মহাভারতে সতীত্বের কোনও চিহ্ন নেই, বলেছিলেন রাধাপ্রসাদ গুপ্ত
Bengali Journalism: আজকাল দেখেছি অধিকাংশ সাংবাদিক নানা বিষয়ে পড়াশোনা করেন না। একটা সময় এমন ছিল না।
সুচিত্রা সেনের স্তন থেকে উপনিষদের ব্রহ্মদর্শন। অমর্ত্য সেনের ছায়া-অর্থনীতি থেকে বাল্মীকির মৌরিও মদ। হেমিংওয়ের গদ্য থেকে কার্ল মার্কসের শিশ্নর আকার ও উগ্রতা- কোনও বিষয়ই জার্নালিজমের নাগালের বাইরে নয়। যে চিঠি ঠিকভাবে ঠিক ঠিকানায় পোস্ট করা হলো, কিন্তু সেই-ই চলে গেল হারানো চিঠির বাড়িতে, সেইসব হারানো চিঠি নিয়ে মার্কেজের লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন জার্নালিজম কোন বিন্দুতে যেতে পারে। কিন্তু খবরের কাগজের লেখাকে সেই বিন্দুতে পৌঁছে দিতে রপ্ত করতে হবেই তিন-চারটি বিষয়। এক, লেখার স্টাইল। দুই, গদ্যের গতি। তিন, ভাবনার বুনন। চার, সাংবাদিকের চর্চার প্রসার। অর্থাৎ সাংবাদিকের লেখাপড়া। দুঃখের বিষয়, আজকাল দেখেছি অধিকাংশ সাংবাদিক নানা বিষয়ে পড়াশোনা করেন না।
ওই যে বললাম ভাবনার বুনন, ওই ব্যাপারটা বহুস্তরী। ভাবনায় অনেগুলি স্তর এনে তাদের বহুমাত্রিক বুননে বিস্তার করা কিছুতেই সম্ভব নয় লেখকের নিজের চর্চা ছাড়া। এই চর্চা আমি দেখে মুগ্ধ হয়েছি নিখিল সরকারের (শ্রীপান্থ) লেখায়। নিখিলদার সঙ্গে বহু বছর কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি অবাক হয়েছি, তাঁর লেখাপড়ার পরিধি দেখে। নিখিলদা মূলত সাংবাদিক। কিন্তু কালীঘাটের পট বা গঙ্গার ইলিশ বা কলকাতার রসমঞ্জরি, যা নিয়েই তিনি লিখুন, স্তরে স্তরে তিনি যেভাবে, যেসব উদ্ধৃতি এবং তির্যক ইঙ্গিত দিতে দিতে লেখাটিকে এগিয়ে নিয়ে যান, আজকের অধিকাংশ সাংবাদিক তা পারেন না। নিখিলদার নিজের লাইব্রেরি ছিল দেখার মতো। প্রফেশনাল লাইব্রেরিয়ানকে দিয়ে তিনি সাজিয়েছিলেন নিজের বাড়ির পাঠাগার। দেখার মতো ব্যাপার হয়েছিল। সেই লাইব্রেরিতে নিখিল সরকার আমাকে দিয়েছিলেন লেখাপড়ার সুযোগ। এবং আমাকে পথ ও পদ্ধতি দেখিয়েছিলেন, কীভাবে সাংবাদিকের লেখাপড়া করা উচিত।
আরও পড়ুন: ‘হিমালয়ের মতো পথ আগলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাই দুম করে মারলাম হিমালয়কে লাথি’
নিখিলদার পরেই যিনি আমার গুরু, তিনি রাধাপ্রসাদ গুপ্ত। শর্ট করে সকলের ভালবাসার আরপি। আরপি-র বাড়িতে প্রায় যেতাম পায়ের কাছে বসে রাম পান করতে আর বকুনি খেতে আর সাংবাদিকের চর্চার আভাস পেতে। এমন বহুমুখী পণ্ডিত, সত্যজিৎ রায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া, আমি কাউকে দেখিনি। আরপি কিছুটা অলৌকিক। কলকাতার ফেরিওয়ালাদের নানাবিধ শব্দ বা বাঙালির মাছ খাওয়া নিয়ে দু'খানা বই লিখে ফেললেন। এই মাত্রার রোচক লেখা কোথায় আজকের সাংবাদিকতায়? কালীঘাটের পট নিয়ে রাধাপ্রসাদের লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, আজকের সাংবাদিক আর স্কলার হতে চান না। তাই আজকের সাংবাদিকতা ক্রমে হারিয়ে ফেলছে বিবিধ চর্চার অভিজ্ঞান! মনে আছে, এক বৃষ্টির সন্ধ্যা। আরপি-র সঙ্গে রাম খাচ্ছি আর মহাভারত চর্চা করছি। হঠাৎ আরপি বলতে শুরু করলেন মহাভারতের যুগে সতীত্ব নিয়ে। বললেন, সতীত্বের কোনও চিহ্ন নেই এই মহাকাব্যে। ইনফ্যাক্ট, মহাভারত অ-সতীত্বর মহাকাব্য! আর একদিন বলেছিলেন, ব্র্যাডম্যান ভার্সেস লারুড প্রসঙ্গে। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ থেকে লারুড-এর বডিলাইন, সবই আরপি-র চর্চার বিষয়। তিনি আমার আর এক গুরু এবং প্রেরণা।
সুনীলদার আড্ডায়, মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে বা ক্লাবে বা কোনও মজলিশে আমি কখনওই, কোনও দিন মধ্যমণি হইনি। শুধু নীরব শ্রোতা হয়ে শুনেছি। কখনও বলছেন রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে। বলছেন রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতাই আর পড়া যায় না, এতটাই সময়ের দ্বারা আহত এইসব লেখা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান চিরদিনের। রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে যখন আলোচনা করতেন, মনে হতো কী মৌলিক ও সাহসী ভাবনা তাঁর! আহা! আজকের সাংবাদিকরা সেইসব আলোচনা ও চর্চার স্বাদ থেকে নির্বাসিত! একদিন সকালে সুনীলদা এলেন আমার ফ্ল্যাটে। সেই আড্ডায় সুনীলদা আর আমার প্রয়াত বন্ধু শঙ্কর ব্যানার্জি, যে সত্যিই রসের সাগর। সুনীলদা পান করছেন আর গাইছেন পুরনো বাংলার বেআব্রু গান। গান গাইছেন এবং ব্যাখ্যা করছেন। লিখলে এটাই সাংবাদিকতায় তুঙ্গ স্পর্শ! তখন আমি একটা টিভি শো শুরু করলাম আমার রবীন্দ্রনাথ নামে। সুনীলদা আমার এই শো-র প্রথম অতিথি। স্টুডিওতে এলেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বলার জন্য। এবং বললেন অনেক রবীন্দ্র-বিরোধী কথাও। অন্তত আপাতভাবে রবীন্দ্র-বিরোধী। এইভাবে আজকের লেখকরা বা সাংবাদিকেরা আর বলেন না। মনে হলো, সুনীলদার পায়ের কাছে বসে শুধু শুনি।
সুনীলদার সঙ্গে সেই প্রসারিত ও মৌলিক ভাবনার চর্চাও শেষ হয়ে গেছে। লেখাপড়াকে আজকের বেশিরভাগ সাংবাদিক ও লেখক ভয় পায়। আর আমি তাঁদের লেখায় বহুস্তরের অন্তর স্রোত আর পাই না। সুনীলদা যখন 'সেই সময়' লিখছেন, সেই সময়ের সুনীলদাকে মনে পড়ে। কী গভীর, মগ্ন, ডুবে থাকা অথচ সাবলীল সুনীলদা। অবাক হয়ে নীরব মুগ্ধতার অঞ্জলি দিয়েছি।
কেন চলে গেল লেখাপড়ার সেই দিন? চর্চার সেই প্রকাশ? মৌলিক ভাবনার সেই বুনন ও সাহস? উচ্চারণের সেই প্রত্যয়? ফিরবে কি? আবার আমরা কি বইমুখো হবো এই ভাবনা থেকে যে, লেখার জন্য পড়া, এবং পড়ার জন্য লেখা?