মারাঠা বর্গী হয়ে উঠেছিলেন বাংলার জমিদার || গা ছমছমে গল্প জড়িয়ে এই রাজবাড়ির সঙ্গে
"খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে
বুলবুলি তে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।"
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই ছেলেভুলোনো ছড়াটি রচিত হয়েছিল, দুষ্টু ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর জন্য। কিন্তু এই বর্গী কারা? তাদের নাম করে ভয় দেখিয়ে ছড়া-ই বা কেন রচিত হয়েছিল।'বর্গী' শব্দটি এসেছে মারাঠি 'বর্গির' শব্দ থেকে। তার মূল অংশ ফার্সি থেকে এসেছে। এর অর্থ 'হালকা অস্ত্র বহনকারী দল'। জনশ্রুতি আছে যে, শিবাজী মারা যাওয়ার পর দুর্ধর্ষ মারাঠিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছোট ছোট দলে পরিণত হয়। রঘুজি ভোঁসলে একটি বাহিনী তৈরী করেন, তাঁর সেনাপতি ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ মারাঠি বীর। নাম, ভাস্কর পণ্ডিত। এঁদের কাজ ছিল লুঠতরাজ করা। সুজলা-সুফলা বাংলাদেশের কথা সুদূর মহারাষ্ট্রে ভাস্কর পণ্ডিতের কানে পৌঁছয়, তিনি মনে মনে স্থির করেন, বাংলায় পৌঁছতে হবেই।
তখন বাংলার নবাব ছিলেন আলিবর্দি খাঁ। ১৭৪২ সালের ১৫ এপ্রিল অকস্মাৎ ভাস্কর পণ্ডিত আক্রমণ করলেন। ১৭৫২সাল পর্যন্ত এই দশ বছর বিভিন্ন ভাবে লড়াই চলেছিল। এক সময় বর্গীরা বাংলা ছেড়ে চলে গেলেও, কিছু বর্গী এই বাংলাকে ভালবেসে এখানেই থেকে যায়। তারা লুঠপাট ছেড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। যারা রয়ে যায়, তারা ইতিমধ্যেই লুঠের ধন এবং চৌথ আদায় (নবাবকে দেওয়া করের এক চতুর্থাংশ) ও ব্যবসার কারণে আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ ও বলশালী হয়ে উঠেছিলেন। অর্থের প্রাচুর্যে তারা অনেকেই জমিদারিও কিনতে সক্ষম হয়েছিল। ঠিক এমনই এক মারাঠি বংশ হলো কুন্দাস বা কুন্দন (মতান্তরে 'কুন্দ্রা)। বাংলার মাটিতে, বাংলার মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাঁরা ক্রমশ হলেন 'কুন্দ্রা' থেকে 'কুন্ডু'। ১৭৬৬ সাল নাগাদ এই কুন্দ্রা বা কুন্ডু পরিবারের তৎকালীন কর্তা, সাফল্য নারায়ণ কুন্ডু, হুগলি জেলায় একটি রাজবাড়ি তৈরি করলেন।বর্গীদের নামানুসারে জায়গাটির নাম ছিলো বর্গীডাঙা। সেই আমলে পাকা বাড়ি সাধারণত চুনসুড়কি দিয়ে গাঁথা ইঁটের গাঁথনির হত। এই বাড়িটিও ইট, চুন ও সুড়কি দিয়ে তৈরি, সেই কারনে বর্গীডাঙাকে সকলে 'ইটাচুনা' বলত। কালক্রমে জায়গাটির নাম হলো 'ইটাচুনা'। জমিদারি প্রথা বর্তমানে বিলুপ্ত হয়েছে, তথাপি কিছু জমিদারবাড়ি ও রাজবাড়ি সংস্কার করে ঠিক রাখার চেষ্টা চলেছে। সাফল্য নারায়ণ কুন্ডুর বর্তমান বংশধর (১৪-তম) ধ্রুব নারায়ন কুন্ডু রাজবাড়ির নিয়মিত সংস্কার বজায় রেখেছেন। যদিও সেটা ব্যবসায়িক কারণে। তথাপি ইতিহাস-বিজড়িত ও দর্শনীয় এই রাজবাড়িটির রূপ ও ঐতিহ্যকে তিনি নষ্ট হতে দেননি। বর্তমানে এটি একটি হেরিটেজ বাড়ি। ইটাচুনা রাজবাড়িটি এখন হুগলি জেলার পান্ডুয়া ব্লকের ইটাচুনা খন্যান গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে অবস্থান করছে।
আরও পড়ুন: মথুরা-বৃন্দাবন নয়, এই বাংলাতেই রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র
কলকাতা থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই রাজবাড়িটি গঠনগত দিক থেকে এক সাবেকিয়ানার পরিচয় দেয়। বিশালাকার লোহার গেট পার হলেই চোখে পড়ে ইংরাজী বর্ণমালার 'ইউ' (U) আকৃতির প্রকাণ্ড দ্বিতল, তিনমহলা বিশিষ্ট প্রাসাদ। বাড়িটি একটি উঠোনকে ঘিরে নানা মহলে বিভক্ত।বিশাল সবুজ খোলা চত্বরের পরে রয়েছে নাটমন্দির, তারও পরে অন্দরমহল এবং একদম পিছনের অংশে খিড়কি পুকুর।ইট, চুন, সুড়কি দিয়ে গাঁথা এই স্থাপত্য সত্যিই এক দর্শনীয় স্থান। প্রাচীনকালের মতো উঁচু উঁচু ধাপের সিঁড়ি, চারদিক ঘিরে চকমেলানো বারান্দা, প্রকাণ্ড আয়তনের ঘর, খড়খড়ির জানলা, পুরনো আমলের আসবাবপত্র, দেওয়ালে হরিণের শিং, এমনকী, কচ্ছপের খোলস দিয়ে তৈরি তৎকালীন যুদ্ধের ঢাল, বর্ম এইসব যেন ইতিহাসকে বয়ে নিয়ে চলেছে। রাজবাড়ির চতুর্দিকে সাবেকিয়ানার ছাপ সুস্পষ্ট। রাজবাড়ির বর্হিমহলে সেরেস্তার কাজকর্ম হত, একসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসও ছিল এখানে। প্রবেশপথের দু'পাশে ছোট ছোট কারুকার্যমণ্ডিত দু'টি খিলান, তার ওপর এই রাজবাড়িটির প্রতিষ্ঠার কথা লেখা আছে। "১৭৬৬ সালে সাফল্য নারায়ন কুন্ডু কর্তৃক স্থাপিত"।
সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে আসা এক দস্যু, বাংলাকে ভালবেসে, তিনি নিজে যে দুর্ধর্ষ মারাঠি- তা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন। রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে প্রবেশ করলেই সেটা বোঝা যায়। প্রশস্ত ঠাকুরদালানের দু'ধারে কারুকার্যখচিত বাতিস্তম্ভ রাখা আছে। মন্দিরে নারায়ণ বিগ্রহ রয়েছেন 'শ্রীধর জিউ'-রূপে। মন্দিরের অসাধারণ কারুকাজ প্রশংসার দাবি রাখে। এখানে রয়েছে একটি প্রতিষ্ঠিত শিবমূর্তি। শিবের মূর্তিটির বিশেষত্ব নজর কাড়ে। জনশ্রুতি শোনা যায়, এই বংশের একজন বিহারে থাকতেন। তিনি তৎকালীন ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি করতেন। সেইখানে এই মূর্তিটি তিনি পান এবং রাজবাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করেন। এই শিবমূর্তিটি অদ্ভুত দেখতে। জটাধারী, গোঁফওয়ালা কোনও এক যোগী পুরুষ যেন বসে রয়েছেন। এই ধরনের শিবমূর্তি আর কোথাও দেখা যায় না। কথিত আছে, প্রতিষ্ঠা করার দিন শিবপূজা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কুন্ডু বংশে কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তারপর থেকে তাঁরা এই মূর্তি আর কখনও পুজো করেননি। গ্রামবাসীরাই নিত্যপুজো করে থাকেন।
তৎকালীন রাজবাড়িতে ব্যবহৃত একটি ঢেঁকি, বিশালাকার দাবার বোর্ড, পুরাতন গোয়ালঘর রাজবাড়ির সাবেকিয়ানা বজায় রেখে চলেছে।
শোনা যায়, রাতে এই রাজবাড়িটিতে ভৌতিক ঘটনা অনেক সময় প্রত্যক্ষ করা যায়। সেই রাজপাট নেই, সেই রাজাও নেই, কিন্তু প্রাচীন আরামকেদারা, টানা পাখা, সাদা-কালো পোর্ট্রেট, ঘরের লাল রঙের মেঝে, সাবেকি বৈঠকখানা, ঝাড়বাতি, রাজাদের ব্যবহৃত শ্বেতপাথরের টেবিল, গড়গড়া, রাজার ব্যবহৃত অস্ত্র, এই সবকিছুই ইটাচুনা রাজবাড়ির সাবেকিয়ানা বজায় রেখে চলেছে। ইতিহাস যেন থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে এখানে। কান পাতলেই শোনা যায়, ইতিহাস এখানে ফিসফিস করে কথা বলছে।
[তথ্যসূত্র: সুতপা যতি ও সায়ন্তনী নাগ এবং ইটাচুনার জনশ্রুতি]