আমাজনের জঙ্গলে ৪০ দিন! মা-কে হারিয়ে চার শিশুর ভয়াবহ অভিজ্ঞতায় স্তম্ভিত বিশ্ব
Survival in Amazon Rainforest: শিশুরা জানিয়েছে ওই জঙ্গলেই একটি কুকুরের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়েছিল তারা। ওই কুকুরটিই ছিল জঙ্গলের একমাত্র বন্ধু।
একমাস ধরে চার শিশু ঘুরে বেড়াচ্ছে জঙ্গলে। তারা জঙ্গলের আদিবাসী নয়, জঙ্গলে আটকা পড়েছে সকলে। যার নেপথ্যে রয়েছে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। নিজেদের মা-কে এই জঙ্গলেই হারিয়েছে তারা। তারপর জীবনকে টিকিয়ে রাখার অভাবনীয় চ্যালেঞ্জ। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কলম্বিয়ার আমাজন রেইনফরেস্টে নিখোঁজ এই চার আদিবাসী শিশুকে অবশেষে উদ্ধার করে বাড়িতে ফেরানো গিয়েছে। কিন্তু এই একমাসে যা যা ঘটেছে তাঁদের সঙ্গে তা রোম খাড়া করার মতো অভিজ্ঞতা। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা হলো কেন? কীভাবে ঘন জঙ্গলে এসে পড়ল শিশুরা? আসলে এই চার ভাই বোনই এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ওই দুর্ঘটনায় তাদের মা এবং আরও দুই প্রাপ্তবয়স্কের মৃত্যু ঘটে। শেষে স্নিফার কুকুর, হেলিকপ্টার এবং বিমান নিয়ে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে তাঁদের খোঁজ মেলে। যখন খোঁজ মেলে, ততদিনে শিশুরা রুগ্ন, হাড় জিরজিরে, দুর্বল! আর্মি মেডিকেল বিমানে করে বোগোটার একটি সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের।
কীভাবে বিমান দুর্ঘটনার পরে জঙ্গলে এসে পড়ল তারা?
এই চার শিশুর বয়স যথাক্রমে ১৩, ৯, ৫ এবং ১ বছর! সকলেই হুইটোটো আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ। গত ১ মে থেকে এই গহিন জঙ্গলে নিখোঁজ তারা। Cessna 206 বিমানে চড়েছিল সকলেই, আমাজনের প্রত্যন্ত অঞ্চল আরাকুয়ারা থেকে বিমানটি যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরেই তাতে গোলযোগ দেখা দেয়। বিমানের পাইলট সান জোসে দেল গুয়াভিয়ারে জানান বিমানের ইঞ্জিনে সমস্যা রয়েছে। বিমানটি কিছুদূর গিয়েই ভেঙে পড়ে। দুর্ঘটনাস্থলে পাইলট, শিশুর মা এবং স্থানীয় আদিবাসী এক নেতার মৃতদেহ পাওয়া যায়। আর বিমানটি একটি গাছের মধ্যে উল্লম্বভাবে আটকে ছিল।
১ বছরের শিশুকে নিয়ে বাকিরা কীভাবে বেঁচে রইল?
অপুষ্টিতে ভুগলেও এবং পোকামাকড়ের কামড় সত্ত্বেও কোনও শিশুর অবস্থাই কিন্তু গুরুতর ছিল না। গার্ডিয়ানর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাগুয়ার, সাপ এবং অন্যান্য শিকারি, সেইসঙ্গে সশস্ত্র মাদক চোরাচালানকারী দলগুলির মুখোমুখি হয়েছে এই শিশুরা। এই শিশুদের অভাবনীয় সাহস বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে ঠিকই তবে এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে, ঘন জঙ্গল শিশুদের কাছে সম্পূর্ণ অচেনাও নয়।
“এরা আদিবাসী শিশু যাদের জঙ্গল সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রয়েছে। তারা জানে কী খেতে হবে এবং কী এড়িয়ে চলতে হবে। এই জ্ঞানের সঙ্গেই মিশেছে তাদের আধ্যাত্মিক শক্তি যা তাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে,” বলেছেন কলম্বিয়ার ন্যাশনাল ইনডিজিনাস অর্গানাইজেশনের লুইস অ্যাকোস্টা। বাচ্চাদের ঠাকুমা ফাতিমা ভ্যালেন্সিয়া জানিয়েছেন, সবার বড় দিদি, ১৩ বছরের লেসলি এক যোদ্ধার মতোই নিজের ছোট ভাই বোনদের বাঁচিয়েছে, জঙ্গলে আগলে রেখেছে।
যখন এই শিশুদের উদ্ধার করা হয় তখন দেখা যায়, শিশুরা কর্দমাক্ত জঙ্গলে হাঁটাচলা করার জন্য পায়ের কাপড় বেঁধে রেখেছে। ঘন গাছপালার কারণে হেলিকপ্টার জঙ্গলে নামানো সম্ভব হয়নি। এই শিশুদের উদ্ধার করতে দড়ি নামিয়ে টেনে তুলে নেওয়া হয় সকলকে।
বিমান দুর্ঘটনার পরে আমাজনের দুর্গম জঙ্গলে ৪০ দিন কাটিয়েছে এই শিশুরা। এই শিশুদের কাকা ফিদেনসিও ভ্যালেন্সিয়া বলছেন, কাসাভা ময়দা এবং রেইনফরেস্টের ফলের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচিতি থাকায় কোন কোন ফল খাওয়া যায় তা জানত বাচ্চারা। দুর্ঘটনার পরে ধ্বংসাবশেষ থেকেই কাসাভা ময়দা (ফরিনা নামে পরিচিত) উদ্ধার করেছিল শিশুরা, যা দীর্ঘদিন তাঁদের খিদে মিটিয়েছে। যখন ফরিনা ফুরিয়ে যায়, তখন তারা বীজ খেতে শুরু করে। তবে জঙ্গলের শিকারিদের পাশাপাশি, প্রচণ্ড ঝড়ের মুখোমুখি হয় এই শিশুরা। এই এলাকাতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি সম্পর্কেও জানত তারা।
কীভাবে উদ্ধার করা হলো এই বাচ্চাদের?
বিমান দুর্ঘটনার পর নিখোঁজ শিশুদের খুঁজে বের করার জন্য জঙ্গল সম্পর্কে বিপুল জ্ঞান রয়েছে এমন ১৬০ জন সৈন্য এবং ৭০ জন আদিবাসী একসঙ্গে বৈঠকে বসেন। বিশাল অনুসন্ধান অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উদ্ধারকারীরা ২,৬০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে উদ্ধার অভিযান চালান। অনুসন্ধান অভিযানের সময়, পায়ের ছাপ, একটি ডায়াপার এবং আধখাওয়া ফলের মতো গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলি তাঁদের আশ্বস্ত করে যে সঠিক দিকেই এগোচ্ছেন তাঁরা।
শিশুদের জন্য বিমান বাহিনী একটি কৌশল তৈরি করে। ১০,০০০ চিরকুট ফেলা হয় ওই জঙ্গলের মধ্যে। সেই চিরকুটে স্প্যানিশ এবং বাচ্চাদের নিজস্ব আদিবাসী ভাষাতে নির্দেশ লেখা ছিল, যাতে বাচ্চারা ওই এলাকাতেই থাকে। সেই চিরকুটগুলিতে কঠিন অবস্থায় বেঁচে থাকার নানা কৌশলও লেখা ছিল। সামরিক বাহিনী খাবারের পার্সেল এবং জলের বোতলও ফেলেছিল জঙ্গলে। এখানেই শেষ না। ওই বাচ্চাদের ঠাকুমার কাছ থেকে একটি রেকর্ডিং নিয়ে আসেন সেনারা। সেই রেকর্ডিংয়ে ঠাকুমা বাচ্চাদের ওই এলাকাতেই থাকতে বলেন। গভীর জঙ্গলে ঠাকুমার গলার আওয়াজ যে বাচ্চাদের আটকে রাখবে, আস্থা জোগাবে বুঝেছিল সেনাবাহিনী।
অবশেষ সন্ধান মেলে সকলের। শিশুরা জানিয়েছে ওই জঙ্গলেই একটি কুকুরের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়েছিল তারা। ওই কুকুরটিই ছিল জঙ্গলের একমাত্র বন্ধু। কুকুরটি আসলে একটি বেলজিয়ান শেফার্ড। সামরিক বাহিনী উইলসন নামের ওই কুকুরটিকে খুঁজে বের করার জন্য অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে এখনও।