বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কথা সেদিন নস্যাৎ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়
১৯৭৪ সালে 'সেপ্টোপাসের খিদে' যখন বেতার নাটক হিসেবে করব ঠিক করলাম, তখন একটা নাট্যরূপ দিয়ে চুক্তিপত্রসমেত পাঠাই সত্যজিৎ রায়কে। সেই চুক্তিপত্র আর খসড়া নাট্যরূপ পত্রপাঠ ফেরত দেন। সঙ্গে নিজের দেওয়া আরেকটা নাট্যরূপ, চুক্তিপত্রে উজ্জ্বল ওঁর সই। সংলাপ তো বটেই, সাউন্ড এফেক্টও উনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন সেই চিত্রনাট্যে। সেগুলো সম্পর্কে কিছু সংশয় থাকায় ওঁকে যোগাযোগ করি। তখন 'জনঅরণ্য'-র শুটিং চলছে। আমাকে বললেন, ঠিক পনেরো মিনিট সময় দিতে পারবেন, সন্ধে ছ'টায় যেতে হবে। আমি গেলাম ওঁর বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে। সেই পনেরো মিনিট দাঁড়াল গিয়ে চার ঘণ্টায়। আমার জীবনের একটা স্মরণীয় সন্ধে হয়ে থাকবে সেই দিনটা। সেইদিন আমি যা আহরণ করেছি, তা আজও ভাঙিয়ে খাচ্ছি।
সত্যজিৎ রায়ের এই গল্প, 'সেপ্টোপাসের খিদে', একটি মাংসাশী গাছ নিয়ে। বিপজ্জনক এই গাছটিকে ঘিরে যে রহস্য-রোমাঞ্চের উপাদান ছিল গল্পে, রেডিওতে তা ভাল খাপ খাবে বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু অডিওতে ওই গল্পের রূপায়ণ কীভাবে হতে পারে, সেই বিষয়ে আমার কাছে এক নতুন দৃষ্টিকোণ উন্মোচন করলেন সত্যজিৎ রায়। কোন শব্দের অভিঘাত কেমন হবে, কোথায় চাবুকের শব্দ ব্যবহার হবে, কোথায় পোষ্য কুকুরের চিৎকার, সেইসব ওঁর মাথায় ছিল মাপা। আমার উৎসাহ-উদ্দীপনা তো ছিলই, একই সঙ্গে ওঁর তাড়নায় তাই পনেরো মিনিটটা অনায়াসে গোটা সন্ধেয় পর্যবসিত হল। আর আপনি থেকে উনি নেমে এলেন তুমি-তে।
অভিনয়ের জন্য জরুরি যে পজ, সেটা আমি ওঁর কাছে সেদিন শিখি। চিত্রনাট্যে পরপর সংলাপ লেখা মানেই তো এমন নয় যে সেই সংলাপগুলো পরপর বলে দিতে হবে। আমাদের জীবনে আমরা কত সময় একটা কথা বলতে বলতে চুপ করে যাই হয়তো, পরে আবার বলি। জীবন যেরকম, উনি তো তেমনটাই নিয়ে এসেছেন ওঁর ছবিতে। অডিওর ক্ষেত্রেও কিন্তু উনি সেটাই বজায় রাখলেন। সেপ্টোপাস আস্তে আস্তে কীটপতঙ্গ ছেড়ে মানুষ খাওয়ার দিকে এগোচ্ছে। এই সময় কান্তিবাবুর সংলাপে পজ কীভাবে নিতে বলেছিলেন সত্যজিৎ, তার একটা উদাহরণ দিই।
'আচ্ছা পরিমল, (পজ) পনেরো বছর আগে (পজ) আসামের জঙ্গলে তুমি একটা বন্দুক ব্যবহার করেছিলে, (পজ) বন্দুকটা আছে এখনও?'
'হ্যাঁ, কেন বলুন তো?'
'টোটা? (পজ) আছে?'
'কেন বলুন তো?'
'বলা যায় না, (পজ) কাজে লাগতে পারে!'
আরও পড়ুন: মোৎজার্ট অন্ত প্রাণ, বেঠোফেনকে নিয়ে ছবি করতে চাইতেন সত্যজিৎ রায়
আমি বললাম, "বীরেনদা (বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র) বলেন, নাটকের মধ্যে যদি এত পজ নেওয়া যায়, তাহলে শ্রোতা ভুল ভাবতে পারে যে, রেডিও যন্ত্রটা বুঝি খারাপ হয়ে গেছে!"
"কে তোমাকে বলেছে একথা? এগুলো অ্যাক্টিং পজ! বিবিসি-র নাটক শোনোনি?" উত্তেজিত হয়ে বললেন সত্যজিৎ।
খুব খুশি হয়েছিলেন প্রমোদ গঙ্গোপাধ্যায়কে নেওয়ার বিষয়ে। আবার জয়ন্ত চৌধুরী অভিনয় করবেন এই নাটকে, শুনে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন একবার, ন্যাচারাল অভিনয়টা আবার অতি ন্যাচারাল হয়ে যাবে না তো? আসলে ওঁর মধ্যে সম্পাদনার বোধটা ছিল তীব্র, কতটা রাখব, কতটা রাখব না, এটা খুবই ভাল বুঝতেন। অভিনেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সেটা কাজ করত। সেজন্যই 'বাক্স রহস্য' বেতার নাটক করার সময় বিকাশ রায়কে নিলেন অভিনয়ে, কিন্তু সিনেমায় বিকাশ রায়কে দিয়ে উনি অভিনয় করাননি কিন্তু।
'অশনি সংকেত'-এর শুটিংয়ে গিয়েছিলাম আমি, আমার ভগ্নিপতি সুবীর গুহ 'জনঅরণ্য'-র প্রযোজক ছিলেন। সব মিলিয়ে ওঁর সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতা হয়ে গিয়েছিল। পাপিয়া চক্রবর্তী 'রয়েল বেঙ্গল রহস্য' নিয়ে নাটক করবেন, গৌতম চক্রবর্তী ফেলুদা হবেন। কারও সাহস নেই গিয়ে কনট্র্যাক্ট সই করাবে। আমিই গেলাম। আমাকে বললেন, "টেলিভিশন হলে কিন্তু অনুমতি দিতাম না, রেডিও বলেই দিচ্ছি, আর তুমি বলছ বলে।" খুবই খোলামেলা মানুষ ছিলেন সত্যজিৎ। আমি তাই একবার শম্ভু মিত্রকে পর্যন্ত বলেছিলাম, "আপনার থেকে সত্যজিৎ রায়ের কাছে যাওয়া সোজা।" শম্ভু মিত্রর সাক্ষাৎকার কেউ নিতে চাইলে, সে সাক্ষাৎকার নেওয়ার যোগ্য কি না প্রমাণ করতে তাকে আরেকটা সাক্ষাৎকার দিতে হত। সত্যজিৎ কিন্তু ছিলেন স্পষ্টবাদী ও সাদামাটা মানুষ।