দিনে ২৫০ টাকার কাজ থেকে অস্কার! অবাক করবে লাপাতা লেডিজ-এর মঞ্জু মাইয়ের কাহিনি
Chhaya Kadam Laapataa Ladies Oscars: ২০১৮ সালে, শ্রীরাম রাঘবনের সিনেমা অন্ধাধুনে অভিনয় করেন ছায়া। ২০২২ সালে ঝুন্ড সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী রঞ্জনার চরিত্রে অভিনয় করেন।
অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে কিরণ রাওয়ের 'লাপাতা লেডিজ'। অপরিচিত মুখের ভিড় সিনেমায়। অথচ কঠিন সত্যকে সহজে বলার ক্যারিশ্মা ভরপুর। এই অপরিচিত মুখের ভিড়েই ছিলেন ছায়া কদম। ২০ বছর আগে যে ছায়া টানা কয়েক মাস বাড়ি থেকেই বের হননি, সেই ছায়া নজর কেড়েছেন লাপাতা লেডিজ সিনেমায়। সিনেমার মতো জীবন হয় কিনা জানা নেই, তবে অনেকের জীবন সিনেমার মতোই। ছায়া তাঁদেরই একজন। ২০০১ সালে বাবা এবং ভাই দুজনেই পর পর মারা যান। এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচার, এই অসহায়তা থেকে পালানোর পথ খুঁজছিলেন তিনি। হঠাৎ চোখে পড়ে একটি বিজ্ঞাপন। অভিনয়ের কর্মশালার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে কাগজে। ওই একটি বিজ্ঞাপন, ওই একটি সিদ্ধান্ত ছায়া কদমের জীবনকে চিরতরে বদলে দেয়।
কাট টু ২০২৪। ছায়া কদম বড় পর্দায়, ছোট পর্দায়, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে, সবখানেই উপস্থিত। লাপাতা লেডিজ-এ তাঁর অভিনয়ের তারিফ করছেন বিশ্বের তাবড় চলচ্চিত্র সমালোচকরা। সেরা আন্তর্জাতিক ফিচার ফিল্ম বিভাগে ২০২৫ সালের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে তাঁর অভিনীত ছবিই মনোনীত হয়েছে। অথচ, কে জানত কাবাডি খেলতে চাওয়া, পুলিশ হতে চাওয়া মুম্বইয়ের শহরতলির এই কন্যা একদিন বিশ্বজয় করবে!
আরও পড়ুন- কার্গিল যুদ্ধে লড়েছিলেন নানা পাটেকর! অবাক করবে অভিনেতার এই অজানা কাহিনি
লাপাতা লেডিজ সিনেমায় ছায়া কদম মঞ্জু মাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। একজন স্বাধীনচেতা চা স্টলের মালিক মঞ্জু মাই। এমন এক চরিত্রের মহিলা যিনি একই সঙ্গে কঠোর আবার তীব্র সহানুভূতিশীলও। যেমন হয় আর পাঁচটা সাধারণ ভারতীয় পরিবারে, সংসারের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করা মঞ্জু মাই অত্যাচারী স্বামীর মার খেতে খেতে, বিশ্বাসঘাতকতার ঘা খেতে খেতে কঠিন কঠোর হয়ে যান। এই কঠিন অথচ গভীর সংবেদনশীল মঞ্জুই ফুলকে এবং দর্শকদেরও আত্মনির্ভরতার শক্তি অর্জনের সাহস জোগান।
মুম্বইয়ের শহরতলি কালিনায় জন্ম ছায়ার। সেখানেই বেড়ে ওঠা। খেটে খাওয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছায়া কিন্তু শুরুর দিকে পেশাগতভাবে কাবাডি খেলার স্বপ্নই দেখতেন। রাজ্যস্তরেও খেলেছিলেন তিনি। পরে জিম খোলার বা পুলিশে যোগদানের কথা ভেবেছিলেন। অভিনয়ের কথা জীবনেও ভাবেননি ছায়া কদম। বছরের পর বছর সংসার চালাতে অদ্ভুত সব কাজ করে গেছেন ছায়া। তারপরে মারাঠি থিয়েটারের জগতে আসেন তিনি। তবে কদমের প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তির আলো দেখেনি। প্রথম বলিউড সিনেমাতেও তাঁকে দেখা গেছিল মাত্র একটি দৃশ্যে।
তবুও, প্রতিটি ছোট ছোট সুযোগ যেন ছায়াকে আরও ঘষে মেজে তৈরি করে দিয়েছিল। শুরুর দিকে ছায়া কদম দূরদর্শনে একটি কাজের জন্য একজন পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কিন্তু তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয় কাস্টিং ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। অভিনয়ের বদলে ছায়াকে পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ছায়া তাতে রাজিও হয়ে যান। কিন্তু মূল অভিনেতা কাজটা করতে চাননি শেষ অবধি। তখন ছায়াকেই ওই ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়ে। ছায়া বুঝেছিলেন, এই সেই সময়। এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করেছিলেন তিনি। সুযোগের সঠিক ব্যবহার করেছিলেন ছায়া।
তবে নানা চরিত্রের পরেও মনে একটা প্রশ্ন খচখচ করেই যেত। আদৌ কি তিনি "অভিনেত্রীর মতো দেখতে"! মুখই যেখানে মূল পণ্য, বিশেষ করে রুপোলি পর্দার জগতে, যেখানে চেহারা দিয়েই যোগ্যতা মাপা হয়, পরিচিতি দিয়েই কাজ পাওয়া যায় এবং ইংরেজি বলতে পারাকেই সাফল্য ভাবা হয় সেখানে মাথায় কোনও হাত না থাকা, ইন্ডাস্ট্রিতে 'গডফাদার', ‘গডমাদার' না থাকা ছায়া সেখানে নিজের জমি তৈরি করবেন কীভাবে? ছায়া নিজের জীবন শুরু করেছিলেন প্রতিদিন ২৫০ টাকায় কাজ দিয়ে। নিজের চারপাশের প্রত্যেককে তাঁর মনে হতো ছায়ার চেয়ে ঢের কম বয়সি, ঢের স্মার্ট এবং ঢের পরিচিতি থাকা মানুষ। তিনিই যেন বেমানান। তবে এই ভাবনাকে জাঁকিয়ে বসতে দেননি ছায়া। কাজ করে গেছেন একের পর এক।
আরও পড়ুন- রুপোলি পর্দায় ‘বিদ্যাসাগর’ তিনিই, অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে কি ভুলেছে বাঙালি?
প্রথম সাফল্য ২০১৩ সালে ফ্যান্ড্রি দিয়ে। নানির চরিত্রে চমকপ্রদ অভিনয় ছিল অসীম শক্তিশালী। জাতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন মহিলার ভূমিকায় তাঁর অভিনয় সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপরে, সাইরাত এবং ন্যুডের মতো মারাঠি সিনেমায় অবিস্মরণীয় ভূমিকায় অভিনয় করেন ছায়া।
২০১৮ সালে, শ্রীরাম রাঘবনের সিনেমা অন্ধাধুনেও অভিনয় করেন ছায়া। ২০২২ সালে ঝুন্ড সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী রঞ্জনার চরিত্রে অভিনয় করেন ছায়া। যে ছায়া ২০০১ সালে অভিনয় কর্মশালায় গিয়ে প্রথম বুঝেছিলেন তিনি আসলে জীবনে কী চান, সেই ছায়া ২৩ বছর পর ২০২৪ সালের মে মাসে কানস চলচিত্র উৎসবে দু'বার পর্দায় হাজির হলেন। একবার পায়েল কাপাডিয়ার অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট সিনেমার জন্য, যেটি গ্র্যাঁ প্রি পুরস্কার জেতে, এবং অন্যটি করণ কান্ধারীর সিস্টার মিডনাইট সিনেমার জন্য।
কাবাডি, জিম, পুলিশের চাকরির ঘেরাটোপের থেকে অনেকখানি ঊর্ধ্বে এখন ছায়া। তবে এই সাফল্য রাতারাতি আসার নয়, আসেওনি। যা চেয়েছেন তা অর্জনের জন্য তাঁকে যে অন্যদের চেয়ে অনেক কঠোর পরিশ্রম করতে হতে পারে এই সত্যটা ছায়া জানতেন। আর সেই পরিশ্রমের জন্য প্রস্তুতও ছিলেন তিনি। মুম্বইয়ের অন্ধকার গলিতে হারিয়ে যায়নি তাঁর স্বপ্ন, লাপাতা হয়ে যায়নি তাঁর লড়াই।