বসন্তকালেই ঋতুপর্ণার সঙ্গে ভাব! ওর শরীর-বিছানো তেপান্তর আমাকে টানে

Rituparna Sengupta: ঋতুপর্ণার যৌন আবেদনের বুননে–বুননে ছড়িয়ে আছে ভারতের কামসূত্র।

যে মেয়ের সঙ্গে ভাব হতে না হতেই আড়ি হয়ে গেল, সেই মেয়ে ঋতু ! আড়ি মানে তুমুল আড়াআড়ি। ঋতু তখন সবে তারকাসরণির অনিশ্চিত উড়ানে। আর আমি লিখলাম, ঋতুর সাক্ষাৎকার নিয়ে, একটি লেখা সর্বোত্তম বাংলা সংবাদপত্রে। মনে আছে, বসন্তকাল! দোলের সময়। অনেক রাত্রে ঋতুর ইন্টারভিউ। ঋতুর কপালে-গালে কার দেওয়া আবির? একটি ইশারাময়, ইঙ্গিতপূর্ণ, ঈষৎ দুষ্টু লেখা লিখলুম আমি, যেমন আজও লিখি। ঋতুর মানে লাগল। অভিমানেও! সে সোজা নালিশ করল আমার নামে সর্বোত্তম সংবাদপত্রটির তৎকালীন ঈশ্বর, প্রধান সম্পাদকের কাছে।

এরপর দস্যু মোহনের লেখক শশধর দত্তর সাহায্য নিতেই হচ্ছে : কোথা হইতে কী হইল, সব মিটমাট হইয়া গেল। ঋতু আর আমি সেই যে জুড়ে গেলাম, আর আলগা হলো না বাঁধন, বিঘ্নিত হলো না সখ্য। ছায়াপাত ঘটেনি পারস্পারিক প্রবাহে। তার প্রধান কারণ, আমার ক্রমান্বিত ঋতুপর্ণা মুগ্ধতা! আমি ক্রমাগত প্রেমে পড়তে লাগলাম ঋতুর অভিনয় প্রতিভার, ঋতুর রূপ ও উপস্থিতির প্রকাশের, এবং ভেসে গেলাম তার বিচিত্র টানের অন্তরস্রোতে। ঋতুকে নিয়ে কত যে লিখেছি এক সময়ে, ঠিক নেই। সেই সময়ে সিনেমা-প্রাসঙ্গিক জার্নালিজম ছিল আমার নেশা। তারপর নতুন লেখকরা এলেন। সিনে-সমালোচনার স্টাইল, ভাষা, ভাবনা, চরিত্র, সব পাল্টে গেল। আমি গড়িয়ে গেলাম সিনে-লেখা থেকে ভিন্ন এবং বিচিত্র লেখালেখি এবং সাহিত্য চর্চার প্রতত পরিসরে। কিন্তু এই ব্যাপক পরিবর্তনের সমস্ত অভিঘাত পেরিয়ে ঋতুর সঙ্গে আমার সখ্য শুধু থেকেই গেল না, তার গায়ে পড়ল গভীর পারস্পরিকতার ছাপ!

ঋতুর প্রায় সব ছবিই আমি দেখি, শুধু ওর টানের জন্য। যে কোনও দুর্বল ছবিতেও ঋতুর উপস্থিতি, গ্ল্যামার, এবং প্রতিভা শকুন্তলার আংটির মতো। ওই অনন্য অভিজ্ঞানের প্রেমে পড়েছি আমি। ঋতুর উপস্থিতি ক্ষণিক ঝিলিকে জাগিয়ে দেয় তার প্রতিভার পরিসর।

আরও পড়ুন: ‘সৃষ্টির তাড়নাই আমার কাছে যৌনতা’, বলেছিল প্রসেনজিৎ

আমার মনে পড়ছে একটি দৃশ্যের কথা। সম্ভবত সৌমিত্র–ঋতুর শেষ ছবি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ঋতুর বাবার ভূমিকায়। সন্ধেবেলার দৃশ্য। বাবা–মেয়ে বাড়ির বারান্দায়। মেয়ের বিয়ের পরে কয়েক বছর কেটে গেছে। মেয়ের সন্তান হলো না কেন? বাবা সৌমিত্রর মনে দেখা দিচ্ছে দুশ্চিন্তা। মেয়ে কি সুখী হতে পারেনি? কোথায় যেন একটা উপবাসের ইশারা পায় সৌমিত্রর মন। অসাধারণ ইন্দ্রিয়ঘন, স্পর্শময় সেই দৃশ্যে সৌমিত্র প্রশ্ন করে মেয়েকে, তোদের সন্তান হলো না কেন?

- সম্ভব নয়, জানায় ঋতু। বাবার সামনে, পায়ের কাছে বসে। সেই করুণ, মৃদু, সংক্ষিপ্ত, অভিঘাতী উচ্চারণ আর ঋতুর আঁখিপাতের আর্দ্র ইন্দ্রিয়ময়তা, ভুলব না কোনও দিন। আমাকে হন্ট করবে বাকি জীবন।

সৌমিত্র জানতে চান, কেন সম্ভব নয়?

ঋতু জানায় এমন ভাবে ও ভঙ্গিতে, এমন নিবিড় উচ্চারণে, যা আন্ডারঅ্যাকটিং-এর মিরাকল, বাংলা সিনেমায় বিরল। সে শুধু বাবাকে বলে, তার স্বামী ‘গে’! সৌমিত্র হতাশায় গর্জে ওঠেন, এক্ষুনি ডিভোর্স করো। আবার ঋতুর শরীর ভাষা, উপোসী ইচ্ছে ও মর্মবেদনা আমাকে গ্রাস করে। আমি বুঝতে পারি এই দৃশ্যে ওর বিরল প্রতিভার মূল্যের পরিমাণ।

ঋতু শুধু বলে, বিয়েতে শরীরের ভূমিকা নিতান্ত সীমিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ভূমিকা স্থিমিত হয়ে আসে। যা চিরকাল থেকে যায়, তার চিরকালের বন্ধুত্ব। সে তার ‘গে’ বা সমকামী স্বামীর মধ্যে পেয়েছে এক নিখাদ বন্ধুকে। যাকে সে ডিভোর্স করতে পারবে না।

খুব ছোট্ট একটি দৃশ্য। কিন্তু অলৌকিক প্রতিভা ঋতুর ! সে শুধু সংলাপের উচ্চারণ, ছবির আবেদন, সমস্ত শরীরে ফুটিয়ে তোলা উপোস, এবং তৃষ্ণা– সব কিছু দিয়ে তার চরিত্রটিকে নিয়ে গেল ট্র্যাজিক তুঙ্গে ! এই ঋতুকে আমি ভালবাসি!

‘পারমিতার একদিন’ থেকে ‘বসু পরিবার’ থেকে ‘ব্যতিক্রম’ থেকে ‘ধারাস্নান’, ‘বারান্দা’ থেকে ‘আরও একবার’ (যে ছবিতে ঋতুর সঙ্গে আরও দুই প্রিয় মেয়ে, রূপা আর ইন্দ্রাণী), ‘দহন’ থেকে ‘তদন্ত’ থেকে ‘নায়িকার ভূমিকায়’ থেকে ‘ত্রয়ী’ থেকে ‘অলীক সুখ’। এবং ‘চারুলতা ২০১১’– যে ছবির কথাই মনে পড়ছে, আমি জড়িয়ে আছি আমার দীর্ঘসময় ব্যাপী ঋতু-অবসেশনে। সত্যিই এই প্রান্তিক বয়সেও ‘ঋতু অবসেসড্’ আমি। মরে যাব একদিন। এই পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য, গাছ, ফুল, লতাপাতা, আকাশ ভরা মেঘ-বৃষ্টি-তারা, নদী-পাহাড়-তেপান্তর– সব পড়ে থাকবে, হারিয়ে যাবে, আমার সব পাওয়া শেষ হয়ে যাবে। আর আমার শকুন্তলার আংটি ঋতু, তাকেও আর পাব না। মৃত্যুর পরেও কি মন কেমন থেকে যাবে?

Rituparna Sengupta in a book launch

ছবি সৌজন্য: লেখক

ঋতুর শরীর-সৌন্দর্য, কান্তি-উপত্যকা বলতে আমার দুটি ছবি বিশেষভাবে মনে পড়ে। ‘চারুলতা ২০১১’ আর ‘অলীক সুখ’! ঋতু যে একই সঙ্গে শরীর-বিছানো তেপান্তর, শরীর-প্রবাহী অলকানন্দা, শরীর-উপোসী ও শরীর-দহিত মরুভূমি ও মরীচিকা– বুঝেছি আমি ‘অলীক সুখ’ আর ‘চারুলতা ২০১১’ দেখে। আধুনিক সেক্সুয়ালিটির প্রসারিত উপত্যকা ঋতুর আবেদনে। ওর ধারে কাছে কেউ নেই। ঋতুর আবেদনের বুননে–বুননে ছড়িয়ে আছে ভারতের কামসূত্র। ঋতুর বাৎস্যায়নের ড্রিম-কাম-ট্রু। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমার কী ভাগ্য! ঋতুর সঙ্গে একই আকাশের তলায় এত বছর আছি। আর কালিদাসের কী দুর্ভাগ্য– ঋতুকে না জেনে তিনি লিখলেন কুমারসম্ভব!

More Articles