বাঞ্ছাবুড়োর মৃত্যু নেই! মৃত্যুর পরেও চিরঅম্লান থেকে যাবেন মনোজ মিত্র
Manoj Mitra Death: যারা থিয়েটারে মনোজ মিত্রকে সেভাবে আবিষ্কার করেননি, তারা এক দুর্লভ অভিনেতার খোঁজ পেয়েছিলেন বাঞ্ছারামের বাগানে।
একাধিকবার রটে গিয়েছিল গুজব। একাধিকবার সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছিল চলে যাওয়ার খবর। প্রতিবারই সমস্ত খবরের ছাই উড়িয়ে ফিরে এসেছিলেন তিনি। অবশেষে সেই আশ্চর্য প্রদীপ নিভে গেল, হেমন্তের এক ম্রিয়মাণ সকালে। প্রয়াত হলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা, নাট্যকার মনোজ মিত্র। ৮৬ বছরের জীবন, ৮৬ বছরের অভিজ্ঞতা রেখে, চলে গেলেন মনোজ মিত্র। দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন বার্ধ্যকজনিত সমস্যায়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন ঠিকই কিন্তু এবার দাঁড়ি টেনে দিল মৃত্যু, জীবনের চৌকাঠে। ১২ নভেম্বর সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা।
১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলাদেশের খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার ধুলিহর গ্রামে বাবা অশোককুমার মিত্র এবং মা রাধারাণী মিত্রর ঘরে জন্ম তাঁর। তারপর উদ্বাস্তু পরুবাআরের যা হয়, স্বাধীনতার পর কলকাতায় চলে আসেন তাঁরা। স্কটিশচার্চ কলেজে পড়াশোনা করেন। বাবা চরম অনিচ্ছুক হলেও, ছেলে থিয়েটার অন্ত প্রাণ। কলেজে পড়ার সময়েই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া তাঁর। ১৯৫৭ সালে কলকাতায় নাটকে অভিনয় শুরু করেন মনোজ মিত্র। প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’ লেখেন ১৯৫৯ সালে। ১৯৭২ সালে বিখ্যাত ‘চাক ভাঙা মধু’ নাটকের মাধ্যমেই পরিচিত হন মনোজ। এর পরে তৈরি করেছিলেন নাট্যদল ‘ঋতায়ন’, তারও পরে 'সুন্দররম'। জীবনভর লিখে গেছেন অজস্র নাটক। সারা বাংলার বহু নাট্যদলের সম্পদ তাঁর তৈরি অজস্র থিয়েটার। শুধু থিয়েটার নয়, বাংলা সিনেমায় তাঁর উপস্থিতি পর্দাজুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে উজ্জ্বলতম আবির! ১৯৭৯ সালে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। বহুদিন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন তিনি। অবসর নিয়েছিলেন ২০০৩ সালে।
আরও পড়ুন- অভিনয় দেখে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন বিদ্যাসাগর, বাংলা থিয়েটারের ধ্রুবতারা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি
সাজানো বাগান, চোখে আঙুল দাদা, কালবিহঙ্গ, পরবস, অলকানন্দার পুত্র কন্যা, নরক গুলজার, অশ্বত্থামার মতো থিয়েটার গড়ে বাংলার নাট্যজগতকে অজস্র মুক্তো উপহার দিয়ে গেছেন মনোজ মিত্র। মনোজ মিত্র বিশ্বাস করতেন, দর্শকরা চান মঞ্চের উপরে বাস্তব দেখতে, সত্যি দেখতে। তাঁর থিয়েটার শুধু শিল্পের জন্য শিল্প হয়ে থাকেনি তাই। মানুষের অন্তস্থ অন্ধকারের কোথায় স্পর্শ করলে তা জোনাকি জ্বালিয়ে দিতে পারে, জানতেন মনোজ মিত্র। প্রত্যেকটি থিয়েটার তাই বাস্তবের পটচিত্র হয়েই থেকেছে।
আর, যারা থিয়েটারে মনোজ মিত্রকে সেভাবে আবিষ্কার করেননি, তারা এক দুর্লভ অভিনেতার খোঁজ পেয়েছিলেন বাঞ্ছারামের বাগানে। এক-দুইখানা প্রজন্মের স্মৃতিতে মনোজ মিত্র চিরকাল থেকে গেছিলেন বুড়ো বাঞ্ছারাম হয়ে। মনোজ মিত্র সলে একজনই। তাঁর পথচলাই নাট্যানুরাগীদের পাথেয়। তপন সিংহ, তপন মজুমদার, বাসু চট্টোপাধ্যায় একাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন মনোজ মিত্র। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘গণশত্রু’ এবং ‘ঘরে বাইরে’-তেও অভিনয় করেন তিনি। আবার একইসঙ্গে হরনাথ চক্রবর্তী, অঞ্জন চৌধুরীর মূলধারার একাধিক সিনেমায় পরিচিত মুখ ছিলেন মনোজ মিত্র। কী আশ্চর্য সহাবস্থান! নেতিবাচক চরিত্র দিয়েও যে দর্শকদের শ্রদ্ধা এবং সম্ভ্রম আদায় করা যায়, প্রমাণ করে দিয়েছিলেন মনোজ মিত্র।
এই দীর্ঘ পথচলা থামল অবশেষে। মনোজ মিত্রকে হয়তো নাট্যআন্দোলনের যোদ্ধা বলা যায় না, হয়তো রাজনীতি আর থিয়েটারের মধ্যে নিরাপদ সেতু বজায় রেখেওছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিগুলি বাংলার নাট্যইতিহাসের সম্পদ, এক একখানা ভাস্বর মাইলস্টোন। যে মাইলস্টোনে লেখা থাকবে মনোজ মিত্রের চলাচলের দৃপ্ত পদধ্বনি, আজীবন।