বহিরাগত দেখলে শাঁখ বাজানোর নির্দেশ! সন্দেশখালি থেকে যে বার্তা দিলেন বিরোধীনেতা শুভেন্দু

Suvendu Adhikari in Sandeshkhali: এর আগে দু-দু'বার পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু। মঙ্গলবার সন্দেশখালিতে যাওয়ার জন্য হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে অনুমতি নেন শুভেন্দু।

জোর করে জমি জবরদখল, মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার, যৌন হেনস্থা। সময় মতো বাড়ির মেয়ে-বউদের পাঠাতে হল এলাকার ত্রাস শেখ শাহজাহান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কাছে। ওজরআপত্তি করলেই বাড়ির পুরুষদের ধরে মার, অত্যাচার। শাসকদল তৃণমূলের স্থানীয় নেতা কার্যত ভয়ের আবহ গড়ে তুলেছিল সন্দেশখালি জুড়ে। পুলিশ-প্রশাসন কারওর কাছে কোনও অভিযোগ করেই ফল মেলেনি। অবশেষে একদিন পথে নামেন স্থানীয় মহিলারা। রুখে দিতে চান শেখ শাহজাহানদের। খবরের কাগজের শিরোনামে উঠে আসে সন্দেশখালি। যেখানের আন্দোলনকে অনেকেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেই সন্দেশখালিতে তিনবারের চেষ্টায় অবশেষে প্রবেশ করেছেন রাজ্যের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী।

আদালতের থেকে অনুমতি নিয়ে তবে মিলেছে সন্দেশখালিতে প্রবেশের ছাড়পত্র। এর আগে দু-দু'বার পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু। মঙ্গলবার সন্দেশখালিতে যাওয়ার জন্য হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে অনুমতি নেন শুভেন্দু। তবে কোনও সমর্থক বা দলীয় কর্মী যাতে তাঁর সঙ্গে না যায় ঘটনাস্থলে, তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছিল কোর্ট। আদালতের নির্দেশ অনুসারেই শুভেন্দু ও শঙ্কর ঘোষ পৌঁছন সন্দেশখালিতে।

আরও পড়ুন: সন্দেশখালি ঘুরে কেন রাষ্ট্রপতি শাসন চাইছেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন?

যদিও ধামাখালিতেই পুলিশের বিশাল বাহিনী তাঁকে আটকায়। বাধা দেওয়া হয় সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাতকেও। ইতিমধ্যে নতুন করে ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। ধামাখালি ঘাট , সন্দেশখালি ঘাট , ভোলাখালি ঘাট , খুলনা ঘাট, জেলেখালি ঘাট। মোট ১২ জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। তবে আদালতের অনুমতিপত্র দেখালে ধামাখালিতে ব্যারিকেড সরায় পুলিশ। কালো ব্যাজ পরে সন্দেশখালিতে ঢোকেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ও বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ। জানা গিয়েছে, শুভেন্দু এলাকায় পৌঁছতেই 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি ওঠে চারদিক থেকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে গিয়ে গিয়ে আশ্বাস দিতে দেখা গিয়েছে শুভেন্দুকে।

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা জানান, কর্মরত সাংবাদিককে অবৈধভাবে গ্রেফতারির প্রতিবাদেই কালো ব্যাজ পরে সন্দেশখালিতে ঢোকেন তিনি। সন্দেশখালির হাতে গোনা জায়গাতে যাওয়ারই অনুমতি পেয়েছিলেন শুভেন্দুবাবু। এদিকে, বিজেপির অভিযোগ, শুভেন্দুর সঙ্গে দেখা করা নিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের হুমকি দিচ্ছে ধৃত উত্তম সর্দার এবং শিবপ্রসাদ হাজরার অনুগামীরা। সন্দেশখালির ঘোষপুর এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ অভিযোগ করেছেন, শুভেন্দুর সঙ্গে দেখা করলে বাড়িঘর ভাঙচুর করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে! তাঁদের অভিযোগ, শুভেন্দুর সঙ্গে দেখা করলে এলাকায় থাকতে দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

সোমবারই সন্দেশখালিতে গিয়েছিল জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সন্দেশখালিতে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি জানান রেখা। দিন কয়েক আগে সন্দেশখালি গিয়েছিল রাজ্যের এসসি কমিশন। রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের তরফেও আবেদন জানানো হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয় সন্দেশখালিতে। তার পরেই মঙ্গলবার সন্দেশখালির মাটিতে পা রাখলেন বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী। সোমবারও সন্দেশখালি যাওয়ার পথে আটকানো হয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীকে। রাজ্য সরকার ডিভিশন বেঞ্চে গিয়েছে বলে দাবি করে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা-সহ বিজেপি বিধায়কদের বাধা দেয় পুলিশ। পাঁচ বিধায়ককে নিয়ে সন্দেশখালি যাওয়ার পথে, ধামাখালি ফেরিঘাট এলাকায় আটকে দেওয়া হয় শুভেন্দুকে। তখন তিনি বলেন, এক ঘণ্টা অপেক্ষা করব, তারপর কলকাতায় ফিরে গিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হব। রাস্তায় বসে পড়ে শুরু করেন বিক্ষোভ। এর আগে দু’বার সন্দেশখালি যাওয়ার চেষ্টা করেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। রাজ্য প্রশাসনের বাধায় সম্ভব হয়নি তা। কিন্তু এবার প্রধান বিচারপতি শুভেন্দু অধিকারী ও শঙ্কর ঘোষকে সন্দেশখালি যাওয়ার অনুমতি দেন।

এদিন সন্দেশখালি যান সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাটও। ধামাখালিতেই নেত্রীকে আটকায় পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে সিপিএম কর্মীদের বচসাও শুরু হয়। বৃন্দা জানান, মাত্রা চার জনকে নিয়ে তিনি সন্দেশখালি যেতে চান। কিন্তু পুলিশের তরফে অনুমতি দেওয়া হয়নি। বৃন্দা বলেন, ‘‘সন্দেশখালিতে আমাদের ঢুকতে দেওয়া হল না। এটা অগণতান্ত্রিক। পুলিশের যদি এত ক্ষমতা থাকে, তা হলে কেন শাহজাহান শেখকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না? শাহজাহান গ্রেফতার হলে, অনেক সত্যি সামনে আসবে। ওই জন্য ওকে ধরা হচ্ছে না। মেয়েদের অবস্থা শোচনীয়। আমি কল্পনা করতে পারছি না। জাতীয় মহিলা কমিশন এবং এসসি কমিশন উত্তরপ্রদেশ এবং মণিপুর যাচ্ছে না। অথচ বাংলায় তারা রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি করছে। রাষ্ট্রপতি শাসন মানে বিজেপি শাসন। আমরা এর বিরোধিতা করছি। বিকল্প সরকার চায় মানুষ। অগণতান্ত্রিক শাসন বা রাষ্ট্রপতি শাসনের বকলমে বিজেপির শাসন চায় না মানুষ।’’

সন্দেশখালিতে ঘুরে ঘুরে এদিন গ্রামবাসীদের অভিযোগ শুনছেন বিরোধী দলনেতা। সন্দেশখালির ৮ নম্বর মাঝেরপাড়ার বিনাপানি সমাজ কল্যাণের মাঠে বসেও গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রসঙ্গ তোলেন নন্দীগ্রামের । বিরোধী দলনেতা বলেছেন, “সন্ধ্যের পর কোনওভাবে বহিরাগতদের দেখেন, তাহলে শাঁখ বাজাবেন। সেই সময় সবাই সতর্ক হয়ে যাবেন। একজোট হয়ে লড়াই করবেন।”সাধারণ মানুষে সঙ্গে কথা বলার সময় শুভেন্দুর আশ্বাস, ‘‘আপনারা সঙ্গে থাকবেন তো? তা হলেই হবে। তা হলেই শাহজাহান ফিনিশ।’’ সন্দেশখালিতে সব পরিবর্তন হয়ে যাবে, শান্তি ফিরে আসবে বলেও এদিন আশ্বাস দিতে দেখা গিয়েছে বিরোধী দলনেতাকে। একই সঙ্গে বিজেপি নেতা বিকাশ সিংহের বাড়িতেও এদিন যান শুভেন্দু। সন্দেশখালিতে অশান্তিতে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন বিজেপি নেতা বিকাশ। পরে তাঁকে জামিন দেয় আদালত। কিন্তু আদালত থেকে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গেই বিকাশকে আবার গ্রেফতার করে পুলিশ। সেই ধৃত বিজেপি নেতার পরিবারের সঙ্গে এদিন কথা বলেন বিজেপি নেতা। বিকাশ সিংহের বাড়ি থেকে বেরিয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘‘গ্রামের সকলকে একটা করে মাইক দেব। কেউ ঘরে এলেই চোর এসেছে, দস্যু এসেছে বলে ওই মাইকে চিৎকার করতে হবে। তখন বাকিরাও ঘর থেকে বেরিয়ে আসবেন।’’

আরও পড়ুন:সন্দেশখালি কি আজকের নন্দীগ্রাম?

গোড়া থেকেই সন্দেশখালির বিদ্রোহকে এ রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করে আসছে বিজেপি। চেষ্টা করা হচ্ছে এর উপর ধর্মীর রং চাপানোরও। সামনেই লোকসভা ভোট। তার আগে সন্দেশখালির মতো ঘটনা এ রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির হাতে যে মোক্ষম অস্ত্র তুলে দিয়েছে তাতে আর সন্দেহ কী! আর সেটাকেই এদিন সন্দেশখালি সফরেও কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন বিরোধী দলনেতা। সন্দেশখালির মাটিতে পা দিয়ে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে সেই লক্ষ্যের কথাই। আর লক্ষ্য স্থির থাকলে যে জয় আসবেই, সে কথাও এদিন পরিষ্কার করে দেন শুভেন্দু। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের লক্ষ্য স্থির ছিল। তাই সন্দেশখালি পৌঁছে সেখানকার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি। মহিলাদের উপর অত্যাচার হয়েছে। আদিবাসীদের জমি নেওয়া হয়েছে। কাউকে আইন হাতে তুলে নিতে বারণ করেছি। তবে শাহজানান এখানেই ঘোরাফেরা করছে। আর বাংলাদেশ চলে গেলে সেখান থেকে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে আসতে হবে। বিএসএফকে সতর্ক থাকতে হবে।’’

শিবু, উত্তমরা গ্রেফতার হয়েছে ইতিমধ্যেই। আপাতত ধরা পড়া বাকি পালের গোদা শেখ শাহজাহানের। শেখ শাহজাহানের গ্রেফতারির দাবিতে পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ সন্দেশখালি। স্থানীয় মহিলারা তো ঘোষণা করেই দিয়েছেন, শাহজাহান গ্রেফতার হলে পিকনিক হবে সন্দেশখালিতে। আর সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতেই সন্দেশখালি ঘুরে দেখলেন শুভেন্দু। একই সঙ্গে তাঁর হুঙ্কার, সন্দেশখালিতে তৃণমূল সভা করলে পাল্টা সভা করবে বিজেপিও। ভোটের আগে যে কোনও মতেই সন্দেশখালি ইস্যুকে বৃথা যেতে দেবেন না শুভেন্দু তৃণমূলের বিরুদ্ধে, তা একরকম স্পষ্ট করে দিয়েছেন এদিন তিনি সন্দেশখালি থেকেই।

More Articles