ইতিহাস ঠিক কতটা বিকৃত 'সম্রাট পৃথ্বীরাজ'-এ, কেন এমনটা করলেন অক্ষয়?
গত কয়েক বছর ধরে সিনেমা-শিল্প একরকমভাবে সরকারের মুখপত্র হিসেবেই কাজ করছে। আর সেই মুখপত্রে একেবারে সম্পাদকের ভূমিকায় রয়েছেন অক্ষয়।
তু হিন্দু বনেগা, না মুসলমান বনেগা,
ইনসান কি অওলাদ হ্যায়, ইনসান বনেগা।
দেশভাগের ক্ষত বুকে রয়ে গিয়েছিল হয়তো। বাস্তুহারা মানুষের আর্তনাদ হয়তো কানে বাজছিল। তাই প্রথম ছবি 'ধুল কা ফুল'-এ ধর্মের চেয়ে মনুষ্যত্বকে এগিয়ে রাখতে পেরেছিলেন যশ চপড়া। কিন্তু না জানি কত জল বয়ে গিয়েছে দোয়াবের বুক চিরে। তাই মেলবন্ধন, ভ্রাতৃত্বের গতানুগতিক ভাবধারায় নিজেকে ভাসিয়ে দেননি তাঁর ছেলে আদিত্য চোপড়া। বরং চারপাশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই নিজের ছবিতে হরিহরের নামে ধুনো দিয়ে, রক্তপাতের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন।
সিনেমা কার্যতই সমাজের দর্পণ। শুধু বই পড়ে নয়, সিনেমা দেখেও অনেক কিছু শেখা যায় বলেও প্রচলিত ছিল কয়েক বছর আগে পর্যন্ত। এখনও শিক্ষণীয় অনেক কিছুই রয়েছে বটে, তবে পাল্টে গিয়েছে পাঠ্যক্রম। আগে ছিল দেশ, কাল, সময়ের ঊর্ধ্বে মানবিকতার জয়ের আখ্যান। এখন তা বদলে হয়েছে, মানবিকতা, সৌহার্দ্য এবং ভ্রাতৃত্ববোধের ঊর্ধ্বে গিয়ে ধর্মপরিচয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার রীতি। বেশ কয়েক বছর ধরেই এই ধারা অব্যাহত।
‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’ (Samrat Prithviraj) ছবিটি এই সংকীর্ণ মানসিকতার নয়া ফসল। শাসকের চোখরাঙানির সামনে সবার আগে আভিজাতদের মাথা নত করার আরও এক নিদর্শন। নইলে যে সংস্থার মুকুটে ‘বীর-জারা’, ‘কাবুল এক্সপ্রেস’, ‘চক দে ইন্ডিয়া’, ‘নিউ ইয়র্ক’, এমনকী, টাইগার সিরিজের মতো ছবি পালকের মতো শোভা পায়, তারা হঠাৎ মেরুকরণের দিকে ঝুঁকবে কেন! ‘কাবুল এক্সপ্রেস’ এবং ‘বীর-জারা’-কে কখনওই এক গোত্রে ফেলা যায় না। আবার ‘চক দে ইন্ডিয়া’ এবং টাইগার সিরিজকেও রাখা যায় না এক বন্ধনীতে। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবিকতার নির্যাসই বেরিয়ে এসেছে ছবিগুলি থেকে। সেখানে ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’ হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী নায়কের গাথা হয়েই রয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: হিন্দিই জাতীয় ভাষা, অজয়ের মন্তব্যের আসল কারণ কী, কতটা বেকায়দায় বলিউড
এই নায়ক সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহান নন, কানাডা-র নাগরিক অক্ষয় কুমার, যিনি ভারতবাসীকে নয়া ইতিহাস রচনার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। জীবনে পড়াশোনাকে কখনও গুরুত্ব দেননি বলে এ-যাবৎ বড়াই করে এলেও, ভারতের স্কুলে ইতিহাস বইটি ঠিক কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে নিজের মতামত জানানোর মতো দুঃসাহস দেখাতে পারেন। তা-ও আবার পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ইতিহাস বইয়ের পাতা না উল্টেই, যাকে দুঃসাহস ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।
বক্স অফিসে কোটি কোটি টাকা লাভের স্বপ্নে মশগুল নায়ক যখন এত বড় স্পর্ধা দেখাতে পারেন, ইতিহাস বইয়ের পাতা উল্টে একবার দেখে নেওয়াও উচিত ছিল তাঁর। তাহলেই বুঝতে পারতেন, তাঁর জানা ইতিহাস ভুল। পৃথ্বীরাজ চৌহানের হাতে মৃত্যু হয়নি মহম্মদ ঘোরীর, বরং তাঁর মৃত্যুর প্রায় দেড় দশক পর মারা যান ঘোরী। হালফিলে গেরুয়া বসন হিন্দুত্ববাদীদের উর্দি হয়ে উঠলেও, রাজপুতদের কাছে গেরুয়া রংটি ফ্যাশন বই অন্য কিছু ছিল না। ঋতুবিশেষে পাল্টে যেত তাঁদের পাগড়ির রং। পৃথ্বীরাজ চৌহান নন, বরং সঠিক অর্থে ভারতের শেষ হিন্দু সম্রাট ছিলেন হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য ওরফে হেমু, মুঘলদের হাত থেকে দিল্লি পুনর্দখল করেছিলেন যিনি এবং পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে বৈরাম খানের হাতে মৃত্যু হয় যাঁর। সংযুক্তা পৃথ্বীরাজের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন না। কোনও কোনও বইয়ে পৃথ্বীরাজের ৪০ স্ত্রী-র উল্লেখ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ইচ্ছিনী কুমারী, ইন্দ্রাবতী, শশীব্রতা, কমলাবতী, পদ্মাবতী, তিলোত্তমা, চিত্ররেখা এবং সংযুক্তা— এই আট জনের নামের উল্লেখ মেলে।
কিন্তু বিকৃত ইতিহাসকে প্রকৃত ইতিহাস বলে দাবি করাই শুধু নয়, সেই অনুযায়ী ইতিহাস পুনর্লিখনের দাবিও বিগত কয়েক বছর ধরে জোরালো হয়ে উঠছে। নিজেদের দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিতেই মায়ানগরীর তাবড় তারকা-অভিনেতারা এ-যাবৎ এই ধরনের বিতর্ক এড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’ ছবির প্রচারের জন্য সেই খোলস ছেড়েও বেরিয়ে এসেছেন অক্ষয়। তাই সর্বসমক্ষে বুক বাজিয়ে দাবি করেছেন, ইতিহাসের পাতায় পৃথ্বীরাজকে নিয়ে দু’চার ছত্রই লেখা চোখে পড়ে। বরং আক্রমণকারীদের নিয়েই ভরিয়ে দেওয়া হয় পাতার পর পাতা। তাঁর সাফ কথা, "আমাদের রাজারাও কম বীর ছিলেন না। তাঁদের নিয়ে কেন লেখা হয় না?"
ইতিহাস পড়লে বোধহয়, এমন কথা বলতে পারতেন না অক্ষয়। কারণ চোল, চালুক্য, মৌর্য, গুপ্তদের কথা ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে রয়েছে।
নিজের অজ্ঞানতা সম্পর্কে যদিও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল অক্ষয়। পৃথ্বীরাজ চৌহানকে নিয়ে ছবির পরিচালক দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে গবেষণা করেছেন বলে দাবি তাঁর। তাই পরিচালকের গবেষণা থেকেই তিনি শিখেছেন, আলাদা করে ইতিহাস পড়ে দেখার প্রয়োজন পড়েনি বলে অকপট স্বীকারও করেছেন। প্রশ্ন এখানেই, নিজে ইতিহাস না পড়ে, কীভাবে ইতিহাসকে ভুল বলে দাগিয়ে দেওয়ার স্পর্ধা দেখাতে পারেন তিনি? কোন যুক্তিতে ইতিহাস নতুন করে লেখার দাবি জানানোর দুঃসাহস হয় তাঁর? উত্তর যদিও একেবারেই জটিল নয়। ছবির প্রচারে অক্ষয়ের গতিবিধিই তাঁর এই দুঃসাহসের উৎস তুলে ধরে। কারণ বিজ্ঞাপনের ভরসায় নয়, শপিং মলে, কলেজে গিয়ে লোক জড়ো করা নয়, খোদ সরকারবাহাদুরের হাত দিয়ে ছবির প্রচার করিয়েছেন তিনি। তাই কলাকুলশীদের জন্য নয়, সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের জন্য ছবির বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। চষে ফেলেছেন দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশ। পুরস্কার স্বরূপ হিন্দিবলয়ে করছাড় পেয়ে গিয়েছেন। আর সেখানেই সিনেমা শিল্প এবং রাজনীতির মধ্যেকার সুতোটুকু ছিঁড়ে খান খান হয়ে গেছে।
রাজনীতি এবং সিনেমা একেবারে ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করত, তেমন নয়। তবে কয়েক বছর আগে পর্যন্ত সম্মানজনক দূরত্ব বজায় ছিল। হিন্দু-মুসলিম মৈত্রী, সীমান্তের কাঁটাতারনির্ভর ছবিগুলি দূরত্ব লাঘবের কাজ করে এসেছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সিনেমা-শিল্প একরকমভাবে সরকারের মুখপত্র হিসেবেই কাজ করছে। আর সেই মুখপত্রে একেবারে সম্পাদকের ভূমিকায় রয়েছেন অক্ষয়। আর অত্যন্ত সচেতনভাবেই সেই দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি।
কারণ এর সঙ্গে অক্ষয় এবং সরকার, দু’পক্ষেরই পারস্পরিক স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। অক্ষয়ের হাত ধরে যেমন মায়ানগরীর ওপর বজ্রআঁটুনি ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর সরকার, তেমনই ভুরি ভুরি ছবিতে অভিনয় করেও দৌড়ে চিরকাল পিছিয়ে থাকা অক্ষয়, সরকারের সহযোগিতায় নিজেকে তিন খানের চেয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে মরিয়া। সেই কাজে দু’পক্ষই একপ্রকার সফল বলা যায়। নইলে একের পর এক খাজা ছবি উপহার দিয়েও, অক্ষয় প্রধানমন্ত্রীর ‘অরাজনৈতিক’ সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যান কী করে, আর হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলে ধরার দায়িত্বই বা দেশের অন্যতম অভিজাত প্রযোজনা সংস্থা যশরাজ ফিল্মস বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেয় কী করে!