ট্যুইটারের মালিকানা আরও শক্তিশালী করবে এলন মাস্ককে?
"গণতন্ত্রের সবথেকে বড় খুঁটি হল বাকস্বাধীনতা, আর ট্যুইটার এমন একটি পরিসর, যেখানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। ট্যুইটারের অসম্ভব এক সম্ভাবনা রয়েছে এবং সেই উচ্চতায় পৌঁছনোর জন্য সমস্ত কর্মী এবং ব্যবহারকারীদের সঙ্গে একত্রে কাজ করব।"
শেয়ার প্রতি ৫৪.২০ ডলার বা ৪৪ বিলিয়ন ডলারে ট্যুইটার কিনে নিয়ে এই মন্তব্য করলেন বিশ্বের ধনীতম মানুষ এলন মাস্ক। বিগত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই সিলিকন ভ্যালি এবং বিশ্বজুড়ে গুঞ্জন চলছিল এই খবরকে কেন্দ্র করে। ট্যুইটারের সিইও পরাগ আগরওয়াল প্রথমে মাস্ককে পরিচালন পর্ষদে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। সেই সময়ে তাঁর মালিকানায় ছিল ট্যুইটারের ৯.২ শতাংশ শেয়ার। ৫ এপ্রিল তিনি সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিলেও মাত্র চার দিনের মাথায় নিজের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে তা খারিজ করে দেন এবং প্রস্তাব দেন পুরো সংস্থাকেই কিনে নেওয়ার।
স্বাভাবিকভাবেই ট্যুইটারের সিইও এবং পরিচালন পর্ষদ এই প্রস্তাব শুরুতে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। বলে রাখা দরকার, এই পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে সৌদি আরবের রাজপুত্র মহম্মদ বিন সলমনও আছেন। কিন্তু মাস্ক হার মানেননি। তিনি তার এই বিডের সপক্ষে ক্রমাগত প্রচার করতে থাকেন, এবং তার মাধ্যম? সেই ট্যুইটার। ট্যুইটারের পরিচালন পর্ষদ বিষয়টি আটকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও শেষমেশ স্বত্তাধিকারীদের চাপের মুখে পরে তারা এই ৩০০ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর সামাজিক মাধ্যমকে মাস্কের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হলেন।
আরও পড়ুন: মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সকলের অ্যাকাউন্টে ব্লু টিক: কতটা বদলাবে এলন মাস্কের ট্যুইটার?
কিন্তু বিশ্বের ধনীতম মানুষ হঠাৎ কেনই বা উঠে-পড়ে লাগলেন এই সংস্থা কিনে নেওয়ার জন্য?
এটা বুঝতে গেলে আগে মানুষ এলন মাস্ককে একটু বোঝা প্রয়োজন। তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি আগামীকাল কি করবেন তা তাঁর কাছের মানুষেরাও বুঝতে পারেননা। কখনও তিনি নিজেকে বলেন রক্ষণশীল, আবার কখনও নিজেকে বলেন সমাজতন্ত্রী। তিনি ট্যুইটার মাধ্যমটিকে খুব পছন্দ করেন এবং তাঁকেও প্রায় ৮৪ মিলিয়ন মানুষ ফলো করেন। তার প্রায় প্রত্যেকটি ট্যুইট খবর তৈরি করে বা হয়, এবং তাঁর লেখা একশো আশি শব্দের এতটাই ক্ষমতা যে, তিনি এক ট্যুইটে মার্কিন শেয়ার বাজারে ধস নামাতে পারেন, যার প্রভাব গোটা পৃথিবীতে পড়ে। তিনি কখনও বলেন যে, তিনি পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলে চলে যেতে চান, আবার তিনি পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে বাঁচাতে চান।
ট্যুইটার কিনে নেওয়ার পিছনে সবথেকে বড় কারণ হিসেবে মাস্ক দেখিয়েছেন যে, তিনি বাকস্বাধীনতা রক্ষা করতে চান, ওই মাধ্যমে যাতে সব মানুষ সমানভাবে নিজের মত রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করতে চান। বিষয়টা তার কাছে কখনওই টাকার বা লাভের অঙ্ক নয়। সেই সঙ্গে তিনি নিশ্চিত করতে চান, যাতে ব্যবহারকারীরা সকলেই মানুষ হয়, কম্পিউটার পরিচালিত 'বট' নয়। তিনি ব্যবহারকারীদের আরও স্বাধীনতা এবং নতুন প্রযুক্তি উপহার দিতে চান। তার বক্তব্য, "মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য একটি মাধ্যম থাকা অবশ্যই প্রয়োজন, যার সর্বাধিক বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে, এবং যেখানে সকলের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে।" তাছাড়া ট্যুইটারের অ্যালগরিদম নিয়েও তার বিস্তর অভিযোগ, যা তিনি ঠিক করতে চান।
এখানে মনে হতেই পারে, এলন মাস্কের হিরো সিনড্রোম রয়েছে। তিনি মানবজাতির মঁসিহা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চান। এর সপক্ষে কিছু যুক্তিও তাঁর ভক্তরা তুলে ধরছেন। যেমন, ট্যুইটার সামাজিক মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের চেয়ে বেশ ছোট। ব্যবহারকারীর সংখ্যা ওই দুই মাধ্যমের চেয়ে যথেষ্ট কম, কিন্তু বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বা সামাজিক ন্যারেটিভ ঠিক করে দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্যুইটারের ভূমিকা অনেক বড়। সমাজ বা পৃথিবী পাল্টাতে চাইলে এর থেকে বড় হাতিয়ার তিনি খুব বেশি পাবেন না। দ্বিতীয়ত, আর্থিকভাবেও খুব বেশি লাভবান হয় না এই সংস্থা। গত দশটি আর্থিক বছরের মধ্যে আটটিতেই লাভের মুখ বিশেষ দেখেনি এই সংস্থা। ট্যুইটারের ব্যবসায়িক মডেল বা আয় হয় শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন থেকে, যা নিয়মিত থাকেনি এই সংস্থার ক্ষেত্রে।
কিন্তু তাঁর নিন্দুকরা সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। মাস্ক অতীতে এক লেখককে ব্লক করে দিয়েছেন তার টেসলা সংস্থার গাড়ি নিয়ে কড়া নিন্দা করার জন্য। এমন আশঙ্কাও আছে যে, তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও টুইটারে বাকস্বাধীনতার নামে ফিরিয়ে আনতে পারেন, যিনি গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হেরে গিয়ে এমন উসকানিমূলক ট্যুইট করেন যার ফলে ওয়াশিংটনে দাঙ্গা লেগে যায়। সেই সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, বিজ্ঞাপনভিত্তিক মডেল থেকে সরে গিয়ে তিনি ব্যবহারকারীদের থেকে সদস্যপদ বা সাবস্ক্রিপশনও চাইতে পারেন। কেউ বলছেন, একেই তিনি বিশ্বের ধনীতম মানুষ, তার ওপর ট্যুইটারের মতো একটি মাধ্যমের মালিকানা তাঁর হাতে অভাবনীয় ক্ষমতা এনে দিতে পারে, যা মার্কিন গণতন্ত্র তথা বিশ্বের সকল গণতন্ত্রের জন্যই বিপজ্জনক। অনেক ব্যবহারকারী ইতিমধ্যেই এই মাধ্যম ছাড়ার কথা ঘোষণা করেছেন।
একথা বলাই বাহুল্য যে, ট্যুইটার এখন কীভাবে চলবে, তার নিয়মকানুন কী হবে, তা ঠিক করবেন ওই একজন ব্যক্তিই। আশঙ্কাতে আছেন ট্যুইটারের কর্মীরাও। নতুন মালিকানায় তাঁদের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে তাঁরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তবে বর্তমান সিইও পরাগ কর্মীদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, চাকরি না থাকলেও তাঁরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। আশ্বাস দিয়েছেন টুইটার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসিও। তিনি মনে করছেন টুইটারের ভবিষ্যত রয়েছে শক্ত ও সুরক্ষিত হাতেই।
জ্যাক ডরসি বা মাস্কের ভক্তদের দাবী কতটা সত্যি হয় তা তো সময়ই বলবে, কিন্তু গোটা বিশ্বে রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী এই মাধ্যমের মালিকানা মাস্কের হাতে যাওয়া যে অন্তত তাৎপর্যপূর্ণ তা বলাই বাহুল্য। মনে রাখা দরকার, মঙ্গল গ্রহে মানব সভ্যতা কে নিয়ে যাওয়া এবং সেই প্রচেষ্টার কর্নধার হতে চাওয়া মাস্ক "ন্যারেটিভ" বা জনমত গঠনে বিশেষ ভাবে আগ্রহী। তাই কি আর্থিক ভাবে অলাভজনক একটি সংস্থাকে প্রায় 38 শতাংশ বেশি দাম দিয়ে কিনে ফেললেন তিনি? আবারও কি টুইটার পাব্লিক থেকে প্রাইভেট কোম্পানীতে পরিনত হবে? দেখা যাক।