শুকিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী! যে ভয়াবহ বিপদের মুখে আমাজন নদী
Amazon River Drought: আমাজনের একটি প্রধান উপনদী সোলিমোস নদীর জল সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। আরও খানিক নীচে, টেফেতে সলিমোসের একটি শাখা সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে।
আমাজন নদী! পৃথিবীর বৃহত্তম নদী। দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত এই নদীর জন্ম পেরুর আন্দিজ পর্বতের নেভাদো মিস্মি নামের চূড়া থেকে। তিনটি দেশের উপর দিয়ে প্রায় ৩০০০ মাইল পাড়ি দিয়ে তিনটি দেশের উপর দিয়ে গিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে এই নদী। এই নদীতে যে পরিমাণ জল আছে তা বিশ্বের যেকোনও নদীর তুলনায় ঢের বেশি। আমাজন নদী বলতে এই তথ্যগুলোই তো মনে পড়ে আমাদের। তবে বৃহত্তম এই নদীকে ঘিরে ভয়াবহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমাজনের অববাহিকাতেই খরা দেখা দিয়েছে! যে নদীতে পৃথিবীর সমস্ত নদীর চেয়ে বেশি জল, সেই নদীরই জলস্তর ব্যাপকহারে নেমে গেছে। পরিবেশের এই ভয়াবহ সংকট জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমেই বাড়তে থাকা প্রভাব বন্যপ্রাণী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে ভীষণ প্রভাবিত করছে।
পৃথিবীর মিষ্টি জলের প্রায় এক ষষ্ঠাংশ যা মহাসাগরে পৌঁছয়, তা আমাজনের ৩২০-কিলোমিটারপ্রশস্ত ব-দ্বীপের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়। ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে এই নদীর আকারেও পরিবর্তন ঘটে। গরমের সময় আমাজন নদী প্রস্থে ৪ থেকে ৫ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে কিন্তু বর্ষার সময় এর প্রস্থ ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। সর্বোচ্চ প্রবাহে, নদীর স্রোত প্রতি ঘণ্টায় ৭ কিলোমিটার বেগেও বইতে পারে। সেই বিপুল আমাজনের অববাহিকায় খরা! সেই বিপুল আমাজন নদীর জল কোথায় গেল?
আরও পড়ুন- আমাজনের জঙ্গলে ৪০ দিন! মা-কে হারিয়ে চার শিশুর ভয়াবহ অভিজ্ঞতায় স্তম্ভিত বিশ্ব
পোর্তো ভেলহো শহরে আমাজনের প্রধান উপনদী মাদেইরা মাত্র ৪৮ সেন্টিমিটারে নেমে এসেছে। রয়টার্স জানিয়েছে, কলম্বিয়ার সীমান্তবর্তী ব্রাজিলের শহর তাবাটিঙ্গায়, আমাজনের একটি প্রধান উপনদী সোলিমোস নদীর জল সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। আরও খানিক নীচে, টেফেতে সলিমোসের একটি শাখা সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। যেখানে এককালে নদী ছিল, সেখানে এখন একবারে মানুষের চলাচলযোগ্য বালির পথ! গত বছরের খরার সময় ২০০ টিরও বেশি মিষ্টি জলের ডলফিন মারা গিয়েছিল টেফে হ্রদে। হ্রদটি এখন সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। বিপন্ন গোলাপি ডলফিনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল ছিল এই টেফে হ্রদ।
গ্রিনপিসের মুখপাত্র রোমুলো বাতিস্তা বলেছিলেন, এই বছরের খরা আরও জটিল প্রকৃতির হতে চলেছে। বেশ কয়েক মাস ধরে চলা খরা গত বছরের রেকর্ডও ভেঙেছে। খরার প্রভাব নদী ছাড়িয়ে আরও বিস্তৃত। সমগ্র ব্রাজিল জুড়ে গাছপালা শুকিয়ে যাচ্ছে এবং দাবানল হচ্ছে যার ফলে দক্ষিণ আমেরিকার শহরগুলি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকছে।
আমাজনের বৃহত্তম শহর মানাউসে খরার প্রভাব বিশেষভাবে স্পষ্ট। এখানে, সোলিমোরা রিও নেগ্রোতে মিশে আমাজন নদী গঠন করেছে, সেখানে জলের স্তর গত বছরের অক্টোবরে রেকর্ড করা নিম্নস্তরের কাছাকাছি পৌঁছেছে। আদিবাসী নেতা কামবেবা রয়টার্সকে জানিয়েছেন পরিস্থিতি আগের বছরের তুলনায় আরও খারাপ হয়েছে। খরা পরিস্থিতি এবার আগেভাগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। বাতিস্তা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভবিষ্যতে আর নতুন করে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। মানুষ যতটা প্রত্যাশা করেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে এই পরিবর্তন।
আরও পড়ুন- ব্রাজিলের গদি উল্টোনো কতটা বাঁচাবে পৃথিবীর ফুসফুস আমাজনকে
খরা এবং বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়নের মধ্যে সম্পর্ক খানিক জটিল। তবে জলবায়ু পরিবর্তন দু'টি প্রধান উপায়ে শুষ্ক অবস্থা বা খরায় ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথমত, আমাজন অববাহিকায় সাধারণত জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কম বৃষ্টিপাত হয়। দ্বিতীয়ত, গরমকালে তাপমাত্রা বাড়ায় গাছপালা এবং মাটি থেকে বাষ্পীভবনও বাড়ে, তাই আরও জল কমে যায়। ২০২৩ সালে, আমাজন অববাহিকায় গত ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক খরা দেখা দিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা জানান, গত বছর, এল নিনো-র কারণে খরা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়, যার ফলে আমাজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ এবং শুষ্ক হয়ে যায়। আমাজনে খরার আরেকটি কারণ হল বনভূমি ধ্বংস। গত ৫০ বছরে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ বৃষ্টিঅরণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। এখানের বিশাল গাছগুলি খরার থেকে বাঁচাত পরিবেশকে। গাছের পাতা থেকে বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ত, বৃষ্টিপাত বাড়াত।
প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমি ধ্বংস সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিন্তু বর্তমান খরায় বনের আরও ক্ষতি হচ্ছে। আমাজন অববাহিকায় এই নিয়ে টানা দ্বিতীয় বছর গুরুতর খরা দেখা দিল। আমাজন অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য এবং এই গুরুত্বপূর্ণ জলপথের উপর বহু বহু সম্প্রদায় নির্ভরশীল। এই মানুষদের জীবন, বেঁচে থাকার উপর যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে চলেছে তা আশঙ্কা বাড়াচ্ছে বৈকি।