সব লড়াই শেষ, চলে গেলেন ঐন্দ্রিলা, অমর হয়ে থাকল প্রেমের রূপকথা
Aindrila Sharma: কোনও লড়াই আর কাজে দিল না মেয়েটির জীবনে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের আক্রমণ নেমে এল অচিরেই।
'আমার সামনে শুয়ে থেকেও হয়তো কয়েক সহস্র মাইল দূরে আছে, কিন্তু ঠিক ফিরে আসবে। ওর একা থাকতে বিরক্ত লাগে।' সপ্তাহখানেক আগে নিজের সামাজিক পাতায় লিখেছিলেন ঐন্দ্রিলা-প্রিয় অভিনেতা সব্যসাচী চৌধুরী। জনতার আদরের 'বামাক্ষ্যাপা' প্রার্থনা করছিলেন বারবার। সঙ্গে অগণিত ভক্তকূল!
কিন্তু আর ফিরলেন কই! একা থাকার বিরক্তিকে বন্ধু করেই জাঁকজমকের হাসপাতালেই চিরনিদ্রায় সমাহিত হলেন অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা (Aidrila Sharma) । দু'সপ্তাহের বেশি হাওড়ার এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার মাত্র ২৩ বছর বয়সেই জীবন পথের শেষ করলেন অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা (Aindrila Sharma Demise) । এ রাজ্য তো বটেই দেশের ভালোবাসার ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করে চলে গেলেন সম্ভাবনাময়ী এই অভিনেত্রী।
জীবনের মারাত্মক দুই কঠিন লড়াইয়ে জয় পেলেও ঐন্দ্রিলা হেরে গেলেন অবশেষে। অনেকেই বলছেন, তিনি চলে গিয়েছেন শারীরিকভাবে, কিন্তু মাত্র ২৩ বছরের জীবনীশক্তিতে যা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন তা ব্যতিক্রম! তা চিরঞ্জীবী!
আরও পড়ুন: ঠিক কী হয়েছিল ঐন্দ্রিলার, প্রাণঘাতী এই রোগ হানা দিতে পারে যখনতখন, উপসর্গ কী
'ফিনিক্স পাখি' ঐন্দ্রিলা
বারবার তীব্র লড়াই আর প্রবল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ফিরে এসেছেন নতুন করে। ফিরে এসেছেন নতুন উদ্যোগে আর উদ্যমেও। কিন্তু সেই অভিনেত্রীই ফের মুখোমুখি হন অগ্নিপরীক্ষার। ১ নভেম্বর থেকে লড়তে শুরু করেন এক নতুন লড়াই। জীবন আর মৃত্যুর টানাপড়েনে হাওড়ার এক বেসরকারি হাসপাতালের বেডে শুয়ে কৃত্রিম যন্ত্রে চলে তাঁর শরীর, তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাস। হঠাৎ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ তাঁকে কাবু করে ফের। আর এই খবরেই সোশ্যাল-দুনিয়ায় ঝড় ওঠে। নজিরবিহীনভাবে অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলার জন্য প্রার্থনায় সরব হয় সোশ্যাল-দুনিয়া। ফিরে আসতেই হবে তাঁকে, ঐন্দ্রিলা জিতবেনই, বলতে থাকেন সকলেই। কিন্তু আর ফিরলেন কই!
কেন? কী কারণে ঐন্দ্রিলার ফেরার প্রার্থনায় মশগুল হয় সোশ্যাল-দুনিয়া! এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বসলে পিছিয়ে যেতে হয় সব্যসাচীর (Sabyasachi Chowdhury) ভালবাসার জিয়নকাঠির লড়াইয়ের ইতিহাসে। যে লড়াই শুধু এই রাজ্য বা এই দেশ নয়, প্রতিমুহূর্তে বিবর্তিত করেছে, বিরচিত করেছে এক ফিরে আসার কাহিনিকেও।
'সবই তোমায় ছাড়া বৃথা...'
মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে বেড়ে ওঠা ঐন্দ্রিলার। মা শিখা শর্মা, একটি নার্সিং হোস্টেলের ওয়ার্ডেন। বাবা উত্তম শর্মা, মুর্শিদাবাদের পাঁচগ্রাম হাসপাতালের চিকিৎসক। বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে ইন্দ্রপ্রস্থ মোড় এলাকার শর্মা বাড়ির সদস্যরা বরাবর জড়িত চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে। তাঁর দিদিও চিকিৎসক। কিন্তু ঐন্দ্রিলা ছিলেন ছোট থেকেই ভিন্ন। মাত্র তিন বছর বয়স থেকে নাচ শেখা শুরু করেন তিনি। ছোট থেকে পড়াশুনায় মেধাবী ঐন্দ্রিলা বড় নৃত্যশিল্পী হতে চেয়েছিলেন বরাবর। প্রতিমুহূর্তে বাবা-মায়ের সমর্থন এবং অসাধারণ ভালো মনের উপর ভর করে এগোচ্ছিলেন ঐন্দ্রিলা শর্মা।
মারণরোগের বিপদ
কিন্তু মেধাবী ছাত্রী ঐন্দ্রিলার জীবন বদলে গেল ২০১৫ সাল নাগাদ! উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার মাত্র এক বছর আগে, একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় টের পেলেন মারাত্মক বিপদের! সুখের সংসারে নেমে এলো আকস্মিক বিপদ! মাত্র ১৮ বছর বয়সে ঐন্দ্রিলার জীবযুদ্ধে এসে হাজির হয় মারণরোগ ক্যান্সার। তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সার বাঁধে বাসা। তখনও অভিনয় জগতে তেমনভাবে পা রাখেননি তিনি। শুরু হয় নতুন লড়াই। বেঁচে থাকার তাগিদ আর বড় হওয়ার ইচ্ছায় ভর করে দেড় বছরের টানা লড়াই চালান তিনি। অবশেষে বহরমপুরের হাসিখুশি মেয়েটা ওই যন্ত্রণাময় তীব্র লড়াই শেষে, কঠিন চিকিৎসা-পর্ব কাটিয়ে ফের ফিরে আসেন নতুন করে।
অভিনেত্রী-জীবনে ঐন্দ্রিলা
২০১৭ সালে নতুন মোড় নেয় তাঁর জীবন। ক্যান্সার জয় করে ঐন্দ্রিলার স্বপ্নপূরণের পথ খোলে ফের। টেলিভিশন জগতে পা দেন তিনি। ততদিনে বহরমপুরের ঐন্দ্রিলার যাতায়াত বেড়েছে টালিগঞ্জে। একাধিক অডিশনের পর ২০১৭ সাল নাগাদ শুরু করেন 'ঝুমুর' ধারাবাহিকে কাজ। অভিনয়ে দর্শকের মনজয়ে শীর্ষে উঠতে থাকেন প্রথম থেকেই। একদিকে ওষুধ, চিকিৎসার জন্য ভিনরাজ্যে যাওয়া, আবার অভিনয়! জীবনের প্রত্যেক মুহুর্তের লড়াইয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন তিনি। কাছের মানুষ হিসেবে ততদিনে পেয়ে গিয়েছেন 'বামাক্ষ্যাপা' সব্যসাচী চৌধুরীকে। এর সঙ্গেই একাধিক ধারাবাহিকেও কাজ করতে থাকেন ঐন্দ্রিলা।
ফের মারণযুদ্ধে অভিনেত্রী
কথায় বলে অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়! ঐন্দ্রিলার জীবনপথও বোধহয় ঠিক সেইরকমই! ভালোই-ভালোই সব চলতে থাকার মধ্যেই আবারও ওত পেতে থাকা বিপদের মুখোমুখি হন ঐন্দ্রিলা। ফের ঘিরে ধরে মারণরোগ ক্যান্সার। আবারও আক্রান্ত হলেন অভিনেত্রী। প্রেমিক সব্যসাচী চৌধুরীর সান্নিধ্য, পরিবারের সমর্থনে ফের যুদ্ধ জিতলেন ঐন্দ্রিলা।
২০২১ সালে মারণরোগ ক্যান্সারকে দ্বিতীয়বার প্রায় হারিয়ে ছোটপর্দায় ফিরলেন অভিনেত্রী। তাঁর লড়াই আর ফিরে আসার তাগিদ দেখল দুনিয়া। সব্যসাচী-ঐন্দ্রিলা জুটি ততদিনে জনপ্রিয়তার শিখরে। ২৩ বছরের কন্যার লড়াইয়ের কথার প্রকাশ হয়েছে বিশ্বজুড়ে। ঐন্দ্রিলার যুদ্ধের শরিক হয়েছে সোশ্যাল-দুনিয়াও।
একদা শরীরের জন্য ইঞ্জিনিয়ার হতে না পারা মেয়েটাই দু'বার মারণরোগ জয় করে ফিরলেন মূলস্রোতে। চালিয়ে গেলেন অভিনয়। পর্দায় ফিরলেন জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়া জিয়নকাঠির উপজীব্য ঐন্দ্রিলা। সঙ্গে 'জিয়নকাঠি' ধারাবাহিক।
সব্যসাচীর জীবন-রসদ
প্রিয় বন্ধু, সঙ্গী সব্যসাচী আর ঐন্দ্রিলা আবার ফিরছিলেন। প্রেমিকার জন্য নতুন যুদ্ধে জিতছিলেন সব্যসাচী নিজেও। ক্যান্সার আক্রান্তের মানসিক অবস্থানে বারবার বল আরোপ করছিলেন তিনিও।
আর ঐন্দ্রিলা? ভালো থাকার রসদ আর অভিনয়কে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ফের। ওয়েব সিরিজ 'ভাগাড়'-এ তাঁদের জুটির তীব্র প্রকোপ পছন্দ করেছিল দর্শকও।
কিন্তু আর পারলেন না! বারবার মৃত্যুকে হারিয়ে দেওয়ার পরেও আবার অবতীর্ণ হতে হয় মৃত্যুর মুখেই! ফের ঐন্দ্রিলাকে যেন ঘিরে ধরে মৃত্যু! প্রতিমুহূর্তে এক উদীয়মান প্রতিভার বিলুপ্তি আশঙ্কার সৃষ্টি করে দেশজুড়ে। প্রতিটি সেকেন্ডে ঐন্দ্রিলার পরিবার শুধু নয়, হাজার হাজার শুভানুধ্যায়ীর প্রার্থনায় উঠে আসে তাঁর ফিরে আসার কথা।
মৃত্যুদূতের আগমন!
১ নভেম্বর। হাসিখুশি মেয়েটির শরীর খারাপ লাগছিল সকাল থেকেই। আচমকা অর্ধচেতন হলেন ঐন্দ্রিলা। তড়িঘড়ি তাঁকে ভর্তি করানো হয় হাওড়ার এক বেসরকারি হাসপাতালে।
২ নভেম্বর। শারীরিক অবস্থা খারাপ হয় ঐন্দ্রিলার। তাঁকে দেওয়া হয় ভেন্টিলেশনে।
৩ নভেম্বর। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ দিয়ে সমস্যার শুরু হলেও বাড়তে থাকে সংক্রমণ। রক্তের সংক্রমণ ঘেরে অভিনেত্রীকে।
৬ নভেম্বর। খানিকটা আশার আলো দেখিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। রাতের দিকে পরিবারকে আরও আশার কথা শোনান চিকিৎসকরা।
৭ নভেম্বর। ভেন্টিলেশন থেকে বের করা হয় অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলাকে। ভালো খবর শোনান সব্যসাচী নিজেই।
১০ নভেম্বর। আশার আলোর মধ্যেই জমে শঙ্কার মেঘ।
১১ নভেম্বর। ফের বাড়তে থাকে সংক্রমণ।
১২ নভেম্বর। আরও খারাপ হয় ঐন্দ্রিলার শারীরিক অবস্থার। বাড়ে সংক্রমণ। আসে জ্বর।
১৪ নভেম্বর। ক্রমশ অবনতির দিকে পরিস্থিতি। ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ কাজ করতে সমস্ত সৃষ্টি করতে থাকে।
১৭ নভেম্বর। সকাল হতেই খবর আসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন অভিনেত্রী। নিস্তব্ধতা নেমে আসে চারিদিকে। তবুও চলে লড়াই। চিকিৎসকদের তৎপরতা আর ঐন্দ্রিলার লড়াই এক হয়ে যায় মুহূর্তে।
১৮ নভেম্বর। মধ্যরাতে সোশ্যাল দুনিয়া উত্তাল। খবর ছড়ায় আচমকা। ঐন্দ্রিলা শর্মা প্রয়াত। একাধিক তারকাও শেয়ার করতে শুরু করেন সেই খবর। অবশেষে সব্যসাচী ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে জানান, এখবর মিথ্যা!
১৯ নভেম্বর। যেন মৃত্যুর খবরেই আয়ু বাড়ল অভিনেত্রীর। দীর্ঘ বার্তায় তাঁর প্রেমিক অভিনেতা সব্যসাচী জানান বিস্তারিত। ঐশ্বরিক শক্তি আর মেয়েটির তীব্র লড়াইয়ের কথা বলে সুখবর দেন সব্যসাচী। ফের ফিরে আসার আভাস পায় জনতা। আশায় বুক বাঁধেন কোটি কোটি মানুষ। ফিরবেনই ঐন্দ্রিলা, এই প্রার্থনায় মশগুল হন সকলেই।
কিন্তু বেশিক্ষণ আর সুখবর রইল কই! ফিরে আসতে আসতেই হারিয়ে গেলেন ফিনিক্স।
ভেন্টিলেশনে আর নেই ঐন্দ্রিলা। খানিকটা বিপদ কমেছে। সব্যসাচীর আশার কথার আবহে মেয়ের ভালো থাকার কথা জানিয়েছিলেন অভিনেত্রীর মা-ও।
কিন্তু আর হলো কই! কোনও লড়াই আর কাজে দিল না মেয়েটির জীবনে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের আক্রমণ নেমে এল অচিরেই। অকালেই চিরতরে বন্ধ হলো ঐন্দ্রিলার পার্থিব শরীরের চলাচল! আর তাঁর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিমর্ষ হলো বাংলা। শোকে মূহ্যমান তারকা-জগতের মাঝেই একযোগে বেদনায় ভরলেন নেটদুনিয়ার সাধারণ বাসিন্দারাও।