জোর করে ঠোঁটে চুমু খান নায়ক, বাধ্য হতে হয় নগ্ন চরিত্রে, কানন দেবী এক অজানা 'বনফুল'

Kanan Debi: অভিভাবকহীন নিচু ঘরের মেয়ে হওয়ায় তাঁকে টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে নগ্ন দৃশ্যে বাধ্য করা হয়। এ রকম একটি ছবি হলো ‘বাসবদত্তা’।

১৯২৬ সালে যখন 'জয়দেব' মুক্তি পেল, সেই বছরই ওয়ার্নার ব্রাদার্স পৃথিবীর প্রথম টকি বা সবাক ছবি আনল বাজারে। ‘ডন জুয়ান’। সবাক, তবে কোনও সংলাপ নেই, কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতে মোড়া। মাত্র দশ বছর বয়সে ‘জয়দেব’-এ রাধা চরিত্রে অভিনয় করে পুরস্কার স্বরূপ পাঁচ টাকা সম্মানী পান কানন বালা দাস। তিনি ছিলেন একজন রক্ষিতার সন্তান। তাঁর বাবার নাম রতনচন্দ্র দাস। জন্মের পরপরই তিনি বাবাকে হারান। বড় হয়ে জানতে পারেন, বাবা তাঁর মাকে বিয়েই করেনি। তাঁর বাবা ছিলেন সওদাগর অফিসের একজন ছোট কেরানি। তাঁর একটি ছোট দোকানও ছিল। কাননের মা তখন তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে এক দুরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে রাঁধুনি ও ঝিয়ের কাজ নেন। দারিদ্রের কারণে কানন দেবী মাত্র বারো বছর বয়সে ম্যাডানের স্টুডিওতে হাজির হন অভিনয় করতে। ‘জয়দেব’-এর পর আরেকটা ছোট্ট রোল পেয়েছিলেন কানন ‘শঙ্করাচার্য’ (১৯২৭) ছবিতে, গোড়ায় যার পরিচালনায় ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ডিজি। মধ্যিখানে ডিজি কাজ ছেড়ে চলে গেলে তড়িঘড়ি ছবি শেষ করেছিলেন কালিকাপ্রসাদ ঘোষ। ছবিও তড়িঘড়ি পাততাড়ি গুটিয়েছিল হল থেকে। কাননের কপালেও পুরো পারিশ্রমিক জোটেনি। এর পর তো টানা বেশ কয়েক বছর হাতে কাজ নেই। কাজে ফিরতে ফিরতে পেরিয়ে গেল অনেকগুলো বছর।

কানন দেবী ছিলেন সমাজের নিচুতলা থেকে উঠে আসা শেষ বড় অভিনেত্রী। অভাবের কারণে কিশোর বয়স থেকেই তাঁকে পর্দায় পরিচালকের ইচ্ছে মতো চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে। নায়ক ও পরিচালকের লোলুপতার শিকার হতে হয়েছে। ১৯৩১ সালের ছবি ‘জোর বরাত’-এ একটি দৃশ্যে নায়ক তাঁকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খান— যা তাঁকে অপমানিত ও ব্যথিত করে। পরিচালকের নির্দেশেই নায়ক এই কাজ করেন তাঁকে আগে না জানিয়েই। অভিভাবকহীন নিচু ঘরের মেয়ে হওয়ায় তাঁকে টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে নগ্ন দৃশ্যে বাধ্য করা হয়। এ রকম একটি ছবি হলো ‘বাসবদত্তা’। এ ছবিতে তাঁর অনিচ্ছায় নগ্নতার প্রদর্শন ছিল। সম্ভবত সেই কারণে এই ছবি সফল হয়নি। এছাড়া পরিচালকেরা তাঁর অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে টাকা পয়সার ব্যাপারেও ঠকাতেন। কানন দেবীর সত্যিকারের অভিনয় জীবন শুরু হয় ত্রিশের দশকে। ১৯৩১ সালে থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত কানন দেবী ছিলেন নায়িকা-গায়িকা। ১৯৩১ সালে পূর্ণাঙ্গ সবাক চলচ্চিত্র ‘জোর বরাত’-এ নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৩৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ তাঁকে প্রতিষ্ঠা দেয় চলচ্চিত্র জগতে। ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে চলার সময় কাননদেবীর অভিনয় দেখতে বহু তরুণ পাগলের মতো ছুটে যেতেন সিনেমার পর্দায় তাঁকে স্পর্শ করতে।

আরও পড়ুন- গান প্রতি ১৫ টাকা! গানের চাবুকে বলিউড শাসন করেছিলেন সামসেদ বেগম

বড়ুয়া সাহেব হাওড়ার দাসবাড়ির এই মেয়েটিকে দেখেছিলেন 'মানময়ী গার্লস স্কুল' সিনেমায়। দেখেই বোঝেন, তাঁর দেবদাস ছবির জন্য এর থেকে ভালো পার্বতী আর পাবেন না। কিন্তু রাধা স্টুডিও বেঁকে বসল। তাদের সঙ্গে কাননের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়নি তখনও। ফলে বেচারির প্রবল ইচ্ছে থাকলেও তাঁকে নেওয়া গেল না। হাল ছাড়লেন না প্রমথেশ বড়ুয়া। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে নিউ থিয়েটার্সে নিয়ে এলেন। এক সঙ্গে দু'টি সিনেমার কাজ শুরু হলো। 'বিদ্যাপতি' আর 'মুক্তি'। এই 'মুক্তি' সিনেমাতেই কাননের গানের শিক্ষক ছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। তিনি বললেন "আজ তোমায় এমন একখানি গান শোনাব যা তোমার সারা জীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে।" কাননের গলায় গাওয়া মুক্তি ছবির সেই গান "আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে" মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। অবাঙালিরাও নাকি এই গানটি গাইতেন। প্রায় সমান জনপ্রিয় হয়েছিল 'তাঁর বিদায়বেলার মালাখানি' গানটিও। ১৯৩৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মুক্তি’ চলচ্চিত্রটি তাঁকে প্রথম খ্যাতি এনে দেয়।

পরের বছর, ১৯৩৮-এ দেবকী বসু পরিচালিত 'বিদ্যাপতি' মুক্তি পেল। রাতারাতি স্টার! ৪০-এর দশকের ‘পরিচয়’ এবং ‘শেষ উত্তর’ ছবির জন্য তিনি পরপর দু’বার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘মেঘ নগরের অন্ধকারে’ এবং ‘কেন অকারণে...’ অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। ‘স্ট্রিট সিঙ্গার (১৯৩৮), সাথী (১৯৩৮), পরাজয় (১৯৪০), জওয়ানি কি রাত (১৯৪০), বিদ্যাপতি (১৯৩৮), সাপুড়ে (১৯৩৯) প্রভৃতি ছবিতে কানন দেবীর নাচ-গান-অভিনয় এক কথায় ছিল অনবদ্য। তাঁর শেষ ছবি ছিল ‘ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত ও অন্নদা দিদি’ (১৯৫৭)। বহু প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন কানন দেবী। অভিনয়, নাচ, গান— এই তিন প্রতিভাসহ অসংখ্য গুণের সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। বিজ্ঞাপনচিত্রেও দেখা যায় কানন দেবীকে। সব মিলিয়ে প্রায় ৭০টি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। কানন দেবী যেসব নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেন তাঁরা হলেন— জয় নারায়ণ, হীরেন বসু, জহর গাঙ্গুলি, ধীরাজ ভট্টাচার্য, জাল মার্চেন্ট, প্রমথেশ বড়ুয়া, কুন্দন লাল সায়গল, পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, নওয়াব নাজাম, পরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধামোহন ভট্টাচার্য, বিকাশ রায়, কমল মিত্র, অশোক কুমার প্রমুখ।

১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কানন দেবীর জন্য সবচেয়ে বেশি খ্যাতির সময় ছিল। তিনি এই সময় কানন বালা থেকে সম্ভ্রান্ত কানন দেবীতে পরিণত হন। তিনি তখন রোমান্টিক নায়িকার বদলে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকাতেই বেশি অভিনয় করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি শ্রীমতি পিকচার্স গড়ে তোলেন যার বেশির ভাগ ছবিই ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে। এই কোম্পানির ছবিতে তিনি কেবল অভিনয় ও প্রযোজনাই করেননি, তিনি পরিচালনাও করেন। তাঁর ছবির পরিচালকের একটি তিন সদস্য বিশিষ্ট দল ছিল যার নাম— সব্যসাচী। তিনি তিন জনের একজন ছিলেন।

আরও পড়ুন- চারশো টাকা না পেলে হাসপাতাল থেকে ফিরত না স্ত্রী! যেভাবে আমজাদ খান হলেন গব্বর সিং

সিনেমার বাইরেও তাঁর গানের রেকর্ড ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। ওস্তাদ আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষা নেন কানন। এছাড়াও তিনি ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম, অনাদি দস্তিদার ও পঙ্কজ মল্লিকের কাছেও তালিম নেন। কানন দেবী ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি ও আধুনিক গানের সফল গায়িকা। তাঁর কণ্ঠে ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ এবং নজরুল সঙ্গীত ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো’ এই গান দু’টি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

১৯৪০ সালের ডিসেম্বরে হেরম্ব মৈত্রের ছেলে অশোকের সঙ্গে কাননের বিয়ে হয়। এ বিয়ে বেশি দিন না টিকলেও কানন দেবীর দ্বিতীয় বিয়ে সুখের হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে 'মেজদিদি' করার সময় নেভাল এডিসি হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কানন দেবীর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’ এক প্রামাণ্য দলিল। সেখানে কানন দেবী লিখছেন, ‘‘যখন হরিদাস ভট্টাচার্যকে বিয়ে করি তখন লোকের ধারণা ছিল এ বিয়ে পনেরো দিন টিকলে হয়। সেই বিয়েই তো চব্বিশ বছর টিকে গেল।’’ ১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে হরিদাস ও কানন জোড়ে গিয়েছিলেন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে। কানন দেবী সে দিন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার নিলেন। ১৯৮৭ সালের এক দিন ওঁর টাকাপয়সা, কাগজপত্র, শখের পিস্তল ও রিভলভার গুছিয়ে হরিদাস ওঁদের ১নং রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। কিছু দিনের মধ্যে কানন দেবীও ১৭ জুলাই, ১৯৯২-এ বেল ভিউ ক্লিনিকের এক নির্জন কেবিনে শুয়ে সংসার ত্যাগ করলেন।

More Articles