এখন এই ছবি বানালে 'দেশদ্রোহী' তকমা পেতেন সত্যজিৎ! ফিরে দেখা 'দেবী'

সত্যজিৎ যদি সেই ছবি এই সময় দাঁড়িয়ে বানাতেন― হয়তো একইভাবে নয়, অন্য আঙ্গিকে, সমসময়ের ভঙ্গিতে― তাহলে হয়তো চরম সম্মানহানির স্বীকার হতেন। হয়তো তাঁকে 'দেশদ্রোহী' বলা হত।

 

৬২ বছর আগে মুক্তি পাওয়া একটি 'রাগী' বাংলা ছবি কি এখনও সমান মাত্রায় প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে পেরেছে? ধর্মান্ধতা, চাপিয়ে দেওয়া বিশ্বাসকে প্রশ্নাতীতভাবে স্বীকার করে নেওয়া ও কালেক্টিভ হিস্টেরিয়ার বিরুদ্ধে এক রাগী প্রতিবাদ ছিল সত্যজিৎ রায়ের 'দেবী' (১৯৬০)। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোট গল্প থেকে স্ক্রিনের পরিভাষাতে অ্যাডপ্ট করা এই ছবিটি সম্ভবত সত্যজিৎ রায়ের কেরিয়ারের সবথেকে বিতর্কিত ও সাহসী পদক্ষেপ।

'অপু ট্রিলজি'-র ইনোসেন্স এই ছবিতে নেই। 'পরশপাথর'-এর হাস্যরস এই ছবিতে পাওয়া যায় না। 'জলসাঘর'-এর সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার জাঁতাকল এই ছবিতে কিছুটা হলেও আছে। কিন্তু এর বাইরে আর যা আছে, তা হলো: ধর্মীয় গোঁড়ামির অচলায়তনের বিরুদ্ধে আঙুল উঁচিয়ে প্রতিবাদ জানানো। ধর্মীয় চরমপন্থা সাধারণ মানুষের জীবনকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি যেন এই সিনেমা।

গল্পের শুরু গ্রামবাংলায়, ১৮৬০ সালে। বিশাল এক জমিদার বংশের কর্তা কালীকিঙ্কর সারাদিন কালীমায়ের পুজোতে ব্যস্ত থাকে। তার দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে কাজকর্ম কিছু করে না, রাতের বেলা বেশিরভাগ দিন মদ খেয়ে ঘরে ঢোকে। তার বউ আর বছরসাতেকের এক বাচ্চা আছে। অন্যদিকে, ছোট ছেলে উমাপ্রসাদ কলকাতায় ইংরেজি নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, তার বউ বছর সতেরোর দয়াময়ী, যে সদ্য ফোটা ফুলের মতোই নিষ্পাপ, আঘাতপ্রবণ। কালীকিঙ্করের কাছে দয়াময়ী মায়ের প্রতিরূপ, যেদিন থেকে দয়াময়ী এই বাড়িতে এসেছে, সেদিন থেকে দুঃখ, হতাশা সব দূর হয়ে গেছে তাদের জীবন থেকে। অথচ, এই কালীকিঙ্করই এক রাতে স্বপ্নে দয়াময়ীকে কালীমায়ের রূপে দেখেন। স্বপ্ন ভাঙে, কালীকিঙ্করের বদ্ধ ধারণা চেপে বসে যে, দয়াময়ীই ঈশ্বর। শুরু হয় মানুষের মধ্যে দেবত্ব আরোপের কুটিল খেলা।

আরও পড়ুন: ‘জীবনের নোংরা দিকটা আমার ছবিতে যথেষ্ট উঠে এসেছে’: সত্যজিৎ রায়

না, দয়াময়ী দেবী নয়। কোনও অমানবিক বা অতি-মানবিক ক্ষমতা তার ছিল না। কালীকিঙ্করের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, চরমপন্থী ভক্তিবাদ এই আধিদৈবিক গুজবের সূচনা করে।

Devi Scene

ছবির দৃশ্যে বাঁদিক থেকে ছবি বিশ্বাস, পুর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুর

আমাদের সমাজের যে আদি ও অকৃত্রিম কাঠামো, যা সেই যুগেও বজায় ছিল এবং এখনও আছে― সংসারে নারী ও পুরুষ, পুরুষের আধিপত্য, নারীর বশ্যতা, সময়বিশেষে নারীর মধ্যে দেবত্ব আরোপ, ত্রাতা হিসাবে নারীদের উপস্থাপিত করা, যে উপস্থাপনায় নারীদের ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক। মাটির মূর্তি তো মৌন, আজীবন মৌন থেকেছে, বরাবর থেকে যাবে― সে তো প্রতিবাদ করতে পারে না। অথচ, এই ছবিতে দয়াময়ীর মতো এক জ্যান্ত সত্তার ওপর দেবত্ব আরোপ, যা তার অনিচ্ছায়, সেখানে সে মানুষ হয়েও প্রতিবাদ জানাতে অক্ষম। কারণ, প্রতিবাদের ভাষাটা সে জানে না। কোনওদিন শেখেনি।

কখনও আমরা ভেবে দেখেছি কি, এই যে দেবীর জয়গান গাই আমরা বিভিন্ন পার্বণ-উৎসবে― যে দেবী, সে কি আদৌ দেবী হতে চেয়েছিল?

কালীকিঙ্কর তাই স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে দেবীরূপী দয়াময়ী অথবা দয়াময়ীরূপী দেবীকে দেখেন।

স্বপ্নতত্ত্ব নিয়ে অনেকরকম ব্যাখ্যা আছে। একটু যদি আমরা খুঁটিয়ে দেখি ছবিটা, দেখা যাবে, সিনেমার প্রথম থেকে পুত্রবধূকে মা বলে সম্বোধন করা, স্বপ্নে অমন অদ্ভুত ব্যাপার দেখা ও সেই স্বপ্নকে সত্য বলে মেনে নেওয়া― এখানে ইডিপাস কমপ্লেক্সের ছোঁয়া থাকলেও থাকতে পারে। বা কোনওরকম অন্তঃসলিলা যৌন প্রক্রিয়া? দেবীত্ব এখানে তাহলে কীসের প্রতীক?

Soumitra-Sharmila in Devi

ছবির দৃশ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুর

একষট্টি বছর পর এই চলচ্চিত্র অনেক প্রশ্ন তুলে যায়। কেবলই হিন্দু ধর্মান্ধতাকে নয়, এর বাইরেও জটিল মানসিকতার বিভিন্ন স্তরকে উন্মোচন করে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৬০ সালে নির্মিত এই ছবি সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। তৎকালীন সমালোচকরা সত্যজিৎকে হিন্দু ধর্মর বিপক্ষে ছবি বানিয়েছেন বলে কটাক্ষ করতে পর্যন্ত ছাড়েনি। নিজে যেহেতু ব্রাহ্ম, তাই তিনি হিন্দু ধর্মর কিচ্ছু বোঝেন না, এই মর্মে কথা বলেছিল সকলে। এই ছবি সেই সময়ে ব্যান হয়নি বা সত্যজিতের কোনওরকম হেনস্থাও হয়নি। সেই সত্যজিৎ যদি সেই ছবি এই সময় দাঁড়িয়ে বানাতেন― হয়তো একইভাবে নয়, অন্য আঙ্গিকে, সমসময়ের ভঙ্গিতে― তাহলে হয়তো চরম সম্মানহানির স্বীকার হতেন। হয়তো তাঁকে 'দেশদ্রোহী' বলা হত। কিন্তু ১৯৬০ সালে বানানো এই ছবিতে তোলা প্রশ্নগুলো কিন্তু পুরনো হবে না বা বদলেও যাবে না। সমাজেরই বানানো এই খাঁচায় কালীকিঙ্কর, উমাপ্রসাদ ও দয়াময়ী, প্রত্যেকেই বন্দি। কালীকিঙ্কর নিজের মনোবিকলনকে স্বীকৃতি জানাতে পারেন না। উমাপ্রসাদ এত বিদ্বান হওয়া সত্ত্বেও সময়মতো উচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। দয়াময়ী ফুলের মতো নিষ্পাপ হলেও প্রতিবাদ জানাতে অপারগ।

এদের এই স্খলনের জন্য কে বা কারা দায়ী? একা কালীকিঙ্কর কি দোষী? না কি উমাপ্রসাদের মতো দ্বিধাগ্রস্ত লিবারালরা? না কি প্রতিবাদের ভাষা না শেখা দয়াময়ী বা আরও সহস্র নারীরা? না কি আরও বড় 'সিনিস্টার' কিছু, অশুভ, 'ইভিল'― যা আমরা দেখতে পাই না, অথচ যুগের পর যুগ ধরে যা আমাদের সত্তাকে পরিচালিত করে চলেছে?

Devi Poster

'দেবী'-র পোস্টার। শিল্পী: সত্যজিৎ রায়

'দেবী' তাই আমার কাছে রাগী প্রতিবাদের থেকেও অনেক বেশি কিছু। এই ছবি আমার কাছে ভয়ের, আতঙ্কের।

ছবির শেষে দয়াময়ী উন্মাদ হয়ে যায়। দেবতায় রূপান্তরের উগ্রপন্থা দয়াময়ীকে পাগল বানিয়ে ফেলে। ক্লাইম্যাক্সে দিগন্তে দয়াময়ীর কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যাওয়া― দেবীর বিসর্জন যেন। ছবিটা সেখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু শেষ হয় দেবী দুর্গার চোখহীন, অবয়বহীন সাদা একটা মুখ দিয়ে। যে মুখ দিয়ে ছবির শুরুও হয়েছিল। জীবনের সাইকেল যেন। দেবতার জন্ম হয়, মৃত্যু হয়, একই চক্র আবার পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। কোনও সমাধান নেই। যুগের পর যুগ ধরে পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে।

আচ্ছা, একেই কি 'অলৌকিক' বলে?

 

More Articles