চম্পাই সোরেন 'মাস্টারস্ট্রোক' হেমন্তের, এত করেও ঝাড়খণ্ডে বিজেপিকে রুখতে পারবে JMM?
Jharkhand Political Crisis: বিজেপির বিধায়ক কেনাবেচার ইতিহাস পুরনো। বিরোধীদের একাংশের আশঙ্কা, বিধায়ক কেনাবেচার ‘সময়’ করে দিতেই চম্পইকে সরকার গড়তে আমন্ত্রণ জানাতে দেরি করা হচ্ছে।
বিহারের পর পরই রাজনৈতিক মোড়বদল হয়ে গেল পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডেও। এককালে বিহারের ভিতর থেকেই পৃথক রাজ্য হয়ে বেরিয়ে এসেছিল ঝাড়খণ্ড। সেই পৃথক রাজ্যের দাবিতে যাঁরা লড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শিবু সোরেন। সেই শিবু সোরেনের ছেলে হেমন্ত সোরেন। তবে সেই হেমন্ত আপাতত জমি কেলেঙ্কারি মামলায় ইডি-র হেফাজতে। গ্রেফতারির আগে নিজে রাজ্যপালের কাছে গিয়ে পদত্যাগ করেন হেমন্ত। তার জায়গায় কে হতে চলেছেম ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী? এ নিয়ে জল্পনা চলছে বুধবার সারাদিন। শোনা যায়, হেমন্তের অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী কল্পনা সোরেনই হতে চলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তবে সেই বুধবারের সেই জল্পনায় জল ঢেলে বৃহস্পতিবারই পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা।
না, কল্পনা নয়। হেমন্ত সোরেনের মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য চম্পাই সোরেনের হাতেই দেওয়া হল ঝাড়খণ্ডের রাশ। শুধু মুখ্যমন্ত্রীত্বই নয়, দলের প্রধান হিসেবেও বেছে নেওয়া হল চম্পাই সোরেন। যতদূর জানা গিয়েছে, রাতেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরেই হেমন্ত সোরেন অনুগত হিসেবে পরিচিত চম্পাই। আগে রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রকের দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। হেমন্ত জানতেন, তাঁর গ্রেফতারির সুযোগে দলে অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে। এমনকী সেই সুযোগটা নিয়ে অন্য রাজ্যের মতোই ফাল হয়ে ঢুকতে পারে বিজেপিও। তাই সেই জায়গাটাই তৈরি হতে দেননি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। বরং ঝাড়খণ্ডের ক্ষমতাসীন মহাগাঠবন্ধনের বিধায়কদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে চম্পাই সোরেনকেই জেএমএম দলের সুপ্রিমো ঘোষণা করে গিয়েছেন। হেমন্তর জেলে যাওয়ার সুযোগ যাতে বিরোধীরা না নিতে পারে, তার জন্য ইডি-কে কার্যত শর্ত দিয়ে রাজভবনে গিয়ে ইস্তফা দেন হেমন্ত। যাতে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণের পথে কোনও বাধা না আসতে পারে।
আরও পড়ুন: পরিবারেই লুকিয়ে বিপদ! হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনার মুখ্যমন্ত্রিত্বের পথের কাঁটা কে?
তবে তার পরেও মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পথে কাঁটা বিঁধেই রইল চম্পাইয়ের। কৃষক পরিবারের সন্তান চম্পাই সোরেন ঝাড়খণ্ডে পরিচিত 'টাইগার' নামে। হেমন্ত সোরেনের বাবা শিবু সোপেনের সঙ্গে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন চম্পাই। তবে শুধু সেটাই কারণ নয়, চম্পাইকে বেছে নেওয়ার পিছনে। ঝাড়খণ্ডের কোলহান এলাকার ভূমিপুত্র চম্পাই। আর সেই কোলহান পরিচিত বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে। এখনও পর্যন্ত এই কোলহান এলকা থেকে মোট তিনজন মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছে ঝাড়খণ্ড। ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ঝাড়খণ্ডের রাশ ছিল অর্জুন মুন্ডার হাতে। ২০১৪ থেকে ১৯ পর্যন্ত রাজ্যশাসন করেছেন রঘুবর দাস। তাঁরা দুজনেই বিজেপির। তার পরেই বিজেপির হাত থেকে ক্ষমতা যায় ফের জেএমএমের হাতে। ২০১৩-র পর সেই উনিশ। ঝাড়খণ্ডের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী মধু কোডা ছিলেন কংগ্রেসের। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
মধু কোডাও অবশ্য হেমন্তের মতোই কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন শেষমেশ। সে যা-ই হোক, ২০১৯ সালের বিধানসভা ভোটে নিজেদের গড় কোলহানেই ভালো ফল করতে পারেনি বিজেপি। তেরোটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে সে বার সবচেয়ে শোচনীয় হার হয়েছিল ঝাড়খণ্ডেই। সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছিল জামশেদপুর (পূর্ব) আসনে। যেখানে বিজেপির টিকিট প্রত্যাখ্যান করে নির্দলের হয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন সর্যু রায়। তা-ও আবার রঘুবর দাসের বিপক্ষে। অর্জুন মুন্ডা ও রঘুবর দাসকে জেলে পাঠানোর পিছনেও কৃতিত্ব ছিল সর্যুরই। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হেমন্ত সোরেন যে বিরাট জনপ্রিয় ছিলেন তা নয়। তাই জন্য, দলের উত্তরাধিকারী এবং ঝাড়খণ্ডের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী তিনি এমন কাউকে বাছতে চেয়েছিলেন, যাকে দলের সকলেই পছন্দ করেন। রাজনীতির মাঠে এটা হেমন্তের মাস্টারস্ট্রোক বলেই মনে করছে অভিজ্ঞ। কোলহান বিজেপির যতই শক্ত ঘাঁটি হোক না কেন, কোলহানের 'টাইগার' চম্পাই সেই গড় হাসতে হাসতেই দখল করতে পারবেন বলে আশা করেছিলেন হেমন্ত।
তবে যতই বুদ্ধি খাটিয়ে সমস্ত হেমন্ত এসব করে যান না কেন, বিধি যেন বাম। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পথে এখনও পথে কাঁটা চম্পাইয়ের। হেমন্ত ইস্তফা দেওয়ার পরেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায়কের সমর্থনপত্র নিয়ে রাজভবনে গিয়েছিলেন চম্পাই, দাবি জানিয়েছিলেন সরকার গড়ার। তবে আঠেরো ঘণ্টা পেরোলেও আনুষ্ঠানিক ভাবে ঝাড়খণ্ডের শাসক জোটের নতুন নেতা চম্পইকে সরকার গড়ার আমন্ত্রণ জানাননি রাজ্যপাল সিপি রাধাকৃষ্ণণ। বৃহস্পতিবার বিকেলে ফের আরও একবার রাজভবনে যান চম্পাই। সঙ্গে যান জেএমএম-কংগ্রেস-আরজেডি জোটের কয়েক জন বিধায়কও।
৮১ আসনের ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় ৪৭ বিধায়কের সমর্থন তাঁর পিছনে রয়েছে বলে দাবি চম্পইয়ের। তা সত্ত্বেও ১৮ ঘণ্টা ধরে সরকার গড়ার আমন্ত্রণ না পেয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন চম্পই। বলেছিলেন, ‘‘অন্য রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে তো মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফার দু-তিন ঘণ্টা পরেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের নেতাকে সরকার গড়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়।’’ এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা দিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। সামনেই লোকসভা ভোট। এই সময়ে ঝাড়খণ্ড দখল করতে মারণ কামড় দেওয়ার যে কোনও চেষ্টাই বাকি রাখবে না বিজেপি, তা ভালোই বুঝতে পারছে জেএমএম। ফলে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে তাঁদেরও। বিজেপির আদবকায়দা সবই তাঁদের জানা। ফলে এই পরিস্থিতিতে বিজেপির হাত থেকে বিধায়ক বাঁচাতে বিজেপি বিরোধী মহাজোটের বিধায়কদের দু’টি চার্টার্ড বিমানে কংগ্রেস শাসিত তেলঙ্গানার রাজধানী হায়দরাবাদের রিসর্টে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
আরও পড়ুন:ইডি-র হাতে গ্রেফতার হেমন্ত সোরেন, কোন পথে এবার ঝাড়খণ্ডের রাজনীতি?
রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বেরোনোর পথে চম্পাই জানিয়েছিলেন, তাঁরা ৪৩ জন বিধায়ক ঐক্যবদ্ধ। সকলকে নিয়ে রাঁচির সরকারি গেস্ট হাউজে রয়েছেন তিনি। তবে ‘সরকার সমর্থক’ বাকি চার জন বিধায়ক কোথায়, তা নিয়ে কিছু বলেননি তিনি। রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চম্পইয়ের সঙ্গে ছিলেন কংগ্রেসের পরিষদীয় নেতা আলমগির আলম, আরজেডির সত্যানন্দ ভোক্তা এবং সিপিআইএমএল লিবারেশনের বিনোদ সিংহ এবং দলত্যাগী জেভিএম (বর্তমানে কংগ্রেস) বিধায়ক প্রদীপ যাদব। বিজেপির বিধায়ক কেনাবেচার ইতিহাস পুরনো। বিরোধীদের একাংশের আশঙ্কা, বিধায়ক কেনাবেচার ‘সময়’ করে দিতেই চম্পইকে সরকার গড়তে আমন্ত্রণ জানাতে দেরি করা হচ্ছে। সেই আশঙ্কাকে আরও দৃঢ় করেছে, ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল রাধাকৃষ্ণণের ‘রাজনৈতিক অতীত’। তিনি আবার তামিলনাড়ুর প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ তিনি। ফলে সময় যত গড়াচ্ছে, ঝাড়খণ্ডের রাজনীতি নিয়ে আশঙ্কা তত বাড়ছে। এক সপ্তাহও হয়নি ফের নতুন করে বিজেপির হাত ধরেছে বিহারের মুখ্য়মন্ত্রী নীতীশ কুমার। রাহুল গান্ধি-সহ কংগ্রেসের বহু নেতাই বলেছেন, নীতীশের উপর চাপ ছিল। গদি হারানোর ভয়েই কি তড়িঘড়ি রং বদলালেন নীতীশ! উঠেছে প্রশ্ন। বিহারের পর ঝাড়খণ্ডেও পুরনো খেলা খেলতে চলেছে না তো বিজেপি। হেমন্ত সোরেনের এত পরিকল্পনা, এত মেপে নেওয়া পদক্ষেপ জলে যেতে চলেছে না তো। তার উত্তর অবশ্য মিলবে আর কিছু সময় পরেই।