স্বাধীনতা অলীক স্বপ্ন, তালিবানের অধীনে যেভাবে দিন কাটে আফগানিস্তানের মেয়েদের
Afganistan Crisis: মাথার উপর ঠেকানো রয়েছে বন্দুকের নল। শিক্ষা বন্ধ, স্বাধীনতার গন্ধ তো এদ্দিনে ভুলেছে দেশবাসী। এবার আফগানিস্তানে জারি নয়া নিষেধাজ্ঞা।
"রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানি, রানির দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।" কবি নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন এ কথা। কোনও একটি জাতির উন্নতির সূচক শুধুমাত্র পুরুষের শিক্ষা দ্বারা চিহ্নিত হতে পারে না। বিবেকানন্দও বলেছিলেন একই কথা। সংসারের একটি মেয়েকে যদি শিক্ষিত করা যায়, তাহলে গোটা সংসার, গোটা সমাজকে শিক্ষিত করা সম্ভব। যুগ যুগ ধরে নারী স্বাধীনতার পক্ষেই সওয়াল হয়ে এসেছে, অন্তত সভ্য সমাজে তেমনটাই হওয়া কাম্য। তাতে পরিস্থিতি পুরোটা না বদলালেও কিছু বদল তো এসেইছে। তবে তালিবান আছে তালিবানেই।
তাদের কাছে বাঘ-সিংহের মতোই ভয়ঙ্কর নারী স্বাধীনতা। কারণটা সম্ভবত আন্দাজ করা কঠিন হয় না। শিক্ষিত সুস্থ সমাজে কখনওই তালিবানি শাসন কায়েম হতে পারে না। তাই হীরক রাজার মতোই তারা বলে ওঠে, 'এরা যত বেশি পড়ে যত বেশি জানে, তত কম মানে।' অতএব দাও জানলা-দরজা সব বন্ধ করে। যাতে একফোঁটাও আলো না আসতে পারে। শুধু শিক্ষায় মারলে চলবে কেন! মেয়েদের ছুঁড়ে ফেলে দাও এমন অন্ধকারে, যেখানে কোনও স্বর না পৌঁছয়। এমনকী মেয়েদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হোক সুন্দর থাকার অধিকারটুকুও। কারণ ওই যে একজন নারীর কাছে আলো পৌঁছে যাওয়া মানে তা ক্রমে ছড়িয়ে পড়বে গোটা সমাজ, দেশে। মালালার মতো আরও অনেক মেয়ে চোখে চোখ রেখে সওয়াল করার সাহস করবে। এমনকী গুলিতে মাথার ঘিলু ছিটকে পড়লেও থামবে না প্রশ্ন। তাই আলো আসা বন্ধ হোক সবার আগে।
আরও পড়ুন: বাদ গেল না ম্যানিকুইনও! তালিবান শাসনে প্লাস্টিকে মাথা ঢাকার নির্দেশ মেয়ে পুতুলদের
না, এ কোনও বানিয়ে তোলা কথামালা নয়। আফগানিস্তানের ছবিটা এর থেকেও শোচনীয়। যবে থেকে তালিবান দখল নিয়েছে দেশ, তখন থেকেই দুরবস্থার শেষ নেই বাসিন্দাদের। মাথার উপর ঠেকানো রয়েছে বন্দুকের নল। শিক্ষা বন্ধ, স্বাধীনতার গন্ধ তো এদ্দিনে ভুলেছে দেশবাসী। এবার জারি নয়া নিষেধাজ্ঞা। সে দেশের মেয়েদের বিউটি স্যালো বা পার্লার ব্যবহারের উপরে টানা হল রোখ। মেয়েদের শুধুমাত্র যৌনদাসী ভাবা একটা দল বা গোষ্ঠীর থেকে আর কী-ই বা প্রত্যাশা করা যায়।
ইতিমধ্যেই রাস্তাঘাটে পার্লারে হোডিংয়ে পোস্টারে যত মেয়েদের মুখ ছিল, সেসব কিছু কালো কালি লেপেছে তালিবান। তাতেও শান্তি হয়নি। কাবুল-সহ গোটা দেশ জুড়ে সম্প্রতি নয়া নির্দেশিকা জারি করেছে তালিবান সরকারের অসৎ ও সদগুণ (ভাইস অ্যান্ড ভার্চু) মন্ত্রক। হ্যাঁ, এমন মন্ত্রক তালিবান শাসনেই সম্ভব। ইতিমধ্যেই এই মর্মে কাবুলের সমস্ত মহিলা বিউটি পার্লারদের লাইসেন্স বাতিল করার নির্দেশ এসেছে। ইতিমধ্যেই মেয়েদের শিক্ষা ও বাইরে চাকরি করার উপরে জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এবার সাজগোজের উপরও বসল কড়াকড়ি। আসলে প্রসাধন মানে তো শুধুই বহিরঙ্গের সাজগোজ নয়। নিজেকে সুন্দর করে তোলার মধ্যে দিয়েও তো অনেকটা আত্মবিশ্বাসী অনুভব করার সুযোগ থাকে। সেই জায়গাটাকেও নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করছে তালিবান।
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নেয় আমেরিকা ও ন্যাটো। আর তার পরেই আফগানিস্তানের দখল নেয় তালিবান। তার পর থেকেই শুরু হয়েছে নানা ধরনের অত্যাচার। ইতিমধ্যেই আরোপ হয়েছে একাধিক নিষেধাজ্ঞা। তার মধ্যেই নয়া সংযোজন এই নির্দেশ। ভাইস অ্যান্ড ভার্চু মন্ত্রক থেকে জারি করা চিঠিতে জানানো হয়েছে, গত ২৪ জুন তালিবানের সর্বোচ্চ নেতা হায়বাতুল্লাহ আখুনজাদা মৌখিক ভাবে এই নির্দেশ জারি করেন। কাবুল ও আফগানিস্তানের সব কটি প্রদেশেই নয়া হুকুম বলবৎ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক মাসের মধ্যে সমস্ত পার্লারের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে বলেও জানানো হয়েছে।
কেন এমন সিদ্ধান্ত, সে ব্যাপারে অবশ্য খোলসা করে কিছু জানানো হয়নি। জানানোর কথাও না। তালিবানরা আর কবেই বা কোনও দেশের বাসিন্দাদের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছে। তা-ও আবার দখল করা দেশ। ঔপনিবেশিক দেশের উপর অত্যাচার, জুলুম করাটাই তো দস্তুর। সেখানে তালিবানরা তো শুধু ধর্মীয় ভাবে চরমপন্থীই নয়, তাদের হয়ে কথা বলে বন্দুকই। তালিবানের এমন নির্দেশে মাথায় হাত বিউটি পার্লার মালিকদের। এমন স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তে তাঁদের রুজিরুটি নিয়ে টানাটানি পড়ে গিয়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন মেকআপ শিল্পী থেকে শুরু করে অনেকেই। কীভাবে তাঁরা সংসার টানবেন, তা-ই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
নব্বই দশকের শেষ দিকে ভয়াবহ ভাবে আফগানিস্তান শাসন করেছিল তালিবান। বাসিন্দাদের নানা ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে সেই জমানায়। এ নিয়ে একাধিক ডকুমেন্টশন রয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা থেকে সাংবাদিকদের অধিকার, সব কিছুই খর্ব হয়েছিল। শিক্ষা থেকে শুরু করে চাকরি, সব কিছুর উপরেই জারি হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি ছিল নারী ও শিশুদের। আমেরিকা ও ন্যাটোর হস্তক্ষেপে বেশ কিছুদিন স্বস্তিতে ছিল আফগানিস্তানবাসী। তবে সেই সুখ চিরস্থায়ী হল না। আমেরিকা সেনা প্রত্যাহার করে নিতেই ফের রাষ্ট্রের দখল নিল তালিবান। শুরু হল ফের অত্যাচার, কষ্টের দিন।
যদিও সরকার গড়ার সময় তালিবান দাবি করেছিল, আগের তুলনায় অনেকটাই নরমভাবাপন্ন এবার তারা। দেশ শাসনের ক্ষেত্রেও সে ব্যাপারটি মাথায় রাখা হবে। তবে কোথায় কী! দু'দিন যেতে না যেতে আসল রূপে ফিরেছে তালিবান। ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়েছে নারীশিক্ষার অধিকার। কেড়ে নেওয়া হয়েছে সংবাদমাধ্যমে চাকরির স্বাধীনতা। মেয়েদের বাইরে কাজ করার ক্ষেত্রেও জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। পার্ক, জিম এসব জায়গাতেও অধিকার নেই মেয়েদের। পোশাক তো ছিলই, এবার তার সঙ্গে যোগ হল প্রসাধনও।
আরও পড়ুন: তালিবান শাসনে কেমন আছে আফগানিস্তানের মেয়েরা? জানলে শিউরে উঠতে হবে
এমনিতেই তালিবান শাসন জারি হওয়ার পরে ভেঙে পড়েছে আফগানিস্তানের অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক মঞ্চেও একঘরে হয়ে গিয়েছে কাবুল। স্বাভাবিক ভাবেই দুঃসহ অবস্থা বাসিন্দাদের। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদের উপায় নেই। বাইরে থেকেও সাহায্য আসার অবকাশ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, যতটা খবর বাইরে আসছে, যতটুকু জানা যাচ্ছে, তার চেয়েও যে খারাপ অবস্থায় বাসিন্দারা রয়েছেন, তা তালিবানি জমানায় আঁচ করাই যায়। মেয়েদের এই পরাধীনতার নিগড় গোটা সমাজ, গোটা দেশটাকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরও আরও পিছনে, আরও অন্ধকারে। কবে মিলবে স্বাধীনতা, কবে আসবে স্বস্তির ঘুম, উত্তরটা বোধহয় সময়ের কাছেও নেই।