উদ্বাস্তু পরিবারের লড়াই! যেভাবে স্বাধীন ভারতে প্লাজমা পদার্থবিদ্যার পথিকৃৎ হয়েছিলেন বিমলা বুটি

Scientist Bimala Buti: প্রায়শই বলতেন, "বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণায় লিঙ্গ বৈষম্য কমানো এখন আমার মুখ্য উদ্দেশ্য"। সেটা বিমলা করে গেছেন জীবনভর।

স্কুল জীবনে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ পাননি। কিশোরী বয়সেই দেশভাগের প্রাক্কালে লাহোর থেকে দিল্লিতে এসে যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, সেখানে বিজ্ঞান বিষয়টাই ছিল না। কে জানত, এই মেয়েই ভবিষ্যতে দেশের প্রথম মহিলা ইনসা ফেলো হবেন? তিনি বিমলা বুটি, প্রফেসর বিমলা বুটি। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে প্লাজমা পদার্থবিদ্যার গবেষণাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছিলেন তিনিই। নোবেলজয়ী ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরের ছাত্রী ছিলেন বিমলা। দিল্লির এক বিদ্যালয়ের কলাবিভাগের পড়ুয়া থেকে ইতালির আবদুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের (ICTP) প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞানের ডিরেক্টর! তাঁর স্বপ্নের এই উড়ান যে কোনও তরুণ বিজ্ঞানীর কাছে অনুপ্রেরণা।

ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি আগ্রহী ছিলেন বিমলা। এ ব্যাপারে তাঁর হাতেখড়ি অবশ্য বাবার কাছেই। পেশাগত দিক দিয়ে আইনজীবী হলেও তাঁর বাবা ছিলেন সেই সময়ের পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের স্বর্ণপদক জয়ী। বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে বিমলা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছরের একটি কোর্স করেছিলেন যাতে পদার্থবিদ্যার স্নাতক স্তরে তিনি ভর্তি হতে পারেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতকোত্তর বিভাগে পড়ার সময় তাঁর পছন্দের বিষয় ছিল পার্টিকেল ফিজিক্স বা কণা পদার্থবিজ্ঞান। তখন ছিল কণা পদার্থবিদ্যার রমরমা বাজার। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন নতুন কণার সন্ধান পাচ্ছেন গবেষকরা। সেই টানেই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসছিলেন তিনি কিন্ত শুরুর দিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ক্লাসে সাক্ষাৎ হয় সুব্রহ্মনিয়ম চন্দ্রশেখরের সঙ্গে। তাঁর পড়ানোয় মুগ্ধ হয়ে বিমলা মনস্থির করেন, কণা পদার্থবিদ্যা নয়, চন্দ্রশেখরের অধীনেই করবেন গবেষণা।

আরও পড়ুন- বিতাড়িত হয়েছিলেন কর্মক্ষেত্র থেকে, যে আবিষ্কার নোবেল এনে দিল এই বিজ্ঞানীকে

চন্দ্রশেখর সেইসময় কাজ করছেন ম্যাগনেটোহাইড্রোডাইনামিক্স নিয়ে- প্লাজমা পদার্থবিদ্যার জটিল বিষয়। সমস্যা হলো, সপ্তাহের বেশিরভাগ সময়ই তিনি থাকেন ইয়ার্কেস মানমন্দিরে, কেবল বৃহস্পতি ও শুক্রবার শিকাগোতে আসতেন কোয়ান্টামের ক্লাস নিতে। ছাত্রীকে আগেই সাবধান করলেন, "আমি কিন্ত তোমাকে বেশু সময় দিতে পারব না, ভেবে দেখো"। বিমলা তবুও নাছোড়বান্দা। অগত্যা গুরু চন্দ্রশেখর দু'খানা পেপার পড়তে দিয়ে বললেন, "দেখো তো, কোনও গণ্ডগোল পাও কিনা। সামনের সপ্তাহে দেখা করো"। বিমলার ছিল অদম্য জেদ ও লেগে থাকার মানসিকতা। এক সপ্তাহের মধ্যেই হাজির হলেন দুটো খটকা নিয়ে- সেই শুরু।

বিমলা বুটি কাজ করেছেন মূলত আপেক্ষিক প্লাজমাপদার্থ বিজ্ঞান বা রিলেটিভিস্টিক প্লাজমা নিয়ে। কী এই প্লাজমা?

কঠিন, তরল ও গ্যাস- আমরা পদার্থের এই তিনটি অবস্থার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। এখন গ্যাসকে যদি আরও উত্তপ্ত করা যায় তাহলে কী হবে? বাইরের কক্ষে থাকা ইলেকট্রনটি পরমাণুর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। উৎপন্ন হবে আয়নিত গ্যাস। এই ধরনের গ্যাসীয় আয়ন ও মুক্ত ইলেকট্রনের যে সমাবেশ, যাদের মধ্যে 'কোয়াসিনিউট্রালিটি' শর্ত রক্ষিত হলে, তার নাম প্লাজমা। তাপ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের আলো বা বিকিরণের দ্বারাও কাজটি করা যায়, শুধু পর্যাপ্ত শক্তির হলেই চলবে। তড়িৎ ক্ষেত্র ও চুম্বক ক্ষেত্রের উপস্থিতিতে এই আয়নিত গ্যাসের আচরণ বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ গ্যাসের থেকে আলাদা। তাপমাত্রা বাড়াতে বাড়াতে ২০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে প্লাজমাতে কোনও তড়িৎ নিরপেক্ষ কণা খুঁজে পাওয়া যায় না, সবই পরিণত হয় ধনাত্মক আয়ন ও মুক্ত ইলেকট্রনে। এই অবস্থাকেই বলা হয় বিশুদ্ধ প্লাজমা, পদার্থের চতুর্থ অবস্থা।

বিমলা মূলত কাজ করতেন ফলিত গণিত ভিত্তিক। বিভিন্ন প্লাজমার সমস্যাকে একটি গাণিতিক মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে ও তার যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান দিতে তাঁর ছিল জুড়ি মেলা ভার। তত্ত্বীয় প্লাজমার কোনও দিকে হাত দেননি বিমলা- প্লাজমা ইনস্টবেলিটি, নন-লিনিয়ার ইন্টারাকশন, ক্যাওস থিওরি, সলিটন, সৌর প্লাজমা, প্রভৃতি। বিশেষত সলিটন বা সলিটারি সম্পর্কিত তরঙ্গ তাঁর কাজ আয়নমণ্ডল বা প্রকৃতিতে ঘটা বিভিন্ন ঘটনার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হয়েছিল।

শিকাগো বিশ্ববদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ১৯৬২ সালে দেশে ফিরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন বিমলা। পুরনো জায়গা। সেখানে দু'বছর কাজ করার পর আবার পাড়ি দেন আমেরিকায়। এবারেরর গন্তব্য গর্দাদ স্পেস ফ্লাইট সেন্টার- নাসা। ১৯৬৮ সালে আমেরিকা থেকে ফিরে যোগ দেন আইআইটি দিল্লিতে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে। নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান খানিকটা সাবালক ততদিনে। মহাকাশ বিজ্ঞানেরও ভিত তৈরি হচ্ছে সেসময়। মূল কাণ্ডারি বিক্রম আম্বালা সারাভাই। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার চলছে কেন্দ্রে। সেসময় প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন নেহেরু স্মৃতি বক্তব্য দিতে। গুরুর সম্মানে বিমলাও পেয়েছেন আমন্ত্রণ। বক্তব্যের পর রাজকীয় নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষ থেকে। চাঁদের হাট সেখানে- সারাভাই, ডিএস কোঠারি, আরও অনেকে। সেখানেই আলাপ সারাভাইয়ের সঙ্গে। সারাভাই বিমলাকে আমন্ত্রণ জানালেন ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে (পিআরএল) যোগ দিতে। তাঁরই আমন্ত্রণে ১৯৬৯ সালে বিমলা পি.আর.এল-এ যোগ দেন। তেইশ বছর ধরে পড়ানো ও গবেষণার পাশাপশি সামলান বিভিন্ন পদ। নিজে তাত্বিক বিজ্ঞানী হলেও পরীক্ষামূলক প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞানের জন্য একটি দক্ষ গবেষক দল গড়ে তোলেন তিনি।

আরও পড়ুন- সমুদ্রের রঙ দেখে কৌতূহল! যে ঘটনা পরাধীন ভারতে প্রথম নোবেল এনে দিয়েছিল

পি. আর. এল. এ থাকাকালীন বিমলা জেট প্রপালসন ল্যাবরটরি ক্যালিফোর্নিয়া সহ বিদেশের বিভিন্ন নামকরা গবেষণাগার গুলোতে যান। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্লাজমা পদার্থবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত অধ্যাপক, গবেষকদের একই ছাতার তলায় নিয়ে আসতে তিনি ১৯৭৮ সালে গড়ে তোলেন প্লাজমা সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া (পি.এস.এস.আই)। কালক্রমে, ১৯৯২ সালে তিনি এই সোসাইটির সভাপতিও হন। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে আলাপ হয় কালজয়ী বিজ্ঞানী আব্দুস সালামের সঙ্গে। ১৯৮৫ সালে সালাম আইসিটিপি-তে প্লাজমা ফিজিক্স কলেজ নামক একটি সেন্টার গড়ে তোলেন, যার দায়িত্ব দেন বুটিকে। দীর্ঘ আঠারো বছর সফলভাবে এই সেন্টারেরও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই সময় সারা পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল, উন্নত দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর।

তাঁর বিস্তৃত কর্মজীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন বিমলা বুটি - বিক্রম সারাভাই রিসার্চ আওয়ার্ড, জওহরলাল নেহেরু লেকচারশিপ অ্যাওয়ার্ড, ইনসা ভানু বাপ্পু মেডেল, প্রভৃতি। ইনসা ফেলো, অ্যামেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির পাশাপাশি দ্য ওয়ার্ল্ড আকাডেমি অফ সায়েন্সের ফেলোও নির্বাচিত হয়েছেন।

২০০৩ সালে সব রকম সরকারি পদ থেকে অবসর নিয়ে বিমলা বুটি গড়ে তোলেন 'বুটি ফাউন্ডেশন', যার মুখ্য উদ্দেশ্য শিক্ষা, জ্ঞান ও কম্পিউটার সচেতনতা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। বিজ্ঞানের নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটি তাঁর সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থে তৈরি করেন 'বুটি ফাউন্ডেশন'। ৪৫ বছরের কম বয়সি প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞানীদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি দিতে তাঁর ফাউন্ডেশন ২০০৭ সাল থেকে চালু করে 'বুটি অ্যাওয়ার্ড'। অবসরের পরে তিনি প্রায়শই বলতেন, "বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণায় লিঙ্গ বৈষম্য কমানো এখন আমার মুখ্য উদ্দেশ্য"। সেটা তিনি করে গেছেন জীবনভর। চলতি বছর ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখে এদেশের বিজ্ঞানাকাশ থেকে খসে পড়ে, বিমলা বুটি নামক নক্ষত্র। ভারতীয় বিজ্ঞান তথা আন্তর্জাতিক প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞানের আকাশ কিছুটা নিষ্প্রভ। এ রেশ হয়তো থাকবে অনেকদিন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে, উদ্বাস্তু পরিবার থেকে উঠে এসে অধ্যাপক বিমলা বুটি আমৃত্যু যে সংগ্রাম করে গেছেন, ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরকাল তা অমলিন থাকবে।

More Articles