মুগপুলি আর গোকুল পিঠে যেন সময়গাড়ি, কে বলে রান্নার ভূগোল নেই!
মাঘ ফুরোলেই টের পাওয়া যায়। তখন কেবল এলোমেলো হাওয়ায় চুল উড়িয়ে নিয়ে যায় পৌষের সকাল। নরম রোদ্দুরে মানুষের ঘর উঠোন আর খামারবাড়ি ভরে ওঠে ধান ঝরানোর শব্দে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া ধান জমতে জমতে আস্ত একখানা সুবর্ণর্রেখা নদী হয়ে উঠতে চায় কেবল। মানুষের গেরস্থালির গদ্যখানা শীতের সকালে তার পোষাকি জোব্বাখানা খুলে রেখে তখন কাব্যশরীর পায় অনায়াসে। খুব ভোর ভোর মেটে হাড়িতে কুয়াশা মেখে জমে থাকে যে খেজুর রস, সে যেমন সামান্য আতপের উত্তাপ খোঁজে কিছু! এও তেমনই। গাছ থেকে নামিয়ে আনা রস, ওই আসছে, মানুষের কাঁধে চেপে। কাপড়ের ছাকনিতে ছেঁকে নিতে নিতে সূর্য খানিক উত্তাপ বিলোবে আরও। ও রসে চুমুক দিলে তখন শরীরখানা শিরশিরিয়ে উঠবে। পৌষের সকাল জানে এসব। জানে বলেই না কেবলই এলোমেলো হাওয়ায় সে মানুষের কলিজাটুকু ছুঁয়ে যেতে চায় আলোয়ানের ফাঁকফোকর দিয়ে! তবু মানুষের কী আর এমন সকালে রসচৈতন্যে তলিয়ে যাওয়ার অবসর আছে! ঘরে ঘরে তাই ভাত ফুটছে। খানিক ভাত খেয়ে মানুষ এবারে কাজে লাগবে। ধান ঝাড়বে, কুলোর বাতাসে তুষ ওড়াবে আর হাতের তেলোয় ধানের ভার বুঝে নিতে চাইবে সংসারী মানুষের হিসেবি মনখানা নিয়ে। দেশ ঘরে এমন ছবি যারা দেখেছেন তারা জানেন, মানুষের যাপনে এমন কতই অভ্যাস থিতু হয়ে আছে বছরভর। তবু, সেই যাপনে কি মানুষের কলজে ছোঁয়া ওম নেই? আছেই তো। থাকবেই তো। আছে বলেই না লবানের কথায় এ গাঁয়ের মেয়ে বুড়ো মায় জোয়ান ছেলেরও মুখখানা আলো হয়ে ওঠে। ঘরে ঘরে তখন গোবর লেপা উঠোন আর ঢেঁকির পাড় সেজে ওঠে পার্বণের রঙে।
এই তো অঘ্রাণের ইতুপুজো ফুরলো সবে। ঘরে ঘরে অঙ্কুরিত শস্যবন্দনার গান ছড়িয়ে পড়তে চাইলো পৌষের আবাহন হয়ে। কত বচ্ছর আগের সেই বর্ষবরণের গল্পখানা এমন করে থিতু হয়েছে আজ, তার হিসেব রাখে কে! রাখে না কেউ, রাখবার কোনো দায় নেই। কেবল 'নিরিমিষ' খিচুড়ির গন্ধে যখন গুড় আর সোনালি ঘি মিলেমিশে যেতে যেতে অঘ্রাণের বেলা ফুরিয়ে আসে! মানুষ তখন টের পায় ইতুপুজো ফুরলো। এবারে পৌষের হাওয়া ছাড়বে। মানুষের গেরস্থালির ভাবনা অমনই। গেরস্থালির দিন ফুরানো জীবনযাপন নিয়ে অত তলিয়ে ভাবতে মানুষের বয়েই গেছে। বয়ে গেছে বলেই না এই যে আমাদের শিবু, এই যে আমাদের দিপান ধান ঝেড়ে নিতে নিতে লবানের বাজারদর নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে অফুরান, ওদের কি আর নবান্নের গন্ধে ডুবে যাবার অবকাশ আছে? ওরা কেবল মিলে গিয়ে চিঁড়ে কুটিয়ে আনে, দরদাম করে কদমা কেনে, গুড় কেনে। মনীন্দ্র গুপ্তের গদ্যশরীর পেতে ওদের মনের কোনও গরজ নেই। খেজুরের রসে, আতপ চাল বাটা, নারকেল কোরা, মুলো আর আদা কুচানো পৌষালি গন্ধে তেমন করে মন ডোবানোর ইচ্ছে নেই ওদের। পার্বণের দায় নিয়ে এ কেবল উৎসবে ডুবে যাবার অভ্যাস বৈ অন্য কিছু নয়। তবু তো এমন দিনে ঘরে ঘরে লবানের অয়োজন হয়! নিরিমিষ লবান ফুরোলে বাস লবানে মাছ ভাতের গন্ধও এদিক সেদিকে ছড়িয়ে পরে রোদেলা দুপুরে। শরিকি পুকুরের মাছ ভাগাভাগি হয় এসব দিনে। এই নিয়েই পার্বণ ফুরোয় গাঁ-গঞ্জের জীবনে। তখন আর কী!
পালা ফুরানো ঘর আবার তার পুরনো খেলায় ফিরে যেতে চায়। সে খেলায় আর কিছু নাই থাক সময়ের উত্তাপ থাকে কিছু। পৌষের লাল মুলো দিয়ে আদা লঙ্কা ছেঁচে জবজবে করে সর্ষের তেলে খেজুরছড়ির মুড়ি মেখে দেয় যখন রুকসানার দাদি! আমাদের রুকসানা তখন নাক টেনে নিতে নিতে গরাস ভরে ভরে মুড়ি খায়। ওর বাসি বিনুনি আর ন্যুব্জ পিঠে তখন উত্তরায়ণের সূর্যালোক ভারি মৃদু ভঙ্গিতে এলিয়ে পড়তে চায়। কে বলে রান্নার কোনো ভূগোল নেই! দেশ ঘরের যাপনে অভ্যাসে সময়ের হিসেব এমন করেই তো হেঁশেলের জানলাখানি মেলে ধরে সময়ে সময়ে। এমন শীতের দিনে মানুষ খোলস বদলানো নরম নীলাভ চিংড়ি সাঁতলে নেয় নরম আঁচে। প্রথম পাতে খুকির ভাতখানা তখন চিংড়ি ভাজা তেলের গন্ধে ম ম করে। খুকির পিসোর অবিশ্যি এসবে মন ভরে না, শেষ পাতে মুলো বড়ি বেগুন দিয়ে নিরিমিষ টকে চুমুক দিতে ভারী ইচ্ছে করে তার। পুরনো তেঁতুলে আর গুড়ে বাসি টক জমে স্থির হয়ে থাকে এমন দিনে। পৌষের হাওয়া যেন কেবলই একখানা পলিদ্বীপ গড়ে তুলতে চায় এইসব গেরস্থালির গপ্পে। সে গপ্পে মানুষের দেশ কাল সময়ের ছাপ পড়ে হয়তো বা। না পড়লেও ক্ষতি নেই কোনো। তবু, মানুষের মন তো! তেজারতি কারবারের মতো এজমালি স্বাদ কাহনের ভার বইতে ইচ্ছে জাগে তার। তাই না সে মায়ের মতো করে সংক্রান্তির আলপনা দিতে চায়। বাস্তু পুজোয় গুড়ের পায়েস রাঁধতে রাঁধতে সে কি আসলেই ফিরে যেতে চায় দেশ কালের সীমান্ত পেরিয়ে কোনো ফেলে আসা জীবনের খোঁজে?
এই তো আর কদিন পরেই মুগপুলি আর গোকুল পিঠে গড়ে নিতে নিতে কেবলই ফিরে যাবার ইচ্ছে হবে অপসৃয়মাণ সময়ের দরবারে। দেশের গল্পে আর রান্নার গল্পে তাই মিশে থাকে ভূগোলের গন্ধ, ইতিহাসের উত্তাপ। তাকে কি দেশের বাড়ির রান্না বলে দাগিয়ে দেওয়া চলে? মানুষের অভিপ্রয়াণের ইতিহাসে সময়ের পলি দিয়ে মেজে ঘষে নেওয়া পাকঘরও এমন করে গল্প বলতে জানে, সেকথা কি ভেবেছিল কেউ! তার হলুদের দাগ, তার কষ গড়ানো বটির প্রান্ত সে কি কেবল অভ্যাস? আমার কিন্তু তেমনটা মনে হয় না। কেবলই মনে হয় আস্ত একখানা গতিময় জীবনের ভার বয়ে চলেছে যে ওই যে উনোন, ওই যে ডাবুহাতা, – মানুষের গল্পে ওরও খানিক ভূমিকা আছে। উঠোন পেরিয়ে এমন দিনে পৌষের হাওয়া ঠেলে উনোনের পাশটিতে গিয়ে বসতে ইচ্ছে করে তখন। জবুথবু হয়ে বসতে বসতে টের পাই, এই যে উত্তাপ, এই যে রান্নার বাস! তার যেন এক দণ্ড স্থির হতে নেই। কী আশ্চর্য গতিময় তার যাপন! তার ভিতরেও যেন জন্ম নিয়েছে একখানা আকূলতা। তাই তো সে চলেছে। নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে।