সারছে এইডসও! চিকিৎসাজগতে বিপ্লব, তুলকালাম বিশ্বজুড়ে

অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন কীভাবে ক্যানসার এবং এইডস নিরাময়ের মতো অসাধ্যসাধন করতে পারে, জেনে নেওয়া যাক।

দেখতে দেখতে চার জন ব্যক্তি সেরে উঠলেন এইচআইভি-র কবল থেকে। ৬৬ বছর বয়সি, নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক‍ সেই ব্যক্তি ১৯৮০ সাল থেকেই ভুগছিলেন এইচআইভিতে। অবশেষে তাঁর দেহে অস্থি-মজ্জা প্রতিস্থাপনের (বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট) পর সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি। কিন্তু বোন ম্যারো বা অস্থি-মজ্জা প্রতিস্থাপনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল লিউকেমিয়া ও ব্লাড ক্যানসারের চিকিৎসা করা। যে ব্যক্তির দেহ থেকে অস্থি-মজ্জা সংগ্রহ করা হয়েছিল, কাকতালীয়ভাবে এইচআইভির বিরুদ্ধে জন্মগত প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল তাঁর।

বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার পর সতেরো মাস হলো, এখনও অবধি সেই ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটির সন্ধান পাওয়া যায়নি। সুস্থ হয়ে ওঠা এই ব্যক্তির চিকিৎসা হয়েছিল 'সিটি অফ হোপ' নামে ক্যালিফোর্নিয়ার এক হাসপাতালে। সেই ব্যক্তি জানাচ্ছেন, ওঁর অনেক বন্ধুই নাকি ইতিমধ্যে এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। এবং তিনি কখনও আশা করেননি, তিনি বেঁচে ফিরবেন এবং প্রায় সুস্থ একটি জীবন ফিরে পাবেন।

"১৯৮৮ সালে যখন আমার এইডস ধরা পড়ল, অনেকের মতোই আমি ভেবেছিলাম বোধহয় মৃত্যুদণ্ড পেলাম", একটি সাক্ষাৎকারে বিবিসি-কে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই ব্যক্তি।

আরও পড়ুন: হৃদরোগের চিকিৎসায় দিশা দেখাবে পালং শাকের পাতা! আশ্চর্য আবিষ্কারে তোলপাড় বিশ্ব

এই পদ্ধতিতে ২০০৮ সালে সর্বপ্রথম এইচআইভি-মুক্ত হয়েছিলেন বার্লিনের টিমোথি ব্রাউন। ২০০৭ সালে তাঁর দেহে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছিল।

টিমোথির পর ২০১৯ সালে আরেক ব্যক্তির এইচআইভি সারিয়ে তোলেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষকরা, ঠিক একই পদ্ধতিতে। সেই ব্যক্তি ২০০৩ সাল থেকেই ভুগছিলেন এইচআইভি-তে, তারপর ২০১২ সালে তাঁর শরীরে হজকিন লিম্ফোমা ধরা পড়ে। সাধারণ চিকিৎসাপদ্ধতির শরণাপন্ন হওয়ার বহুদিন পরেও যখন তিনি সেরে উঠলেন না, তারপরেই বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয় তাঁর। তারপর তাঁর শরীর এইচআইভি-মুক্ত হয়।

চলতি বছরেই মার্চ মাসে প্রথমবার এক মহিলা সেরে ওঠেন এইডস থেকে। তাঁর ক্ষেত্রে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টের পাশাপাশি আম্বিলিক্যাল কর্ড (নাড়িরজ্জু) ব্লাড ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছিল। মাঝবয়সি ওই মহিলা এইডসে আক্রান্ত হওয়ার পরে ভুগছিলেন অ্যাকিউট মায়েলোজেনাস লিউকেমিয়ার মতো ক্যানসারে।

এইচআইভি বা হিউম্যান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস আমাদের শরীরের স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে নষ্ট করে। যার ফলে দেখা যায়, এইডস বা অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি সিন্ড্রোম। শরীরে তখন খুব সহজে বাসা বাঁধে সংক্রামক ব্যাধি, কারণ আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা আর ভাইরাস, ব্যকটেরিয়া এবং অন্যান্য রোগ-সৃষ্টিকারী জীবদের প্রতিরোধ করতে পারে না। এছাড়াও যেহেতু ক্যানসারের সঙ্গে আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকে, তাই আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেলে, ক্যানসারে ভোগার প্রবণতা বেড়ে যায় অনেকটা। তাই স্বাভাবিকভাবেই এইচআইভি-র কবলে পড়লে পরবর্তীকালে ক্যানসার আক্রমণের ভয় থেকেই থাকে।

কিন্তু অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন কীভাবে ক্যানসার এবং এইডস নিরাময়ের মতো অসাধ্যসাধন করতে পারে, আসা যাক সেই গল্পে।

অস্থিমজ্জা থেকে অসাধ্যসাধন কীভাবে
অস্থিমজ্জায় থাকা স্টেম সেল থেকে জন্ম নেয় শ্বেত রক্তকণিকা। আমাদের রোগপ্রতিরোধে আদতে সাহায্য করে রক্তের শ্বেতকণিকা। কিন্তু যে ব্যক্তির স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে, তাঁর ক্ষেত্রে আর তাঁর অস্থিমজ্জা-জাত শ্বেত রক্তকণিকা রোগপ্রতিরোধ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের। একে আবার স্টেম সেল ট্রিটমেন্টও বলা যায়। কারণ শেষমেশ অস্থিমজ্জার স্টেম সেলকেই পুরোপরি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করলে তৈরি হয় নতুন শ্বেত রক্তকণিকা, যাদের ক্যানসার-সহ বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে।

তবে এইচআইভি-মুক্ত হতে গেলে, কেবল অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনই যথেষ্ঠ নয়। এইচআইভি-প্রতিরোধী ক্ষমতা থাকতে গেলে অস্থিমজ্জার কোশে থাকতে হবে নির্দিষ্ট জিন। যে ব্যক্তিদের শরীর থেকে অস্থিমজ্জা সংগ্রহ করা হয়ছে, তাঁদের প্রত্যেকের শরীরেই নামের CCR5 নামের জিনের একটি মিউটেটেড প্রতিলিপি উপস্থিত ছিল।এইচআইভি কিন্তু শ্বেত রক্তকণিকায় প্রবেশ করে তার সাহায্যেই। তাই CCR5-কে প্রতিরোধ করতে পারলেই, আটকে দেওয়া যাবে ইচআইভির কুপ্রভাব।

আর সেই মিউটেটেড বা রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত জিনই করল বাজিমাত। CCR5 জিনের একটি নির্দিষ্ট অংশে মিউটেশন থাকায় জিনটি হিউম্যান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস বা HIV-কে T-Cell -কে আক্রমণ করা থেকে প্রতিহত করে।

টি-সেল কী
T-cell এক প্রকার শ্বেত রক্তকণিকা, যা আমাদের ইমিউন সিস্টেমের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দেহে প্রবেশ করা অবাঞ্ছিত পদার্থ থেকে শুরু করে যে কোনও জীবাণুকে প্রতিরোধ করা, এমনকী, ক্যানসারের সঙ্গে মোকাবিলা করা, সবেতেই T-Cell-এর ভূমিকা অত্যাবশ্যকীয়।

এইচআইভি শরীরে প্রবেশ করলে, আক্রমণ করতে পারে T-Cell-কে। সেক্ষেত্রে আর জীবাণু বা ক্যানসার কোনওটিকেই প্রতিরোধ করতে পারবে না T-Cell। কিন্তু জিনের একটি নির্দিষ্ট অংশের মিউটেশন T-Cell -কে এইচআইভি-র আক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

কিন্তু বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট কি এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের আটত্রিশ মিলিয়ন এইচআইভি-আক্রান্ত রোগীকে সারিয়ে তুলতে পারবে? উত্তর হলো: না, তা কোনওভাবেই সম্ভব নয়।

"বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট আদতে খুব জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। এর যথেষ্ট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকে অনেক ক্ষেত্রেই। তাই এই মুহূর্তে এইচআইভি-তে ভোগা রোগীদেরকে সারিয়ে তুলতে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট মোটেই নির্ভরযোগ্য উপায় নয়", জানাচ্ছেন 'সিটি অফ হোপ' হাসপাতালের ডাক্তার ড. জেনা ডিক্টর। কিন্তু সিটি অফ হোপ হাসপাতালে ইতিমধ্যেই একইরকম তিনটি মেডিক্যাল কেস রয়েছে। জানা যাচ্ছে, প্রত্যেকটি রোগীকেই একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হবে।

More Articles