ধর্মীয় উস্কানি থেকে সিএএ-র হুঁশিয়ারি! ধর্মতলার মঞ্চ থেকে যে যে ইঙ্গিত দিলেন শাহ
Amit Shah: হাজার হাজার কর্মী-ভক্ত, তাঁদের উন্মাদনার মধ্যেই মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন অমিত শাহ। তবে বেশিক্ষণ নয়, মাত্র ২৩ মিনিটেই শেষ হয়ে গেল অমিত শাহের বক্তব্য।
ধর্মতলার ঠিক যে জায়গায় ২১ জুলাই সভা করেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ঠিক সেখানেই মঙ্গলবার হয়ে গেল বিজেপির বিরাট জনসভা। যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে হাজির ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির চাণক্য অমিত শাহ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভা বলে কথা, স্বাভাবিক ভাবেই সভামঞ্চের সামনে হাজির হয়েছিলেন হাজার হাজার কর্মী-ভক্ত, তাঁদের উন্মাদনার মধ্যেই মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন অমিত শাহ। তবে বেশিক্ষণ নয়, মাত্র ২৩ মিনিটেই শেষ হয়ে গেল অমিত শাহের বক্তব্য। অমিত শাহের মতো হেবি ওয়েট নেতার এত কম সময়ের বক্তব্য় স্বাভাবিক ভাবেই চোখ টাঁটিয়েছে। তবে যা মনে হচ্ছে, লোকসভা ভোটের আগে এ রাজ্যের বিজেপি নেতাকর্মীদের মনোবলকে বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল ওই ২৩টি মিনিটই। ওই তেইশ মিনিটেই মোটামুটি রাজ্যবিজেপিকে দিশা দেখিয়ে গিয়েছেন তিনি।
আসছে বছর লোকসভা ভোট। কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের ফেরা নিয়ে ততটা সংশয় না থাকলেও বাংলায় এখনও পর্যন্ত দাঁত ফোঁটাতে পারেনি ভারতীয় জনতা পার্টি। প্রতিবারই ভোটের আগে আগে নিজেদের প্রভাববিস্তারের চেষ্টায় বাংলায় আসতে শুরু করেন কেন্দ্রীয় বিজেপি দলের একাধিক শীর্ষনেতৃত্ব। ২০২৩-ও ব্যতিক্রম নয়। মোটামুটি প্রথা মেনেই এ রাজ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে বিজেপি নেতৃত্বদের যাতায়াত। এ দিন মঞ্চে উঠেই তৃণমূল ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ শানাতে শুরু করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে এই সভার অভিমুখ যে চব্বিশের লোকসভার কথা মাথায় রেখেই, তা গোড়া থেকেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন অমিত শাহ। মোটামুটি এই বক্তৃতা কোথায় পৌঁছতে চলেছে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে সভার শুরুতেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, কেউই বাদ গেলেন না তাঁর বক্তব্য থেকে। এমনকী উঠল গোপাল পাঁঠার নামও।
আরও পড়ুন: অ্যাপেলের অ্যালার্ট, কার কার ফোনে আড়িপাতার চেষ্টা অমিত শাহের মন্ত্রকের?
তবে এসবের পিছনে বিশেষ সময় নষ্ট করতে দেখা গেল না এদিন শাহকে। বরং ভণিতা না করে সরাসরি তৃণমূলকে আক্রমণ শানানোর দিকে ঢুকে পড়লেন তিনি। পাশাপাশি রাজ্যবিজেপি নেতৃত্বের ভার যে মূলত শুভেন্দু অধিকারী ও সুকান্ত মজুমদারের হাতেই দিয়ে রেখেছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব, তাও এদিন স্পষ্ট করে দিলেন অমিত শাহ। বারবার উঠে এল তাঁর বক্তৃতায় তৃণমূল সরকারের দুর্নীতির প্রশ্ন। বাংলার মানুষ যে তৃণমূল সরকারের অধীনে ভালো নেই, আর বিজেপি সরকার এলেই যে তার বদল সম্ভব, সে কথাই আরও একবার স্পষ্ট করে দিলেন। উঠে এল নির্বাচনী হিংসার কথা, কাটমানি-সিন্ডেকেট থেকে পার্থ, অনুব্রত বা জ্যোতিপ্রিয়ের মতো নেতাদের দুর্নীতির উল্লেখ। শাহের মতে, যে বাংলার সকালে এককালে কান পাতলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যেত, সেখানে এখন বোমার শব্দ পাওয়া যায়। রাজ্যের উন্নয়নে মোদী সরকার লাখো লাখো টাকা পাঠালেও তৃণমূলের সিন্ডিকেট তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে দেয় না বলেও অভিযোগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর এরপরেই সরাসরি তৃণমূলনেত্রীকে চ্যালেঞ্জ করেন শাহ। ৩ জেলবন্দি তৃণমূল নেতার নাম তুলে তাঁর দাবি, 'ক্ষমতা থাকলে জ্যোতিপ্রিয়, অনুব্রত, পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের মতো নেতাদের সাসপেন্ড করুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে শুধু তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধ তোপ দাগাই নয়, শাহের এই সভার আরও একটি উদ্দেশ্য যে মোদি সরকারের গুণগুলি এ রাজ্যের মানুষের কর্ণকুহরে পৌঁছে দেওয়া। আর সেই কাজটা ভালো মতোই করেছেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর বক্তৃতায় উঠে এসেছে একের পর এক মোদির সাফল্যের কথা। কাশ্মীর, করোনা, চন্দ্রযান থেকে রাম মন্দির, বাদ যায়নি কিছুই। কংগ্রেস ও তৃণমূল মিলে রামমন্দির গড়ার কাজ আটকে রেখেছিল বলে তোপ দাগেন তিনি। একই সঙ্গে ওঠে অনুপ্রবেশকারীদের কথাও। এ রাজ্যে তৃণণূল সরকারের ঢিলেঢালা নীতির কারণেই যে দেশে অনুপ্রবেশকারীর বাড়বাড়ন্ত, তা স্পষ্ট করে দেন শাহ। পাশাপাশি তাঁর হুঁশিয়ারি, এ বার যে যে কোনও ভাবে তিনি সিএএ কার্যকর করবেনই।
লোকসভা ভোটের আগে অমিত শাহের এই জনসভা স্বাভাবিক ভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাজ্যবিজেপির জন্য। ভোটের আগে নেতাকর্মীদের মনোবল বাড়াতে টনিকের মতো কাজ করবে শাহের দাওয়াই। সেই ভাবনা থেকেই তো এমন সভার আয়োজন। তবে শুধু যে ২৪-এর লোকসভার দিকেই তাকিয়ে নেই বিজেপির কেন্দ্র নেতৃত্ব, তা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে শাহের কথায়। ২০২৬ সালে এ রাজ্যে বিধানসভা ভোট। চব্বিশের লোকসভা ভোটের চেয়েও যেটা বেশি পাখির চোখ বিজেপির। আর তার জন্য যে এ রাজ্যে শুভেন্দু অধিকারীর উপরেই ভরসা রাখছেন কেন্দ্রীয় বিজেপি, তা একরকম বুঝিয়ে দিয়েছেন অমিত শাহ। এদিন মমতার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে অমিত শাহ বলেন, "২ কোটি ৩০ লাখ ভোট বাংলায় ভারতীয় জনতা পার্টি পেয়েছে। আমাদের নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে দিদি দ্বিতীয়বার বিধানসভা থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছেন। আমি বলছি, দিদি কান খুলে শুনে নিন শুভেন্দুজিকে আপনি বিধানসভার বাইরে বাইরে বের করতে পারেন। কিন্তু, বাংলার জনতাকে চুপ করাতে পারবেন না। বাংলার মানুষ বলছে দিদি আপনার সময় এবার শেষ হয়ে গিয়েছে।"
আরও পড়ুন: বিজেপি ভার্সেস বিজেপি! শুভেন্দু-দিলীপের কোন্দল থামাতে বাংলায় আসতে হল অমিত শাহকে?
এদিন সভামঞ্চ থেকে একদিকে যেমন তৃণমূলের মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে ধস নামানোর চেষ্টা করছেন শাহ, অন্যদিকে তেমনই বাংলার মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসার স্মৃতি উসকে ধর্মের তাস খেলারও চেষ্টা করছেন। আর তাতেই যে মাছের চোখ বিদ্ধ হবে ভোটের আগে, তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন নেতাকর্মীদের। সব মিলিয়ে লোকসভা ভোটে যেমন বাংলা থেকে ভালো ফল চাইছেন শাহ, তেমনই বিধানসভা ভোটেও এ রাজ্যে বিজেপির খুঁটি শক্ত করার দিকে বেশি করে মন দেওয়ারও ইঙ্গিত রেখে গেলেন তিনি সভায়।