আমফান, বুলবুল অথবা মোকা, কেন বারবার বঙ্গোপসাগরেই জন্ম নেয় মারণ ঘূর্ণিঝড়

Cyclone at Bay of Bengal : আমফান, বুলবুল অথবা মোকা, কেন বারবার বঙ্গোপসাগরেই তৈরি হয় বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলি?

শেষ কয়েক বছরের মে মাস মনে করুন, একের পর এক ঝড়ের নাম আসবে ফ্ল্যাশব্যাকে। আজকের মোকা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বুলবুল, ইয়াশ, আমফানদের তালিকায় কেবল একটা নতুন সংযোজন মাত্র। প্রসঙ্গত, গতকালই মায়ানমারের সিতওয়া উপকূলে আছড়ে পড়ে সুপার সাইক্লোন ‘মোকা’। ঝড়ের দাপটে শুরু হয় তছনছ প্রক্রিয়া। ল্যান্ডফলের সময় মোকার সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২১০ কিলোমিটার। মায়ানমার ছাড়াও বাংলাদেশের একাধিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেছে সুপার সাইক্লোন মোকা। একইভাবে এর আগে বাংলাদেশ সহ এপার বাংলার দক্ষিণবঙ্গেও প্রবল আঘাত হেনেছিল অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়গুলি। ইয়াশ, আমফান অথবা বুলবুলের সেই ঘা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন উপকূলবাসী।

কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখেছেন কি, এই যে ঘূর্ণিঝড়গুলি বছর বছর ধেয়ে আসছে সেগুলির বেশিরভাগই সংঘটিত হয় বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু এর কারণ কী? কেন বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড়ের টার্গেট হতে হয় এই অঞ্চলকে? প্রশ্নগুলোর উত্তরে ঐতিহাসিক সুনিল অমৃতের বঙ্গোপসাগরকে নিয়ে একটি বর্ণনা খুবই প্রাসঙ্গিক। বর্ণনাটি খানিক এই রকম, বঙ্গোপসাগর মানেই এক বিস্তীর্ণ জলরাশি, যা জানুয়ারিতে একেবারে শান্ত এবং নীল‌; আর গ্রীষ্মের বৃষ্টিতে এটির রূপ একেবারে ভিন্ন। যেন ফুঁসতে থাকা ঘোলা জলের সমূদ্র।

আরও পড়ুন - মোকা-পর্ব শেষ! জানেন পরের ঘূর্ণিঝড়ের নাম হতে চলেছে কী?

মূলত ভারত মহাসাগরের উত্তর অংশ, আরব সাগরের একটি বড় অংশ এবং বঙ্গোপসাগরে কোনও ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি শুরু হলে তার দিকে কড়া নজর রাখে ইন্ডিয়ান মেটেরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট। সেই মতো প্রস্তুত করা হয়েছে নামের একটি তালিকাও। ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, পাকিস্তান, মলদ্বীপ, ওমান, শ্রীলঙ্কা, তাইল্যান্ড, ইরান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ইয়েমেন এই ১৩টি দেশের দেওয়া ১৩টি করে নাম নিয়ে প্রস্তুত হয়েছে তালিকা। আয়লা, আমফান, বুলবুল, হুদহুদ, ফণী, অশনি, এমনকী আজকের এই মোকা - এই সবকটি নামই এসেছে ওই তালিকা থেকে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, উপরে উল্লিখিত এই বিশেষ বিশেষ বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলির মধ্যে সিংহভাগই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট। আবহাওয়াবিদদের মতে, সামুদ্রিক জলোচ্ছাস সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ নেয় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবেই। আর এই জলোচ্ছ্বাস সবচেয়ে প্রবল হয়ে উঠে অবতল আকৃতির অগভীর উপসাগরে। মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তীব্র বাতাস যখন এরকম জায়গায় সাগরের জলে ঠেলা দিতে থাকে, তখন ফানেল বা চোঙার মধ্যে তরল যে আচরণ করে, এখানেও ঠিক তাই ঘটে। সাগরের ফুঁসে উঠা জল চোঙা বরাবর ছুটতে থাকে। আর এই ভৌগলিক রূপের উপযুক্ত উদাহরণ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর।

আরও পড়ুন - মনে করাচ্ছে আমফান, ঠিক কোথায় কতটা তাণ্ডব চালালো মোকা?

উত্তর ভারত মহাসাগর এবং আরব সাগরের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের মূল তফাৎ হল উষ্ণতার। আর এটাই অধিক ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃত কারণ। জলোচ্ছ্বাস সংক্রান্ত কারণের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে অতিরিক্ত যুক্ত হয় বাড়তি কিছু বৈশিষ্ট্য। যার মধ্যে অন্যতম হল সমুদ্রের উপরিতল বা সারফেসের তাপমাত্রা। আবহাওয়া দফতরের এক অধ্যাপক ডি মহাপাত্র জানান, এটাই পরিস্থিতিকে আরও বিপদজনক করে তোলার জন্য দায়ী। যেহেতু, বঙ্গোপসাগর অন্যান্য সাগরের তুলনায় বেশি উষ্ণতা ধারণ করে তাই এই সমুদ্রের বাতাসে জমা হয় প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্প। ক্রমাগত বৃষ্টিপাত এই আর্দ্রতাকে ধরে রাখে। ফলে নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় এবং ঘূর্ণিঝড় থেকে মহাঘূর্ণিঝড় অথবা সাইক্লোনে পরিণত হতে বেশি সময় লাগে না এই সমুদ্রে। পাশাপাশি, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রকোপও এখানে মারাত্মক আঘাত হেনেছে, যার জেরে ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা বেড়েছে বঙ্গোপসাগরের।

উল্লেখ্য যে, ‘ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড‌’ নামের একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ৩৬টি মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা রয়েছে। এই তালিকার মধ্যে ২৬টি ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থলই হল বঙ্গোপসাগর। এই সমস্ত ঘূর্ণিঝড়গুলির ক্ষয়ক্ষতির হিসেবের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। তারপরেই আসে মায়ানমার এবং পশ্চিমবঙ্গের নাম। গত ২০০ বছরে পৃথিবীর ৪২ শতাংশ ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব চালিয়েছে বাংলাদেশে। প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২০ লাখ মানুষ। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের ভোলায় যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল, সেটি এখনও পর্যন্ত বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়। মারা যান প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ। যদিও এই মনুষ্যকুলের উপর ক্ষতির পরিমাণের আরও একটি বড় কারণ হল অন্যান্য সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগর উপকূলেই পৃথিবীর সবথেকে বেশি মানুষ বসবাস করেন। আবহাওয়াবিদরাও তাই মনে করেন, বিশ্বের আর যে কোনও উপকূলের চাইতে বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূলে এই ধরনের জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি সর্বাধিক।

More Articles