কোথাও রসের হদিশ, কোথাও ঘিয়ের গন্ধ, উত্তর থেকে দক্ষিণে রাজ করছে বাংলার যেসব মিষ্টি
Bengals sweets : নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইয়ে বাঙালির মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে ছানার উল্লেখ নেই, জানেন কেন?
কথায় বলে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’, কিন্তু শেষ পাতে একটু মিষ্টিমুখ না হলে বাঙালির পেট পুজো ঠিক জমে না। মিষ্টি নাকি শুভ তাই, শুরুর আপ্যায়নে মিষ্টিমুখই ভরসা জোগায়। ফলত চড়া ব্লাড সুগার উপেক্ষা করে লুকিয়ে চুরিয়ে হলেও মিষ্টি বাঙালিকে খেতেই হবে। বাঙালির এই মিষ্টি প্রেমের ইতিহাসটা অনেক লম্বা, ঘরে তৈরি নারকেল নাড়ু কিংবা গুড় চাকতি থেকে শুরু করে আজকের দিনের নানা রকম বাহারি মিষ্টি, সবকিছুতেই রয়েছে এক রসনা তৃপ্তি এবং মননের সন্তুষ্টির ইতিহাস।
আজকের আধুনিক মিষ্টির যুগে মূল উপকরণ হল ছানা। কিন্তু প্রথম দিকে ছানা ও ছানার তৈরি মিষ্টি একরকম পরিত্যাজ্যই ছিল ধর্মীয় কারণে। পরবর্তীকালে ষোড়শ শতকে পর্তুগিজদের হাত ধরে বাঙালির পাতে পাকাপাকিভাবে আসন গ্রহণ করে ছানা। শোনা যায়, পশ্চিমবঙ্গের ব্যান্ডেল অঞ্চলে পর্তুগিজরা তাদের খাঁটি গড়ে তোলার পর শুরু হয় ছানার যাত্রা। ফলে সঙ্গত কারণেই নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইয়ে বাঙালির মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে ছানার উল্লেখ নেই, কিন্তু বাঙালির মিষ্টির ইতিহাসের সেই ছক ভাঙছে প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল -এর ‘রূপমঞ্জুরী’ উপন্যাসে ছানার মিষ্টির প্রচলন এর উল্লেখে।
আরও পড়ুন - শুধু ঝোল কিংবা অমলেট নয়, মিষ্টিতেও বিকল্প নেই ডিমের
এন্টনি ফিরিঙ্গির সেই বিখ্যাত ভোলা ময়রা থেকে শুরু করে একালের পরিচিত নবীনচন্দ্র দাস, যুগে যুগে এঁদের হাতের জাদুতেই বাঙালির আবেগের অপর নাম হয়ে উঠেছে মিষ্টি। ঘরোয়া কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানের ক্লাইম্যাক্স যে মিষ্টি, তার লম্বা জার্নিতে বাংলার নানা জেলা নিজেদের মতো করে রসদ জুগিয়ে এসেছে। আর তাই এরকম কিছু জেলার মিষ্টির উল্লেখ ছাড়া হয়তো সত্যিই বাঙালির জীবের স্বাদকে বর্ণনা করা অসম্ভব। সুতরাং, জানা যাক তাদের কথা।
বাঙালির মিষ্টি প্রেমের জার্নিতে যে সব মহিমায় থেকে গেছেন সে হল কলকাতার রসগোল্লা। ১৮৬৬ সালে কলকাতার বাগবাজারে নবীনচন্দ্র দাসের হাত ধরে তার আগমন। বাঙালির আবেগ এই রসগোল্লা, তাকে রীতিমতো লড়াই করে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে জয় করে বাংলা। কিন্তু এখানে তো যাত্রা সবে শুরু রসগোল্লার সঙ্গে কলকাতার কাঁচাগোল্লা, অমৃতি কিংবা লেডিকেনির স্বাদ সাথে নিয়ে হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে হুগলির চৌকাঠে পা রাখলেই বাঙালির মনে পড়ে যায় গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত ‘গুপো সন্দেশ’, ‘জানাইয়ের মনোহরা’ কিংবা সেই প্রচলিত জামাই ঠকানোর মিষ্টি ‘জলভরা’র কথা।
তারপর ট্রেন যখন সবে বর্ধমান ছুঁইছুঁই, বাঙালিকে হালকা বিরতি নিতেই হয় শক্তিগড়ের ল্যাংচা মহলে। শোনা যায় বর্ধমানের এমন এক কারিগর এই মিষ্টি তৈরি করেছিলেন যাঁর একটি পা ছিল ভাঙা, তাই সেই থেকেই নাকি এই ভাজা মিষ্টির নাম হয় ল্যাংচা। যদিও নামকরণ নিয়ে বিতর্ক আরও অনেক আছে। এরপর বর্তমান স্টেশনে নেমে বাঙালি চেখে দেখে চিরকালীন নস্টালজিয়া সীতাভোগ আর মিহিদানাকে। ১৯০৪ সালে বড়লাট জর্জ ন্যাথানিয়েল কার্জন -এর বর্ধমান আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে ভৈরব চন্দ্র নাগের হাতে জন্ম এই সীতাভোগ এবং মিহিদানার।
তারপর আবার অন্য ট্রেনে চেপে বীরভূম বাঁকুড়া আর পুরুলিয়ার পথে বাঙালিকে টেনে নিয়ে যায় তার রস নাই আমাদের ভালোবাসার তালিকায় নতুনভাবে সংযোজিত হয় বীরভূমের রসমালাই কিংবা বাঁকুড়ার মেচা সন্দেশ। অতঃপর পুরুলিয়ার কাস্তার লাড্ডু।
এরপর ধরুন ফিরতি পথে অন্য রাস্তা ধরে কাঁথির কাজু বরফি, ডেবরার মুগের জিলাপি, আর ক্ষীরপাই -এর বাবরসার স্বাদ নিয়ে নিলেই বাঙালির ষোলকলা পূর্ণ হয়ে যায় খানিক। আর তারপর যদি জয়নগরের প্রতি একটু হাঁটা দিয়ে পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুঁচকি বাবু এবং নিত্যগোপাল সরকারের শীতকালীন মোয়ার স্বাদ চেখে দেখা যায় তবে তো আর কথাই নেই!
না এত সহজে বিরাম নেই, এরপর আবার অন্য পথে স্বাদের যাত্রা। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের দুই বিখ্যাত মিষ্টি সরপুরিয়া এবং সরভাজা। দুধের সর এবং ঘি -এর এই রসায়ন বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রিয় নাম। প্রচলিত মতে, এদের সৃষ্টিকর্তা কৃষ্ণনগরের অধর চন্দ্র দাস। এছাড়াও নদীয়ার নবদ্বীপের কালিপদ মোদকের তৈরি লাল দই বা ক্ষীর দই অন্যতম প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন। শোনা যায়, হাজার ১৯৩০ সালে মিষ্টান্ন পরিবারের কুলীন সদস্য সাদা দই বা দধির এই নতুন রাঙা রূপে সেজে ওঠা এই নবদ্বীপেই।
নদিয়া ছাড়িয়ে মুর্শিদাবাদের পথে এগোলে বাঙালির স্বাদের ঝুলিতে যোগ দেয় বহরমপুরের বিখ্যাত ছানাবড়া। যাক, এতক্ষণে বাঙালির মিষ্টির থলি বেশ ভরে উঠেছে দক্ষিণবঙ্গের স্বাদে। ফলত দক্ষিণের পেট পুজো সামলে মিষ্টিপ্রেমী বাঙালির এবার নজর কাড়ে উত্তরের জেলাগুলোও। উত্তরবঙ্গের মালদহের বিখ্যাত মিষ্টি হিসেবে প্রথমেই আসে কানসাট এবং রসকদম্বের নাম। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে ওপার বাংলার শিবগঞ্জ জেলার কানসাট অঞ্চল থেকে প্রসিদ্ধ এই মিষ্টিটি ব্যবসায়িক মহেন্দ্রনাথ সাহার পুত্র বিজয় কুমার সাহার হাত ধরেই বাংলার মালদহে ক্ষীরের মিষ্টি, কানসাটের যাত্রা শুরু। অপরদিকে কথিত আছে, আলাউদ্দিন হোসেন শাহর রাজত্বকালে গৌড় বা মালদার রামকেলিতে এসে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব ফুল ভর্তি কদম গাছের নিচে বিশ্রাম নেন। এখানেই তিনি রূপ সনাতনকে দীক্ষা দেন। শোনা যায়, এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতেই মালদাহের কারিগরেরা তৈরি করেন রসকদম্ব বা রসকদম।
আরও পড়ুন - গুড়ের সন্দেশকে টেক্কা দিল চকলেট সন্দেশ! মিষ্টিমুখেও সাম্রাজ্যবাদ
এছাড়াও জলপাইগুড়ির চমচম, কোচবিহারের মন্ডা, শিলিগুড়ির লালমোহন বা গোলাপজাম কিংবা আলিপুরদুয়ারের বিখ্যাত কমলাভোগ, আজকের পরিচিত মিষ্টির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে, এ কথা অবশ্য স্বীকার্য।
কিন্তু উত্তর দক্ষিণ এত ঘুরেও বাঙালির এই মিষ্টি প্রেমের তালিকা কিছু হাতে গোনা অত্যন্ত জনপ্রিয় মিষ্টির নাম দিয়ে বিচার করা যায় না। সারা বাংলা জুড়ে আরো বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি রয়েছে, যারা প্রত্যেকেই বাঙালির মনের মহলে জাঁকিয়ে বসে রয়েছে। যেমন - গজা, খাজা, সন্দেশ, জিলিপি, বোঁদে, গুজিয়া, রাবড়ি, রাজভোগ, লর্ড চমচম, মালপোয়া কিংবা শীতের পিঠেপুলি সহ আরও কত কি! ভালোবাসার টানে জেলার গণ্ডি পেরিয়ে সারা বাংলার মিষ্টি আজ একাকার হয়ে গেছে। মিষ্টি তাই বাঙালির মননের তৃপ্তি থেকে জীবনের ছন্দে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল আছে এবং থাকবে।