যেমন রসালো, তেমনই প্যাঁচালো! বাঙালির প্রিয় জিলিপিও মুঘল আমলের সৃষ্টি!
যতই দারসান, পেস্ট্রি কিংবা ব্রাউনির আগমন ঘটুক না কেন, বাঙালির মনে জিলিপির আবেদন কোনওদিনই ম্লান হবে না।
কড়ায় গরম হচ্ছে তেল, কারিগর তৈরি তাতে নিজের চিরাচরিত প্যাঁচ খেলতে! কিন্তু প্যাঁচটা কীসের? প্যাঁচটা হলো, সেই বিখ্যাত জিলিপির আড়াই প্যাঁচ। বাদামি রং ধারণ করতেই কড়া থেকে নামিয়ে চিনির শিরায় ডুবিয়ে নিলেই তৈরি গরম গরম রসালো জিলিপি। বাংলার এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে এই জিলিপি পাওয়া যাবে না। জিলিপির সঙ্গে অনেকেরই অনেক পুরনো স্মৃতি জড়িয়ে। ছোটবেলায় মেলায় গিয়ে জিলিপি কেনা হোক বা বন্ধুদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে জিলিপি খাওয়া, সেই চিরায়ত স্বাদ এখনও প্রাণ ভরিয়ে তোলে আপামর বাঙালির। এটি হলো এমন একটি মিষ্টান্ন, যেটায় কামড় দেওয়ামাত্রই আপনার স্নায়ুকোষগুলিতে এক বিশেষ ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। কচুরির সঙ্গে গরম জিলিপি সহযোগে প্রাতঃরাশ আপনার পুরো দিনটাকে যেন চনমনে করে তোলে। চিকন জিলিপি হোক কিংবা মোটা ঘিয়ে ভাজা জিলিপি, বাঙালির পাতে এই জিনিসটা কিন্তু একেবারে মাস্ট। আর অনুষ্ঠান হলে তো কথাই নেই! তাই বাঙালিকে জিলিপি চিনিয়ে দেওয়াটা নেহাতই বাতুলতা! কিন্তু বাঙালির প্রিয় এই জিলিপি এল কোথা থেকে? এর আবিষ্কারই বা হয়েছিল কোথায়?
'দ্য জাহাঙ্গিরা' থিওরি
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের খাদ্যরসিকতার কথা কারওরই অজানা নয়। প্রত্যেকদিনই জাহাঙ্গীরের খাদ্যতালিকায় থাকতো একের পর এক সুস্বাদু পক্ওয়ান। এমন সময় একদিন সম্রাট জাহাঙ্গীরের সামনে হাজির করা হলো এক বিশেষ মিষ্টি রসবিশিষ্ট, গোলাকৃতি, চক্রাকার প্যাঁচবিশিষ্ট ঘিয়ে ভাজা একটি বিশেষ মিষ্টান্ন। সেই মিষ্টান্ন খেয়ে সম্রাট জাহাঙ্গির এতটাই বিমোহিত হয়ে যান যে সেটির সাথে জুড়ে দিলেন নিজের নাম! মিষ্টিটির নাম হয়ে যায় 'জাহাঙ্গিরা', আর মুঘল খাদ্যতালিকায় সংযুক্ত হয় সেই খাবারটি। তবে, রাজকীয় এই মিষ্টিকে যদিও আমরা চিনি একটি অন্য নামে, তা হল- 'জিলিপি'।
'জালাবিয়া' থেকে 'জিলাপি'
নামের বাহারেও কিন্তু খুবই বিচিত্র এই মিষ্টান্নের আবেদন- 'জিলাবিয়া', 'জলাবিয়া', 'জুলাবিয়া', 'জিলবি', 'জিলাপি', 'ইমারতি', 'জাহাঙ্গিরা' ইত্যাদি বহু নামে ডাকা হয় এই মিষ্টিকে। প্রায় ৬০০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ভারতের খাদ্যরসিকদের রসনাতৃপ্তিতে এই মিষ্টিটির অবদান রয়েছে। তবে জিলিপির উদ্ভব যে সম্রাট জাহাঙ্গিরের সময়েই ঘটেছে, তা কিন্তু বলা যায় না। 'অক্সফোর্ড কম্পানিয়ন টু ফুড' বইয়ে দাবি করা হয়েছে, জিলিপির সবথেকে পুরনো লিখিত বর্ণনাটি পাওয়া গিয়েছিল মোহাম্মদ বিন হাসান আল বাগদাদির লিখিত ত্রয়োদশ শতাব্দীর একটি বিশেষ রান্নার বইতে। তবে, পৃথিবীর বুকে জিলিপির অস্তিত্ব এর আগেও বিদ্যমান থাকতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের খাদ্য বিষয়ক গবেষক ক্লডিয়া রডেন তাঁর একটি লেখায় দাবি করেছেন, ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্বেই নাকি মিশরের ইহুদিরা তাদের অনুষ্ঠান হানুক্কাহ পালনের জন্য তৈরি করতে একটি বিশেষ মিষ্টান্ন, যার নাম ছিল 'জালাবিয়া'। তাঁর দাবি অনুযায়ী, এটি ছিল নাকি বর্তমান জিলিপির প্রথম রূপ।
আরও পড়ুন: কোথায় হারিয়ে গেল উত্তর কলকাতার বিখ্যাত সিনেমা হলগুলো?
রমজান মাসের সঙ্গে যোগসূত্র
তবে জিলিপির সঙ্গে রমজান মাসের যোগসুত্রও বেশ গভীর। মূলত পশ্চিম এশিয়া থেকেই এই মিষ্টির উৎপত্তি। ইরানে ঐতিহ্যগতভাবেই রমজান মাসে তৈরি হতো একটি বিশেষ মিষ্টি, যার নাম দেওয়া হয়েছিল 'জুলবিয়া'। রমজান মাসে এই মিষ্টি তৈরি করে ফকির এবং মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করা হতো। লেবাননে এই মিষ্টির নাম ছিল 'জেলাবিয়া'। তবে, লেবাননের এই মিষ্টি দেখতে কিছুটা আলাদারকম ছিল। এখনও পর্যন্ত 'জেলাবিয়া' নামের একটি পেস্ট্রি পাওয়া যায় লেবাননে। যদিও সেটা আকৃতিতে গোলাকার নয়, বরং অনেকটা আঙুলের মতো। তুরস্ক, গ্রিস, সাইপ্রাসের একাধিক জায়গাতেও জিলিপির আলাদা আলাদা সংস্করণ পাওয়া যায়। সেখান থেকেই মুসলিম বণিকদের হাত ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক দেশে প্রবেশ করে যায় এই 'জিলিপি'।
ভারতীয় রসোই বরাবরই ছিল সব ধরনের খাবারের আশ্রয়স্থল। তবে, তার মধ্যেও ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাসে সবথেকে বড় প্রভাব রয়েছে তুর্কি, ফারসি, আরব ও মধ্য এশিয়ার খাবারের। আর সেই সূত্রেই আজ ভারতীয়দের রসনায় পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে এই 'জিলিপি'। দোল হোক কিংবা বাংলা নববর্ষ, বিয়ে অথবা স্বাধীনতা দিবস, সব অনুষ্ঠানেই জিলিপি একেবারে বহাল তবিয়তে হাজির! ঐতিহাসিক অ্যাংলো-ভারতীয় শব্দকোষ 'হবসন-জবসন'-এও এই জিলিপির ধারণা রয়েছে। সেখানে একটি বিশেষ খাবারের সঙ্গে আজকের এই জিলিপির নামের একটা বিশেষ মিল রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ভারতীয় শব্দ 'জালেবি' এসেছে আরবী শব্দ 'জুলেবিয়া' এবং ফারসি শব্দ 'জুলবিয়া' থেকে। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, পরবর্তীতে কিন্তু এই শব্দটি থেকেই পরবর্তী সময়ে ভারতে এসেছে এই 'জিলাপি' শব্দটি।
পশ্চিম এশিয়া থেকে কীভাবে ভারতীয়দের রসনাতৃপ্তিতে এল জিলিপি?
তবে, পশ্চিম এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়া এই জিনিসটি কবে এসে পৌঁছল এবং কীভাবে এই জিনিসটি জনপ্রিয়তা লাভ করল? এই রহস্যের কিছু গোপন সূত্র লুকিয়ে রয়েছে ভারতীয় ইতিহাস এবং সংস্কৃতি-বিশেষজ্ঞ পরশুরাম কৃষ্ণ গোড়ে-র ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত 'দ্য নিউ ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকুয়ারি' জার্নালে। সেখানে গোড়ে দাবি করেছিলেন, ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সংস্কৃত ভাষায় রচিত 'গুণ্যগুণবোধিনী' বইতে জিলিপির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। 'পয়ার ছন্দে' লেখা সেই বইতে জিলিপি বানানোর জন্য কী কী লাগে, আর কীভাবে বানাতে হয় সবকিছুর বর্ণনা রয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। খুব আশ্চর্যজনকভাবে, সকল উপকরণ এবং প্রক্রিয়ার সঙ্গে বর্তমান সময়ের জিলিপির সাদৃশ্য কিন্তু রয়েছে। তিনি তাঁর বইতে আরও বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য জানিয়েছিলেন। গোড়ে লিখেছিলেন, ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জৈন সাধু জিনসুর রচিত 'প্রিয়ঙ্কর-রূপকথা' গ্রন্থে ধনী বণিকদের নিয়ে আয়োজিত একটি নৈশভোজের বর্ণনায় একটি বিশেষ মিষ্টির উল্লেখ ছিল, যার সঙ্গে আজকের জিলিপির সাদৃশ্য রয়েছে।
সেই যুগে ভারতের জিলিপি পরিচিত ছিল 'কুণ্ডলিকা' বা 'জলবল্লিকা' নামে। এরপরে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রানি দীপাবাইয়ের সভাকবি রঘুনাথ দক্ষিণ ভারতের বিশেষ কিছু খাবার নিয়ে একটি রন্ধন-বিষয়ক ধ্রুপদী গ্রন্থ রচনা করেন এবং তার নাম দেন 'ভোজন কূতুহল'। সেই বইতে উল্লেখ পাওয়া যায় জিলিপি তৈরির পদ্ধতির। সুতরাং, একপ্রকার নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে এই জিলিপির বয়স কম করে হলেও ৬০০ বছর তো হবেই। মধ্যযুগে ফারসি-তুর্কিরা ভারত আক্রমণ করার পরেই কোনও এক সময়ে তাদের হাত ধরেই ভারতে চলে আসে জিলিপি। বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ার মতো জিলিপির আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। 'জালেবি', 'জিলাবিয়া', 'জলাবিয়া', 'জুলাবিয়া', 'জিলবি', 'জিলাপি', 'ইমারতি', 'জাহাঙ্গিরা' ইত্যাদি।
আদি জিলিপি বনাম নব্য জিলিপি
তবে হ্যাঁ, পশ্চিম এশিয়ায় যে আদি জিলিপি তৈরি হয়েছিল, তার সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান জিলিপির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য কিন্তু রয়েছে। পশ্চিম এশিয়ায় যে জালাবিয়া তৈরি করা হতো, সেখানে ময়দা, দুধ এবং দই একটু অন্যভাবে মিশিয়ে তৈরি করা হতো মিশ্রণ। তার সঙ্গেই থাকত মধু এবং গোলাপজলের সিরাপ। মুঘলরাও যখন ভারতে জিলিপি নিয়ে আসেন, সেই সময় ওই জিলিপিতে গোলাপজলের ব্যবহার থাকত। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে এই জিলিপি তৈরির পদ্ধতি অনেকটাই আলাদা। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় কিন্তু জিলিপিতে খোয়া ক্ষীর ব্যবহার করা হয়, যেটা পশ্চিম এশিয়ার জিলিপিতে ব্যবহার করা হতো না। সঙ্গেই, রাজস্থানেও এক ধরনের বিশেষ জিলিপি তৈরি হয়, যার মিশ্রণ ভারতের অন্যান্য জিলিপির থেকে একটু আলাদা।
ঢাকার 'শাহি জিলিপি'
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য দেশেও জিলিপির চল প্রচুর। বাংলাদেশেও এই জিলিপির একটি আলাদা জনপ্রিয়তা রয়েছে। ঢাকার চকবাজারের জিলিপির একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্করণ পরিচিত হয় 'শাহি জিলিপি' নামে। এই জিলিপি দেখতে কিন্তু অন্যান্য সমস্ত ধরনের জিলিপির থেকে একেবারেই আলাদা। এই জিলিপির ব্যাস প্রায় কয়েক ইঞ্চি সমান। এক, দুই কিংবা আড়াই কেজি পর্যন্ত একটি শাহী জিলিপির ওজন হতে পারে। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা এবং সিলেটের একাধিক জায়গায় এই শাহি জিলিপি বর্তমানে জনপ্রিয়। ঢাকার নবাবদের শাহি রান্নাঘর থেকেই এই বিশেষ জিলিপির সূত্রপাত। কয়েক দশক আগে যখন পুরাতন ঢাকায় এটির বাণিজ্যিক প্রচলন শুরু হয়, তখন থেকেই ইফতার অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল এই বিশেষ জিলিপি।
বর্তমানে বাংলার প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই জিলিপি। জিলিপি নিয়ে তর্কবিতর্ক, মান-অভিমান সবকিছুই রয়েছে। আবার তার সঙ্গেই রয়েছে জিলিপি নিয়ে বেশ কিছু উপমা। ঠিক যেমনভাবে কূটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনকে জিলিপির প্যাঁচের সঙ্গে তুলনা করা হয়, সেরকমই হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানে জিলিপির তুলনা করা হয়েছে নারীর মোহনীয় খোঁপার সঙ্গে। যতই দারসান, পেস্ট্রি কিংবা ব্রাউনির আগমন ঘটুক না কেন, বাঙালির মনে জিলিপির আবেদন কোনওদিনই ম্লান হবে না। জিলিপির রাজপাটের এই গল্প অনেকের স্মৃতিমেদুরতাকেও উসকে দেবে, মনে করিয়ে দেবে ছোটবেলায় জিলিপি খাওয়ার একাধিক ঘটনা। জিলিপির রূপ, জন্ম এবং নাম নিয়ে যতই বিতর্ক হোক না কেন, এখনও মেলায় গেলে কিংবা রাস্তার পাশের মিষ্টির দোকানে গরম গরম মচমচে জিলিপি দেখলে আমাদের জিভে জল আসে। তাই এই মাগ্যিগন্ডার বাজারেও পাতলা চিনির রসে ডোবানো এই জিলিপি আপনার সকালের মন ভালো করে দেওয়া মিষ্টি!