টাইটানিক থেকে অবতার, সত্যজিৎ লুকিয়ে ছিলেন সর্বত্র
এলন মাস্ক যতই লাফাক না কেন, ব্যাপারটা অমঙ্গুলে হতেই পারে, এটা মাথায় ঢুকিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। আজ আর বলতে দ্বিধা নেই, আমার বয়সি ছেলেরা যখন গাঁতিয়ে ফুল হ্যান্ড ক্রিকেট খেলত বড় মাঠে, তখন আমাকে ওয়ান ড্রপ ওয়ান হ্যান্ড খেলতেও দলে নিত না গলি ক্রিকেটের স্টুডেন্টরা। কারণ আমি স্পিন খাওয়া বলের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, কী যে ভাবতাম, মনে নেই! বোধহয় ভাবতাম, এই বুঝি মহাবিশ্বের লীলা! পৃথিবীকে নিয়েও আসলে বুঝি কেউ ক্যাচ ক্যাচ খেলছে, আর তা করতে করতেই ড্রপ খাওয়া বল ভেঙে দিত উইকেট। তাই আমি ঘুড়ি ওড়াতাম। কিন্তু মুশকিলটা হল, বিশ্বকর্মা পুজো ছাড়া সারা বছর লোকে যেহেতু আকাশকে খুব একটা খাতির করত না, তাই ঠা ঠা রোদে গোটা নীলে আমার ঘুড়িটাও একা একা দাঁড়িয়ে থাকত আমার মতো। তাই আমি তারপর ঘরে চলে এলাম, আর আমার হাতে এল 'ব্যোমযাত্রীর ডায়রি'। তখনই প্রথম জানলাম, মঙ্গল ব্যাপারটায় খটকা আছে। 'টাফা'-র মতো কিছু খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত গ্লোবাল ওয়ার্মিং, প্যানডেমিক, মব প্যাঁদানির হাত থেকে রেহাই আমাদের তেমন একটা নেই। অর্থাৎ, কল্পনাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ নভোযান। আসল ব্যাপারটা হল, অকালপক্ক অবস্থায় শঙ্কুর ল্যাবরেটরিতে ঢুকে পড়া। কারণ, ওখান থেকেই পেয়েছিলাম কল্পনার নভোযানের বোর্ডিং পাস। প্যারালাল ইউনিভার্সের অবলিক শর্টকাট।
নিউটন-প্রহ্লাদদের দুনিয়ায় যেমন যা ইচ্ছে তাই হতে পারে, তেমনটা হতে থাকে আমাদের মনেও। কয়েকজন বিভিন্ন জায়গায় থাকা জ্ঞানী বিজ্ঞানীকে স্বপ্নে নিমন্ত্রণ করে, তাদের পাণ্ডিত্যকে কাঁচামাল বানিয়ে একটা গোটা দ্বীপ আলোকিত করা যায়- এই ইন্টারডিসিপ্লিনারি এনার্জি থিওরি ব্যাপারটা কনজার্ভেশন তত্ত্বকে অ্যায়সান বুড়ো আঙুল দেখায় যে, গোটা ক্লাসে যখন সবক'টা ছেলেমেয়ে মুখ বুজে বোরিং ফিজিক্স ম্যামের কথা মেনে নিচ্ছিল, তখন বুক ঠুকে বলতে ইচ্ছে করেছিল, চলুন 'স্বপ্নদ্বীপ', আপনাকে স্পষ্ট দেখাচ্ছি, এনার্জি ক্যান বি পড়ে পড়ে ক্রিয়েটেড অ্যান্ড বলে বলে ডেস্ট্রয়েড।
কিন্তু সত্যজিতের সেই স্বপ্নদ্বীপ তো আর নিছক গল্পের জন্য বানানো কোনও মগের মুলুক নয়, একটা প্রফেসির মতো, দিব্যদর্শন। যা মাথার মধ্যে একটা ঝলমলে বোটানিক্যাল গার্ডেনের সন্ধান দেয়, অনেক পরে জেমস ক্যামেরনের 'অ্যাভাটা' বা 'অবতার' দেখতে গিয়ে খালি মনে হয়, এই জঙ্গলে আগে ঘুরে গেছি। ঠিক যেমন, 'ইন্টারস্টেলর'-এর টার্সকে দেখলে মনে হয়, ও আগের জন্মে নিশ্চয়ই বিধুশেখর ছিল।
আরও পড়ুন: শঙ্কুর শেষ গল্পে লুকিয়ে ছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার অশনি সংকেত?
আসলে সায়েন্স ফ্যান্টাসি ব্যাপারটায় যে স্কুলকাল থেকে নেশাগ্রস্ত হয়েছিলাম, এর কারণটাই সত্যজিৎ রায়। এবং ফিজিক্স যে আসলে প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের ব্যবহারযোগ্য একটা বিদ্যা, এটা ভেক্টর-স্কেলার পড়ার বহু আগেই জেনে গিয়েছিলাম, ফেলুদা যখন থুতু ফেলতে গিয়েও প্যারাবোলিক কার্ভের কথা বলেছিল। যে মুহূর্তে টাইটানিক জাহাজ থেকে জ্যাক আর রোজ থুতু ফেলার কম্পিটিশন করে একটা অকারণ মজা পাচ্ছিল, সেসময় আমি বুঝতেই পেরেছিলাম, এটা স্রষ্টার ফেলুদা না পড়ার কুফল। ইনফ্যাক্ট, একটু বড় হয়েও যখন উইন্সলেটের প্রেমে পাগল হয়ে 'ইটারনাল সানশাইন অফ দ্য স্পটলেস মাইন্ড' দেখতে বসেছি, তখনও সত্যজিতের কিশোর ইউনিভার্স পিছু ছাড়েনি। 'লাকুনা, লাকুনা' বলে এত কিছু করে ব্যাপারটা যখন পুরোটা প্রকাশ পেল, তখন দেখলাম বেসিকালি জিনিসটা যেন শঙ্কুর রিমেমব্রেন, সফটওয়্যার আপডেট নেয়নি বলে বাগ-এ ভরে গেছে।
আমাদের কিশোরকালে ইন্টারনেট এতটা সহজলভ্য ছিল না, সত্যজিতের কিশোর সাহিত্য ছিল। আর মজার কথা হল, যারা সেসব পড়েনি, তারাই হাইস্কুলে লেননের গানের চাইতে ওর এল.এস.ডি. ট্রিপের গল্প নিয়ে বেশি রোমাঞ্চিত হয়েছে। কারণ লালমোহনবাবু যখন কাঠমান্ডুর হোটেলে পায়ে পিষে পিষে 'মাইস্' মেরেছে, তখন তারা গাঁতিয়ে ফুলহ্যান্ড ক্রিকেট খেলে বেড়িয়েছে।
সত্যজিতের কিশোর ইউনিভার্স আসলে তো নিছক কল্পনার উদ্যান নয়। একটা স্কুল যেখানে আটটা-ন'টার সূর্যের মতো মন হোক বা কাঁচা আমির মতো মন হোক, সকলেরই জীবনের বহু কিছু জানা প্রথম জানা হয়। সারা জীবন ধরে বয়সের পরতে পরতে নতুন তথ্য বা তত্ত্ব যখনই সামনে আসে, এক অবাক কৃতজ্ঞতা জাগে। মনে হয়, সেই কবে তো জানতাম এটা। শিখেছিলাম সত্যজিতের কিশোর ইউনিভার্সের স্কুলে। ঘড়ির কোম্পানির নামে শেষ 'টি'-টা উচ্চারণ না হয়ে টিসো হোক বা ফিনিক্সের ধারণার উদ্ভব, সবই আমরা কিশোর বা শিশুকালে জেনে গেছি সত্যজিতের হাত ধরে। সত্যজিৎ আসলে শুধু গল্প বলতে বোধহয় চাননি, একটা প্রজন্ম তৈরি করতে চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মননের, জ্ঞানের। কে জানে, বিশ্বায়ন বা ডেটা সায়েন্সের পৃথিবী হয়তো আঁচ করেছিলেন গত শতাব্দীতে বসেই।
আর মজার ব্যাপারটা হল, এর প্রভাব অনুভব করা যায় ঘন ঘন, সারা জীবন। মৃগাঙ্কবাবুর কথা ধাঁ করে মনে পড়ে গেল, যখন কলেজে উঠে কাফকা পড়তে হয়েছিল। ছবি আঁকার সুবাদে অবনীন্দ্রনাথ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যখন শুরু হল, হঠাৎ চমকে গেলাম, কারণ 'কুটুম কাটাম' শব্দের মজা ছেলেবেলাতেই চাখিয়ে দিয়েছেন সত্যজিৎ।
অনেক সময় যারা মনের দিক থেকে অনেক বয়সে বড় আর ভারী হয়ে গেছে, তারা বলত, এসব আমার বাড়াবাড়ি। সবেতেই সত্যজিতের কিশোর ইউনিভার্সের রেফারেন্স আসলে একপ্রকার ওসিডি। আমিও তাই অবসেশন আর কম্পালশন থেকে বেরনোর চেষ্টা করলাম প্রাণপণে। একদিন শ্রীঅরবিন্দর জীবনীর মতো গম্ভীর ব্যাপারস্যাপার পড়তে পড়তে অমিতাভ বুদ্ধর কথা পড়লাম। তা যা হয়, একটা থেকে একটায় আমরা চলে যাই যেমন। বৌদ্ধ যোগীদের মতো গম্ভীরতর একটা ইতিহাসে গিয়ে প্রথমেই দেখি, জ্বলজ্বল করছে একটা নাম, যা আমার ভারী মনের বন্ধুদের ওসিডি তত্ত্বকে ঘ্যাঁচ করে কেটে দিয়ে ছেলেবেলার আকাশের একাকী ঘুড়িটার মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল ডুলুংডো-র রাস্তায়। যেখানে যাওয়ার আগে শঙ্কু মৌনি লামার কাছে খোঁজ করেছিল মিলারেপা-র। বৃদ্ধ লামার মতো আমার কিশোর মনটা হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হল আর কোনও কথা না বলে ডান হাতের তর্জনীটা সোজা তুলে বসে রইল। মানেটা বুঝতে অসুবিধে হল না– সত্যজিৎ একজনই ছিলেন, তিনি আজও কোনও মন্ত্রবলে আমাদের মনকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেন তার কিশোর ইউনিভার্সে। যখনতখন।