জাপানি বোমা থেকে আমফান, কিছুই টলাতে পারেনি শতাব্দী পার করা টালা ট্যাঙ্ককে
এশিয়া তথা বিশ্বের অন্যতম বড় পরিশ্রুত পানীয় জলের জলাধারের বয়সের জন্য মাঝে মাঝে মেরামতির দরকার পড়ে, কিন্তু তার পরেই মাথা উঁচু করেই সে দাঁড়িয়ে থাকে।
সে জীবিত নয়, কিন্তু একশো বছরের বেশি সময় ধরে কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকার মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য একটা উপাদান সরবরাহ করে চলেছে। কখনও ভূমিকম্প, কখনও ঝড়, কখনও বিষ আবার কখনও জাপানি বোমারু বিমান, বিভিন্ন সময় প্রকৃতি থেকে মানুষ- সকলেরই চোখরাঙানি সহ্য করতে হয়েছে তাকে। সবকিছু উপেক্ষা করেই সে নিজের কাজে অবিচল থেকেছে। একশো বছর পার করে আজও বাংলার বহু মানুষের কাছে খুবই পরিচিত নাম টালা ট্যাঙ্ক সেই কবিতার তালগাছের মতো সবাইকে ছাড়িয়ে শহরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আকাশে উঁকি দিচ্ছে।
ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে কলকাতার পানীয় জলের সবথেকে বড় উৎস ছিল লালদিঘি। ব্রিটিশরা শুধুমাত্র লালদিঘির জলকেই বিশুদ্ধ পানীয় জল হিসেবে গণ্য করত। ১৮২০ সাল নাগাদ জনবসতির সঙ্গে কলকাতার পানীয় জলের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছিল। তাই চাঁদপাল ঘাটের কাছে একটা পাম্প বসিয়ে সেই চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ১৮৬৪ সালে উত্তর চব্বিশ পরগনার পলতায় নদীর জল পরিশ্রুত করে পানযোগ্য করে তোলার জন্য একটা জল পরিশ্রুতকরণ কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছিল। পলতার এই পরিশ্রুত জল শুরুতে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের একটি জলাধারে জমা করা হতো। এই জলাধারটি মাটির নিচে থাকায় সেখান থেকে সমগ্র কলকাতায় জল সরবরাহ করা যথেষ্ট কষ্টকর এবং ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। তাই নতুন একটি জলাধার তৈরি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ১৯০১ সালে তৎকালীন কলকাতার অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার আর্থার পিয়ার্স টালা ট্যাঙ্ক বানানোর প্রস্তাব করেন এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ার ম্যাকাবে টালা ট্যাঙ্কের নকশা বানান। এই জলাধার বানানোর জন্য মায়ানমার থেকে কাঠ এবং ইংল্যান্ড থেকে জং-রোধকারী স্টিল আনা হয়েছিল। টালা ট্যাঙ্কের সঙ্গে বিদেশি নাম জড়িয়ে থাকলেও বাঙালিরা পিছিয়ে ছিলেন না। ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় কেশপুর থেকে পাথুরিয়াঘাটায় এসেছিল ঘোষ পরিবার। সেই পরিবারের সদস্য রামলোচন ঘোষ হেস্টিংসের অফিসের কেরানির কাজ করতেন। মানুষের মুখে মুখে তার পরিচয় হয়েছিল হেস্টিংসের বেনিয়া নামে। কথিত আছে যে, হেস্টিংস সস্ত্রীক এই ঘোষেদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেই হেস্টিংসের বেনিয়ার নাতি ছিলেন বাবু খেলাতচন্দ্র ঘোষ। টালা ট্যাঙ্ক তৈরি করতে তিনি নিজের সাত বিঘা জমি দান করেছিলেন। তাঁর নাম অনুসারে টালা ট্যাঙ্কের পাশের রাস্তার নাম হয়েছে খেলাত বাবু লেন।
বাঙালি যে ব্যবসা করতে পারে না, সেই কথাটা বাঙালি নিজেই বিভিন্ন সময়ে খণ্ডন করেছে। রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অথবা স্যর রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি থমাস মার্টিনের সঙ্গে তৈরি করেছিলেন মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি। এই কোম্পানি কংক্রিট দিয়ে টালা ট্যাঙ্কের মজবুত ভিত তৈরি করেছিল। টালা ট্যাঙ্কের ছাদ তৈরিতে বিদেশিদের সঙ্গে আরও এক বাঙালির নাম পাওয়া যায়। তাঁর নাম ছিল কালীশঙ্কর মিত্র।
আরও পড়ুন: ট্রামই বাঁচিয়ে রেখেছে কলকাতার রাস্তাকে, কীভাবে বাঁচবে এই ঐতিহ্য
১৯০৯ সালে উদ্বোধন হওয়ার পর প্রকৃতির কাছ থেকেই টালা ট্যাঙ্কের প্রথম চ্যালেঞ্জ এসেছিল । ১৯৩৪ সালে এক ভয়ানক ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে সেই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল আট। এই ভূমিকম্পে সবথেকে বেশি ক্ষতি হয়েছিল বিহারের বিভিন্ন এলাকায়। কলকাতায় এই ভূমিকম্পের যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কলকাতার বহু বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। কথিত আছে যে, ভূমিকম্পের ফলে কলকাতার সেন্ট পলস গির্জার চূড়ার একটা অংশ ভেঙে পড়েছিল। বিহার এবং নেপালে তাণ্ডব চালানো এই ভূমিকম্প বোম্বাই শহরে অনুভূত হয়েছিল। এত তাণ্ডব সত্ত্বেও টালার ট্যাঙ্ক সোজাভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল।
টালার ট্যাঙ্কের দ্বিতীয় বিপদ মানুষের কাছ থেকেই এসেছিল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সেই আতঙ্কের অন্ধকার সময়ের একটা ছড়া পরবর্তীকালে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। ছড়াটা ছিল, সারেগামাপাধানি/ বোম ফেলেছে জাপানি। ছড়াটা বর্তমানে খুবই হাস্যকর মনে হলেও সেই সময় জাপানি বোমারু বিমান কলকাতাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছিল। ভারতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই শহরের বিভিন্ন এলাকায় জাপানিরা বোম ফেলবে বলে ঠিক করেছিল। টালা ট্যাঙ্ক সেই তালিকায় থাকা অসম্ভব নয় ভেবেই ট্যাঙ্কের ছাদ সবুজ ঘাস দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে জাপানি বিমান টালার ট্যাঙ্ককে সবুজ ঘাসের মাঠ মনে করে। ১৯৪৭ এবং ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় টালা ট্যাঙ্কের ওপর বোমা বর্ষণের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
১৯৬৪ সালে হঠাৎ গুজব রটে যায় যে, ট্যাঙ্কের জলে বিষ মেশানো হয়েছে। বহু মানুষ আতঙ্কিত হয়ে টালার ট্যাঙ্কের জলপান করা বন্ধ করে দিয়েছিল। যদিও জলে বিষ মেশানোর কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এইসব চোখরাঙানি উপেক্ষা করেই টালার ট্যাঙ্ক একশো বছর পার করে ফেলেছিল। একশো বছর পার করার সঙ্গে সঙ্গে টালার ট্যাঙ্কের কিছু দুর্বলতা মানুষের নজরে এসেছিল। সেগুলো বিভিন্ন সময় মেরামত করা শুরু হয়েছিল। এমন সময় প্রকৃতি তার রুদ্ররূপ ধরে হাজির হলো। ২০২০ সালের মে মাসে আবহাওয়াবিদরা জানালেন যে, কলকাতায় আছড়ে পড়তে চলেছে ঘূর্ণিঝড় আমফান। মানুষ নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত হলেও টালা ট্যাঙ্কের কথা ভেবে বিশেষজ্ঞদের মাথায় চিন্তার ভ্রুকুটি দেখা দিয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, ট্যাঙ্ক বাঁচানোর জন্য সমস্ত প্রকোষ্ঠ সমান পরিমাণ জল দিয়ে ভরিয়ে জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার পরে চলেছিল প্রার্থনা। একদিকে শতবর্ষ অতিক্রম করা জলের ট্যাঙ্ক এবং অন্যদিকে প্রকৃতির তাণ্ডব। সন্ধ্যায় ঝড় কলকাতায় আছড়ে পরে অনেক কিছুই তছনছ করে দিয়েছিল। ঝড় থেমে যাওয়ার পরে দেখা গিয়েছিল, সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে কলকাতার পরিশ্রুত পানীয় জলের সবথেকে বড় জলাধার।
এশিয়া তথা বিশ্বের অন্যতম বড় পরিশ্রুত পানীয় জলের জলাধারের বয়সের জন্য মাঝে মাঝে মেরামতির দরকার পড়ে, কিন্তু তার পরেই মাথা উঁচু করেই সে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা কি কলকাতায় জল পান করতে গিয়ে টালার ট্যাঙ্কের গল্প মনে করি? মনে হয় না।