মোৎজার্ট অন্ত প্রাণ, বেঠোফেনকে নিয়ে ছবি করতে চাইতেন সত্যজিৎ রায়
Satyajit Ray as Music Director: সত্যজিৎ রায়, তাঁর চলচ্চিত্রের সংগীতের ব্যবহারে কিন্তু পাশ্চাত্যকে পাশ্চাত্য হিসেবে রাখলেন না আর।
প্রথমেই বলব, আমি খুব গভীরভাবে সত্যজিৎ রায়ের সংগীত-অনুরাগী। খুব ছোটবেলা থেকেই সত্যজিতের সংগীত তো আমাদের কানে আসছে, বিশেষত 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'-এর জন্য। যে বয়সে 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'-এর গান শুনেছি, তখন গানগুলো যে ওঁরই লেখা, ওঁরই সুর করা, এতকিছু জানতাম না। এটা আমি আমার ছোটবেলার কথা বলছি। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাহিত হয়েছে এই শ্রুতি। আজ যে আঠারো, তার ছোটবেলা, যে চল্লিশের দোরগোড়ায়, তার ছোটবেলা, যে পঞ্চাশ বা ষাটের কোঠায়, তারও ছোটবেলা কেটেছে দুটো চলচ্চিত্রের সংগীত শুনে। এক, 'গুপী গাইন বাঘা বাইন', দুই, ফেলুদা। ফেলুদাতে কোনও গান ছিল না। কিন্তু ফেলুদার সংগীত সকলকে খুব মুগ্ধ করেছিল, আলোড়িত করেছিল। খুব নতুন মনে হয়েছিল তা সকলের কাছে। 'গুগাবাবা'-র গানও ভীষণভাবে মোহিত করে রেখেছিল ছোট-বড় সকলকে। সেসময় তো ভিডিও বা ভিএইচএস-এ দেখেনি মানুষ ছবিগুলো, সিনেমা হলেই দেখেছে। তার অভিঘাত ছিল আরও বেশি। সেই মুগ্ধতা আমারও ছিল, এবং তা আজও অটুট রয়ে গেছে।
এর মাঝে একটা ঘটনা ঘটল। আমি পেশাদার সংগীতশিল্পী হলাম, এবং ডাক পেলাম ভায়োলিনিস্ট হিসেবে 'ঘরে বাইরে'-তে বাজানোর জন্য। 'ঘরে বাইরে'-র ফ্লোরে একটা বিশেষ মুহূর্ত আমাকে একেবারে বিস্ময়কর একটা জায়গায় নিয়ে গেল, যে বিস্ময় আমার এখনও রয়ে গেছে। যখন বিমলা অন্দরমহল থেকে বাহিরমহলে আসছে, তখন আমরা 'এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ'-এর একটা বিশেষ সাংগীতিক অর্কেস্ট্রেশন শুনলাম। আমার কাছে যা খুব আশ্চর্যের, তা হল, একটা সেতারে কত অল্প মিড় দিয়ে বাজানো হচ্ছে মেলোডিটা, এবং তার সঙ্গে ভিয়োলা, ভায়োলিন, চেলো- এগুলো যেন এই সাংগীতিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করছে এই সুরকে। এটা অকল্পনীয় সুন্দর তো বটেই, একই সঙ্গে যা বলার, এটা সম্পূর্ণ নতুন। রবীন্দ্রনাথের গানকে অন্যরকমভাবে দেখার পাঠ দিয়েছিল আমাকে সেই মূর্চ্ছনা।
এরপর 'চারুলতা' দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করি, সেখানেও তিনি এমন একটা বিষয় ঘটিয়েছিলেন। সেখানে 'মম চিত্তে' গানটাকে ধীর লয়ে ভূপতির বেদনার আবহে ব্যবহার করেছেন, এবং একটা অর্কেস্ট্রেশন করেছেন। যার কাঠামো-টা ভীষণভাবে ইউরোপীয়।
আরও পড়ুন: বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কথা সেদিন নস্যাৎ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়
এখন এই ইউরোপীয় কাঠামো তিনি কীভাবে পেলেন? আমার মনে হয়, পাশ্চাত্য সংগীত পাশ্চাত্যের নিরিখেই আমাদের দেশে বহু বছর আগে এসেছে। ঠাকুর পরিবারে যেমন এসেছে। রবীন্দ্রনাথের ভেতরেও বিশ্বভুবনের ধারণার মধ্যে মিশে গিয়েছিল পাশ্চাত্যের সেই সাংগীতিক চলাচল। কিন্তু সত্যজিৎ রায়, তাঁর চলচ্চিত্রের সংগীতের ব্যবহারে কিন্তু পাশ্চাত্যকে পাশ্চাত্য হিসেবে রাখলেন না আর। সত্যজিতের দেখায় এক নতুন পাশ্চাত্যকে আমরা ওঁর মিউজিক্যাল ফর্মের মধ্যে পেলাম। ফেলুদাতে পেলাম, 'ঘরে বাইরে'-তে পেলাম। বিশেষত আমার মনে পড়ে, 'মণিহারা'-তে উনি যেভাবে 'বাজে করুণ সুরে' ব্যবহার করলেন। সিংঘেন্দ্র মধ্যম রাগের নোটসগুলোকে খুব ভৌতিকভাবে ব্যবহার করতে পারাটা একটা অবিশ্বাস্য কাজ ছিল। বাঁশিতে সেই মোটিফটা বারবার ফিরে এসেছে। বা 'তিন কন্যা'-য় 'সমাপ্তি'-তে যে সাংগীতিক প্রয়োগ, যে কম্পোজিশন, যে অ্যারেঞ্জমেন্ট- তা অসাধারণ।
সত্যজিতের চলচ্চিত্রের সংগীতে যেমন কম্পোজিশনের সৌন্দর্য পাওয়া যায়, তেমনই ছবিকে যে আলাদা দ্যোতনা দেয় এই সংগীত, তাও বোঝা যায়। 'ঘরে বাইরে'-পরবর্তী সময়ে যখন তিনি শারীরিক কারণে সেটের মধ্যে ছবি করছেন, অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তা পূরণ করতে পারছেন না, তখনও কিন্তু ওঁর সংগীতের প্রয়োগ মুগ্ধ করে। 'গণশত্রু', 'শাখাপ্রশাখা' বা 'আগন্তুক'-এর সংগীতের নেপথ্যে যে ভাবনা, তা অনবদ্য! আমার মনে হয়, সাংগীতিকভাবে সত্যজিৎ সবসময় পরিণত হতে থেকেছেন। 'শাখাপ্রশাখা'-তে যেমন সরাসরি সত্যজিৎ ফিরে যান বেঠোফেনের কাছে, বাখের কাছে, গ্রেগরিয়ান চান্ট-এর কাছে। মোৎজার্ট ওঁর অসম্ভব প্রিয় ছিল। বেঠোফেনের ওপর উনি ছবি করতে চেয়েছিলেন।
ফলে, আমার মনে হয়, সত্যজিতের সিনেমার ভাষা নিয়ে যে চর্চা হয়, তা ওঁর সংগীত নিয়ে ততটা হয় না। চলচ্চিত্র এসেনশিয়ালি পশ্চিমের শিল্প আঙ্গিক। কিন্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রের যে অভিষেক ওঁর হাত ধরে ঘটেছে, তা নিয়ে কথা বলতেই হবে। কিন্তু ওঁর সংগীত নিয়ে কথা হয়েছে অনেক কম। অথচ, ওয়েস অ্যান্ডারসন তাঁর 'দ্য দার্জিলিং লিমিটেড' ছবির জন্য সত্যজিতের ছবির সংগীতের কপিরাইট নিয়েছেন এবং সমগ্র ছবিতে তা ব্যবহার করেছেন।
'পথের পাঁচালী'-ও, আমার মতে, যতটা রবিশঙ্করের, তার কিছুটা সত্যজিতেরও। যে বাঁশির সুর আমরা ওই ছবিতে শুনেছি, সেই অলংকারবর্জিত বাঁশি, যে গ্রামবাংলাকে আমাদের চিনিয়েছে, তা আমরা আগে দেখিনি। কাজেই সত্যজিৎ রায় এক্ষেত্রে নতুন এক পথের দিশারী। আজ শতবর্ষ পেরিয়ে তাই, নিজে একজন সংগীতকার হিসেবে সত্যজিৎকে আমি স্মরণ করব একজন শিক্ষক হিসেবে। চলচ্চিত্রে সংগীত কেমনভাবে করতে হয়, তা তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন।