পাইস হোটেলের সংস্কৃতিকে অমর করেছিলেন বিভূতিভূষণ, আজও কি রয়েছে সেই হোটেল?

Adarsha Hindu Hotel Ranaghat : এর মধ্যে কোনটা আসল? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ণিত সেই পাইস হোটেলটি কি সত্যিই রয়েছে?

‘হাজারি চক্রবর্তীর হিন্দু হোটেল
রানাঘাট
ভদ্রলোকদের সস্তায় আহার ও বিশ্রামের স্থান।
আসুন! দেখুন! পরীক্ষা করুন!’

এরকমই একটি স্বপ্ন দেখত হাজারি ঠাকুর। রান্না করা তাঁর কাছে সব, তাঁর জীবন। সবসময় তাঁর চোখে স্বপ্ন, একদিন নিজেরও একটি হোটেল হবে। যে সে হোটেল নয়, পাইস হোটেল। সেখানে এসে মানুষ একটু বসবে, জিরোবে। একটু গল্প হবে। তারপর পেট ভরে খেয়ে চলে যাবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন কি সফল হবে কখনও? হাজারি ঠাকুর সামান্য এক রান্নার পাচক। রান্না করাই তাঁর কাজ। আর এটাই তাঁর শিল্প। তিনি এই মাঠের শিল্পী। তাঁর হাতের জাদুতে রান্নার স্বাদ অমৃত হয়ে যায়। কিন্তু বয়স বাড়ছে তাঁর। সেইসঙ্গে স্বীকৃতির অভাব। মালিক থেকে ঝি, সবাই তাঁর ওপর ছড়ি ঘোরায়।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। সেখানেই উঠে এসেছে এই হাজারি ঠাকুরের গল্প। কেবল কি হাজারি ঠাকুর? উঠে এসেছে মফস্বলের জীবন, সেইসঙ্গে রয়েছে পাইস হোটেল। বাংলার চিরন্তন এক ঐতিহ্য। আজকের বাহারি রেস্তোরাঁ, হোটেলের মতো অত্যাধুনিক, ঝাঁ চকচকে নয় ঠিকই। কিন্তু কলকাতা সহ গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই পাইস হোটেলগুলিই একটা সময় সাধারণ মানুষের পেট ভরিয়েছে। আজও অনেকের ঠিকানা এই হোটেলগুলি। হাজারি ঠাকুর, পদ্ম ঝি দের হাত ধরে সেই সংস্কৃতিটাই সামনে এনেছেন কালজয়ী লেখক বিভূতিভূষণ।

আরও পড়ুন : রুটির দোকানের হেল্পার ছিলেন নন্দিনীর বাবা, মেয়ের কাঁধে ভর দিয়েই উড়ান দিচ্ছে পাইস হোটেল

‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর প্রভাব কেবল বাংলার সাহিত্যে নয়, সমাজেও। এই একই নামের অনেক হোটেলই পরবর্তীকালে চালু হয়েছে। বাংলা জুড়ে অজস্র ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর মধ্যে কোনটা আসল? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ণিত সেই পাইস হোটেলটি কি সত্যিই রয়েছে? অজস্র হোটেলের ভিড়ে আজ, এই ২০২৩-এ দাঁড়িয়ে প্রায় হারিয়েই গিয়েছে সেই হোটেলটি। হ্যাঁ, বিভূতিভূষণের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ আজও অক্ষত রয়েছে। কিন্তু সেটা কলকাতায় নয়, তার জন্য ট্রেন কিংবা গাড়ি ধরে পাড়ি দিতে হবে রানাঘাট।

রানাঘাট স্টেশন থেকে বেরিয়েই চোখে পড়বে সেই আস্তানা। হোর্ডিংয়ে বড় বড় করে লেখা ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। আদ্যোপান্ত বাঙালি পাইস হোটেলটি তার নিজস্ব চরিত্র নিয়ে আজও টিকে রয়েছে। আর তার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বাংলা সাহিত্য। ১৯৬২ সালে গোপীনাথ কুণ্ডু এই পাইস হোটেলটি শুরু করেছিলেন। যে বাড়িতে এই হোটেলটি, সেখানে একসময় থাকতেন বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। ইনি সম্পর্কে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মীয়। এছাড়াও রানাঘাট শহরে বিভিন্ন পত্রিকা, কবি-লেখকদের বসবাস ছিল। সেজন্য এই এলাকায় প্রায়ই আসতেন বিভূতিভূষণ। সেই সময়ই হয়তো এই উপন্যাসটি লেখার ভাবনা তাঁর মাথায় এসেছিল।

আরও পড়ুন :  জলের দরে ‘পেটচুক্তি’ খাওয়া, কলকাতার এই পাইস হোটেলগুলিতে জেগে স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প

উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় দুই দশক পর এই হোটেলটি তৈরি হয়। তাহলে কি উপন্যাসের গল্পটি বাস্তবেও হয়েছিল? ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ও কি কোনও বাস্তবের ‘হাজারি ঠাকুর’-এর স্বপ্ন ছিল? বিভূতিভূষণ কি সেই স্বপ্নের কথা জানতেন? নামের আড়ালেই হারিয়ে গিয়েছে সেই ইতিহাস। এরকম আরও অজস্র আদর্শ হিন্দু হোটেলের গল্প ছড়িয়ে রয়েছে এই বাংলায়। খুঁজলে হয়তো বাংলার বাইরেও অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। সবার মূল লক্ষ্য যে একই, সুস্বাদু খাবার তৈরি করে মানুষের উদরপূর্তি করানো। পাইস হোটেলের চিরন্তন সংস্কৃতি…

২০২২-র শেষের দিকে কলকাতায় এক যুবতী অত্যন্ত ভাইরাল হন। তিনি নন্দিনী গাঙ্গুলি। ব্যস্ততম শহরের রাস্তার ধারে ছোট্ট খাবারের গুমটি তাঁর। বাবাকে কাজে সাহায্য করার জন্য গুজরাতের ভালো চাকরি ছেড়ে তিনি এখানে চলে এসেছেন। হোটেল ঠিক নয়; কিন্তু পাইস হোটেলের আদবকায়দা সেখানে প্রবলভাবে বিদ্যমান। ভাত, লেবু-লঙ্কা, আলুভাতে, আলুভাজা, উচ্ছে ভাজা, মাছ, মাংস, ডাল – একেবারে সাধারণ বাঙালি পদ। অনেকেরই বক্তব্য, স্বাদও নাকি একেবারে ঘরোয়া, অসাধারণ। ‘নন্দিনী দির ভাতের হোটেল’ এখন নেট দুনিয়ায় ভাইরাল। সবাই সেখানে যাচ্ছেন, ভিডিও করছেন, খাচ্ছেন।

আরও পড়ুন : হাসিমুখে ভাতের থালা হাতে অফিস পাড়ার নন্দিনী, নিশ্চিন্ত চাকরি ছেড়ে কেন বেছে নিলেন এই পথ

এতকিছুর ভিড়ে দূরে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। ভাইরালের আবহাওয়ার আড়ালে তারা এখন নিঃসঙ্গ, একা। পাইস হোটেলের ইতিহাস এখন কেউ শুনতে চান না। ভাইরালও হয় না। হাজারি ঠাকুরের মতো স্বপ্ন দেখতে দেখতে হতাশা নেমে আসে। কখনও কি ‘ভাইরাল’ হবে তারা? ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর অঙ্গনে পা পড়বে নতুন প্রজন্মের? অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন হাজারি ঠাকুররা।

More Articles