সমুদ্রের রঙ দেখে কৌতূহল! যে ঘটনা পরাধীন ভারতে প্রথম নোবেল এনে দিয়েছিল
National Science Day : সমুদ্রের জলের নীল রঙ রমনের অনুসন্ধানী মনকে নাড়া দেয়। 'নীল আকাশের জন্যেই সমুদ্রের জল নীল দেখায়'- প্রচলিত এই ব্যাখ্যা তিনি সহজে মেনে নিতে পারেননি।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী সমারফেল্ড ১৯২৮ সালে কলকাতায় আসেন। সেই সময় দেখা হয় সি. ভি. রমনের সঙ্গে। ঘটনাচক্রে সেই বছরই রমন আবিষ্কার করেন রমন এফেক্ট। ওই বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি, রমন সমারফেল্ডের সামনে সেটি উপস্থাপন করেন। রমন আসলে ভেবেছিলেন ২৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সে বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আলোর বিক্ষেপণে যে পরিবর্তিত বর্ণালী পাওয়া যায় তা সবাইকে দেখাবেন। কিন্ত ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট আশুবাবুর সব যন্ত্রপাতি সাজিয়ে গুছিয়ে ঠিক করতে করতেই সন্ধ্যা নেমে যায়। বর্ণালীবীক্ষণ পরীক্ষার জন্য সূর্যালোক দরকার, অগত্যা পরদিন শুরু হলো সেই পরীক্ষা। পরীক্ষায় দেখা গেল, নির্দিষ্ট বর্ণের আলোর বর্ণালীর পাশাপাশি আরেকটি আলাদা বর্ণের রেখা – যার পোশাকি নাম রমন রেখা বা 'রমন লাইন'। সামনে বসে আছেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী সমারফেল্ড। এদিকে সমারফেল্ড কলকাতায় এসেছেন শুনে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছেন সত্যেন বসু। রমনের লেকচারের শেষে, সত্যেন বলেছিলেন— "প্রফেসর রমন, আপনি এক অসামান্য উদ্ভাবন করেছেন। এটি 'রমন এফেক্ট' নামে পরিচিতি পাবে এবং আপনি দ্রুত নোবেল পুরস্কার পাবেন"। সত্যেন বসুর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিলে। তার দুই বছরের মাথায় ১৯৩০ সালে রমন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। পরাধীন ভারতে বিজ্ঞানের প্রথম নোবেল! কী সেই রমন এফেক্ট?
বর্ণালী বিক্ষণ অর্থাৎ স্পেকট্রোস্কোপিতে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা তো জানেনই, এমনকী 'রমন এফেক্ট' এখন পদার্থবিদ্যার শিক্ষার্থীদেরও পাঠ্য। বাংলার বাঘ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রমনকে বিজ্ঞান কলেজে নিয়ে এসেছিলেন 'পালিত অধ্যাপক' হিসাবে। এর আগে তিনি ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা ছিলেন। বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগদানের বেশ কিছুদিন পর, ১৯২১ সালে আশুতোষের অনুরোধে জাহাজে করে বিলেত পাড়ি দেন ভারতের বিজ্ঞান প্রতিনিধি হিসাবে। এই সময়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ইলেক্ট্রনের আবিষ্কর্তা থমসন ও বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের। এস এস নরকুন্ডা জাহাজে চেপে লন্ডন থেকে ফেরার সময়ে সমুদ্রের জলের নীল রঙ রমনের অনুসন্ধানী মনকে নাড়া দেয়। 'নীল আকাশের জন্যেই সমুদ্রের জল নীল দেখায়'- প্রচলিত এই ব্যাখ্যা তিনি সহজে মেনে নিতে পারেননি।
আরও পড়ুন- বিজ্ঞান থেকে বাণিজ্যে: বাঙালির নিজস্ব সুপারহিরোর আখ্যান ‘প্রফুল্ল রসায়নী’
আসলে বিজ্ঞানের জগতে আলো নিয়ে কাঁটা ছেঁড়া অনেক আগে থেকেই চলছিল। সূর্যের আলো খালি চোখে সাদা দেখায় - নিউটন দেখিয়েছিলেন একটা প্রিজমের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আলো সাতটি বর্ণে ভেঙে যায় - 'বেনিআসহকলা'- রামধনুতে যেমন দেখা যায় আর কী! প্রত্যেকটা বর্ণের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। বাতাসের ছোট ছোট অণুর দ্বারা আলোর যে এই বিক্ষেপণ তারই নাম রেইলি স্ক্যাটারিং। নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অন্যান্য রঙের চেয়ে কম, তাই নীল ছড়ায় বেশি। লর্ড রেইলি দাবি করেন, 'আকাশের নীল প্রতিফলনের জন্যই সমুদ্রের জল নীল দেখায়'। কিন্তু রমনের খটকা যায় না। জাহাজে বসেই তিনি আলোর বিক্ষেপণ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। বারবার পরীক্ষালব্ধ পর্যবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক তথ্য পর্যালোচনা করে, তিনি ও তাঁর সহকারী কৃষ্ণণ জানতে পারেন যে সমুদ্রের রঙ আসলে জলের অণু দ্বারা সূর্যালোকের বিচ্ছুরণের ফলাফল।
পরে রমন ও তাঁর সহযোগীরা কলকাতায় ফিরে এই আলোক-বিচ্ছুরণ বিষয়ক আরও অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু করেন। ৬০টি বিভিন্ন রকমের তরল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পান, আলোকপ্রবাহ তরলের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময়, এর একটি অংশ তরল কর্তৃক বিক্ষিপ্ত হয়ে ভিন্ন রঙ প্রদর্শন করে। মূলত এটি ঘটে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের কারণে। তাঁদের এ কাজ 'আ নিউ টাইপ অফ সেকেন্ডারি রেডিয়েশন' নামে প্রকাশিত হয় বিখ্যাত নেচার পত্রিকায়। তাঁদের গবেষণা পত্রে তাঁরা দেখান এই নতুন বিকিরণ 'ফ্লুরোসেন্স' বা প্রতিপ্রভা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, এমনকী এর শক্তিও বেশি। আবিষ্কৃত হয় রমন এফেক্ট। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন সি ভি রমন। এশিয়ায় বিজ্ঞানের প্রথম নোবেল আনেন তিনিই। এই কাজ তৎকালীন বৈজ্ঞানিক মহলে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে আবিষ্কারের পর দু-এক বছরের ভিতরে এই বিষয়ে কয়েকশো গবেষণা পত্র বেরোয় প্রথম সারির বিজ্ঞান পত্র-পত্রিকায়। আজকের দিনে শুধু আলোক বিজ্ঞান বা পদার্থবিজ্ঞানেই নয়- তাঁর কাজের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে আছে জৈব পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা এবং জীববিদ্যার বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
যুগান্তকারী এই আবিষ্কারের বহুদিন পরে, ১৯৮৬ সালে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কমিউনিকেশন তৎকালীন রাজীব গান্ধি সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয় ওইদিন জাতীয় বিজ্ঞান দিবস পালন করার জন্য। ভারত সরকারের বিজ্ঞান মন্ত্রক পরের বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনটি জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে পালিত হয়ে আসছে এই বিজ্ঞান দিবস। ১৯৮৮ সাল থেকে দেশের সমস্ত বিজ্ঞান গবেষণাগার এই একটিমাত্র দিনে জনসাধারণের জন্যে উম্মুক্ত থাকে- যাতে জন সমাজে বিজ্ঞান আবহ বা বিজ্ঞান সচেতনতা গড়ে ওঠে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম আরও বিজ্ঞান গবেষণার বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠুক, সেজন্যই এই প্রয়াস।