E98, অমৃতসর থেকে দেহরাদূনগামী অ্যালায়েন্স এয়ার ফ্লাইট 9I650 এবং মাদুরাই থেকে সিঙ্গাপুর যাওয়ার এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস ফ্লাইট IX684।

আরও পড়ুন: রুশ ‘বেদানা’ পোর্তুগালে এসে হল ‘বোমা’! ফলের শরবত খেতে চেয়ে বিচিত্র বিভ্রাট যুবকের

দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিটি হুমকিই দেওয়া হচ্ছে এক্স হ্যান্ডেলকে ব্য়বহার করে। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার ব্যবধানে কার্যত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত দশটি বিমানে বোমাতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে। যে এক্স অ্যাকাউন্টগুলিকে ব্যবহার করে এই বোমাতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটিকে ইতিমধ্যেই শনাক্ত করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, সেই অ্য়াকাউন্টগুলিকে বন্ধ করা হয়েছে রাতারাতি। যা জানা যাচ্ছে, তাতে লন্ডন-সহ একাধিক দেশ থেকে ওই হুমকি-বার্তা পাঠানো হয়েছে। যে কটি বিমানে এই হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে তল্লাশি করে এখনও পর্যন্ত তেমন সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি।

এই প্রথম নয়, এর আগেও এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে বোমাতঙ্ক ছড়ায়। গত ২২ অগস্ট মুম্বই থেকে তিরুঅনন্তপুরমগামী এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে বোমাতঙ্ক ছড়ায়। যার ফলে অবতরণের কিছুক্ষণ আগেই তিরুঅনন্তপুরম বিমানবন্দরে চাঞ্চল্য ছড়ায়। জরুরি অবস্থা জারি করা হয় বিমানবন্দরে। কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয় বিমানবন্দরকে। গত ৯ অক্টোবর, বুধবার লন্ডন থেকে দিল্লিগামী একটি বিমানে বোমা থাকার খবরে দিল্লির বিমানবন্দরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সেদিন সকালে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে একটি ফোন এসেছিল। লন্ডন থেকে দিল্লিগামী ভিস্তারা ফ্লাইটে বোমা থাকার কথা বলা হয়। এরপরেই চাঞ্চল্য ছড়ায়।

স্বাভাবিক ভাবেই পর পর বোমাতঙ্কের ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে ভারতীয় অ্যাভিয়েশন দফতরের। উদ্বেগে রয়েছে কেন্দ্র সরকারও। বুধবারই এ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ডেকেছে অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রক। অসামরিক বিমান পরিবহন নিরাপত্তা সংস্থা তথা ব্যুরে অব সিভিল অ্য়াভিয়েশন সিকিওরিটির তরফে জানানো হয়েছে, ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। শীঘ্রই এই কাজে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হবে।

অতীতেও একাধিক বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা ঘটেছে ভারতের অ্যাভিয়েশনের ইতিহাসে। সত্তরের দশকে হাড় কাঁপানো বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা ঘটেছে এ দেশেই। ১৯৭০ সালের ৩০ জানুয়ারি, শ্রীনগর থেকে জম্মু যাওয়ার পথে একটি ভারতীয় বিমানকে হাইজ্যাক করে জেকেএলএফের দুই দুষ্কৃতী। বিমানটি হাইজ্য়াক করে লাহৌরে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে বিমানটি উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন রকম আলোচনা হয় বটে। তবে শেষপর্যন্ত ছিনতাইকারীরা বিমানটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১৯৭৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমান ৭৩৭-কে দিল্লির পালাম বিমানবন্দর থেকে হাইজ্যাক করে কাশ্মীরের ৬ সন্ত্রাসীর এরটি দল। ১৯৭৮ সালেও দিল্লির পালম বিমানবন্দর থেকে আরও একটি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান হাইজ্যাক হয়েছিল।

আশির দশকও ছিল এমনই নানা বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভরা। ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লি থেকে অমৃতসরগামী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে পড়ে। তারাও বিমানটিকে হাইজ্যাক করে লাহৌরে নিয়ে যায়। ১৯৮১ সালের নভেম্বরে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান জাম্বিয়া থেকে মুম্বই যাচ্ছিল ৬৫ জন যাত্রী ও ১৩ জন কর্মী নিয়ে। সেটিকে হাইজ্যাক করা হয়েছিল। ১৯৮২ সলে দিল্লি-শ্রীনগর একটি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানকে হাইজ্যাক করেছিল শিখ জঙ্গিরা। ওই মাসেই কদিন পরে আর এক শিখ জঙ্গির হাতে হাইজ্যাক হয় যোধপুর থেকে দিল্লিগামী একটি বিমান। ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসেও শ্রীনগর থেকে নয়াদিল্লি যাওয়ার পথে হাইজ্যাকারদের কবলে পড়ে ভারতীয় এয়ারলাইন্সের জেট আইসি ৪০৫। সেটিকে পাকিস্তানে নামতে বাধ্য করা হয়। ওই বছরেরই অগস্টে ১০০ জন যাত্রীবর্তি দিল্লি-শ্রীনগর বিমানটি ছিনতাই করে সাত হাইজ্যাকার। ১৯৮৬ সালেও একটি প্যান অ্যাম বোয়িং ফ্লাইট অপহরণ করে সশস্ত্র চার ফিলিস্তিনি দুষ্কৃতি। প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল সেই ঘটনায়। অপহরণকারীদের গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল পাকিস্তান।

নব্বইয়ের দশকেও কমেনি এই ধরনের বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা। ১৯৯৩ সালের ২২ জানুয়ারি লখনউ বিমানবন্দর থেকে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে হাইজ্যাক হয় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান। ছিনতাইকারীরা অযোধ্যায় অবস্থিত বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে গ্রেফতার হওয়া সমস্ত করসেবকদের মুক্তি এবং রাম জন্মভূমিতে একটি মন্দির নির্মাণের দাবি করেছিল। ১৯৯৩ সালের ২৭ মার্চ মাদ্রাজ যাওয়ার পথে বিস্ফোরক দিয়ে আটকে দেওয়া হয় ইন্ডিয়ার এয়ারলাইন্সের একটি বিমান।

আরও পড়ুন: পালানোর উপায় নেই! রাফাহ, সুজাইয়াতে ইজরায়েলি বোমায় মৃত অন্তত ৪০

তবে ভারতীয় বিমান চলাচলের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। কাঠমান্ডু থেকে উড়ে আসা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান আইসি ৮১৪-কে হাইজ্যাক করে আফগানিস্তানের কান্দাহারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যা সেসময় ছিল তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে। প্রায় সাত দিন হাইজ্যাক করে রাখা হয়েছিল বিমানটিকে। সাত দিন পর জঙ্গিদের হাত থেকে ওই বিমানের যাত্রীরা মুক্তি পেলেও ভারতকে যে মূল্য দিতে হয়েছিল তা ছিল চরম। বিমানযাত্রীদের বদলে তিন বিপজ্জনক জঙ্গিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ওই তিন জঙ্গির মধ্যে ছিলেন কুখ্যাত জঙ্গি তথা পাক জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদের প্রধান মৌলানা মাসুদ আজহারও। সেই ঘটনার স্মৃতি এখনও তাড়া করে অনেক ভারতীয়কে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ওটিটি মাধ্যম নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছিল ‘আইসি ৮১৪: দ্য কন্দহর হাইজ্যাক’ নামে একটি সিনেমাও। সেই ছবিটিকে ঘিরে যথেষ্ট বিতর্কও হয়।

বেশ কিছু দিন ধরেই আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল নিয়ে একাধিক সমস্যা লেগেই রয়েছে। মে মাসের দিকে একের পর এক আন্তর্জাতিক বিমান বাতিল হওয়ায় সমস্যার মুখে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়া, ভিস্তারার মতো একাধিক বিমানসংস্থা। একাধিক বিমান বাতিলও হয় সে সময়। সেই অচলাবস্থা কাটিয়ে ছন্দে ফিরতে না ফিরতেই নয়া বিপাকের মুখে ভারতীয় বিমানসংস্থাগুলি। যেভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একের পর এক বিমানে বোমা হামলার হুমকি আসতে শুরু করেছে, তাতে যেমন বাণিজ্যিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে , একই সঙ্গে সত্তর-আশি-নব্বই দশকের স্মৃতি উস্কে এমন কোনও সন্ত্রাসমূলক কাজ বা হাইজ্যাকের ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না একেবারেই। সব মিলিয়ে বড় বিপদের মুখে ভারতীয় বিমান পরিষেবা।

More Articles